শেরপুর প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:১৮ পিএম
আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:৪৬ পিএম
শেরপুরে অনুমোদনহীন ইটভাঁটার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে কৃষি ও প্রকৃতি। প্রবা ফটো
ছাড়পত্র বা অনুমতি নেই। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দেদারসে চলছে ইটভাঁটা। শেরপুর জেলার ৬১টি ইটভাটার মধ্যে ৫৮টিই চলছে অবৈধভাবে। বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে শেরপুরের ফসলি জমি ও বসতবাড়ির আশপাশে গড়ে উঠেছে এসব ইটভাঁটা। কয়লার দাম বেশি, তাই ভাঁটাগুলোতে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠখড়ি। এতে বাড়ছে পরিবেশের দূষণ। এদিকে আবাদি জমির টপ সয়েলই অধিকাংশ ভাঁটার মাটির উৎস। এতে একরের পর একর জমি পতিত হচ্ছে, উর্বরতা হারাচ্ছে কৃষিজমি। তবুও বন্ধ হচ্ছে না এসব অবৈধ ভাঁটা।
শেরপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ৬১টি ইটভাঁটা রয়েছে। তবে কিছু ভাঁটা বন্ধ থাকলেও বৈধ কাগজপত্র নেই ৫৮টির। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ইটভাঁটা গড়ে উঠেছে আবাদি জমিতে। এসব ভাঁটার আশপাশে রয়েছে বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও হাটবাজার। এছাড়া আইন অমান্য করে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ-খড়ি। অথচ ইটভাঁটা নিয়ন্ত্রণ আইনে কৃষিজমি, আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ অন্য কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরত্বে ভাঁটা স্থাপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। শেরপুর পৌর শহরের মোবারকপুর ও কালিগঞ্জ দমদমা মহল্লাতেই ১০টির মতো ভাঁটা রয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, তিন ফসলি জমি ও লোকালয়ে গড়ে ওঠা এসব ভাঁটায় ইট বানাতে কৃষকদের জমির উপরিভাগের মাটি কিনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে ফসল উৎপাদন ক্ষতির মুখে পড়ছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ। প্রতিনিয়ত ভাঁটার ধোঁয়ার দূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি ফসল ও গাছের ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ হারাচ্ছে বৈচিত্র্য। বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন।’
শেরপুর পৌর শহরের কালীগঞ্জ মহল্লার বাসিন্দা আলম মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘কালিগঞ্জ দমদমা মহল্লাতেই ১০-১২টি ইটভাঁটা রয়েছে। পৌরসভার মধ্যেই এতোগুলা ভাঁটা দেদারসে চলছে। ভাটায় কয়লা পোড়ানো হয়। এর ঝাঁঝে শিশু ও বয়স্কদের শ্বাসকষ্ট হয়। ঠান্ডা লেগেই থাকে। ইটভাঁটার বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে অনেক গাছ মরে যায়। সবজির আবাদও হয় না। ভাঁটাগুলো হওয়ার পর এখানকার জমিতে ধানের ফলনও কমে গেছে। বসতবাড়ির আশপাশে লাগানো ফলের গাছগুলোতে ঠিকমতো ফল ধরে না। আমগুলো এখন বরইয়ের মতো ছোট হয়ে গেছে। নারিকেলে পানি থাকে না, বড় বড় গাছ মরে যায়।’
ইটভাঁটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম মনির জানান, তারা আইন মেনে বৈধভাবেই ব্যবসা করতে চান। ইটভাঁটার ছাড়পত্রের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে তারা আবেদনও করেছিলেন। তবে অনুমোদনের সব শর্ত পূরণ করা সম্ভব না হওয়ায় সেগুলো আটকে আছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের শেরপুর জেলার আহ্বায়ক মেরাজ উদ্দিন বলেন, ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ইট প্রস্তুত করতেই হবে। তবে বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ইট তৈরি হয় তাতে ব্যাপকভাবে পরিবেশ দূষণ হয়। এ পদ্ধতি বাদ দিয়ে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ইট প্রস্তুত করতে ভাটা মালিকদের আমরা উৎসাহিত করছি। এছাড়া যেখানে-সেখানে গড়ে ওঠা অনুমোদনহীন ইটভাঁটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘দূষণের জন্য স্থানীয় ইটভাঁটাগুলো সবচেয়ে বেশি দায়ী। ভাঁটা থেকে নির্গত দূষিত উপাদানের প্রাদুর্ভাবে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এসব দূষিত উপাদানের মধ্যে পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রতিনিয়ত বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে। এটি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির বড় কারণ। পাশাপাশি ভূ-উপরস্থ মাটির ব্যবহারে আশঙ্কাজনক হারে কমছে কৃষিজমির পরিমাণ। এসব ইটভাঁটা মাটি, পানি এবং জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে।’
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডা. বাহাদুর শাহ মামুন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ইটভাঁটার ধোঁয়ায় ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্টসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে এই ধোঁয়া ভাঁটার আশপাশের শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বেশি ক্ষতির কারণ।’
কৃষিবিদ ড. মোহিত কুমার বলেন, ‘ফসলি জমিতে ইটভাঁটা স্থাপন করলে মাটির ওপরের স্তরের জৈবপদার্থ নষ্ট হয়ে যায়। এতে ধীরে ধীরে উর্বরতা হারায় মাটি। ভাঁটা বন্ধ হওয়ার পরও দীর্ঘদিন প্রভাব থাকে। এছাড়া ভাঁটার কাজে জমির টপ সয়েল কেটে নিয়ে যাওয়ায় দিন দিন কমছে আবাদি জমির পরিমাণ।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, সব জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অধীনে দুই দফায় অভিযান পরিচালনা করেছে ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে ওই অভিযানে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার উপস্থিতি ছিল না।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রুবেল মাহমুদ বলেন, ‘ইটভাঁটা স্থাপন আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯) এর ৪ ধারা মোতাবেক ইটভাঁটা স্থাপনের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে শেরপুরের বেশিরভাগ ভাঁটার ছাড়পত্র ও লাইসেন্সের হালনাগাদ নেই। সম্প্রতি উচ্চ আদালত এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের সব অবৈধ ইটভাঁটা বন্ধের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশ মোতাবেক অবৈধ ইটভাঁটার তালিকা তৈরি করে বন্ধের কাজ শুরু করি আমরা। এরই আওতায় শেরপুরে প্রথম দফায় ছয়টি ভাঁটায় ১৮ লাখ আর দ্বিতীয় দফায় ১৬টি ভাটায় ৪১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া বেশকিছু ভাঁটা ভেঙে দেওয়া হয়।’
শেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সাহেলা আক্তার বলেন, ‘এরই মধ্যে শেরপুর জেলায় থাকা অবৈধ ইটভাঁটাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নীতিমালা অনুসরণ করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো শুরু হয়েছে। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’