× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সবুজ ঘাসে সবুজ ‘বিপ্লব’

ঝিনাইদহ প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:২২ পিএম

আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:২৩ পিএম

বাড়ির আশপাশের অনাবাদি উঁচু ও পতিত জমি, খাল-বিলের পাশে ঘাস চাষে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন ঝিনাইদহের প্রান্তিক ভূমিহীন চাষি আর স্বল্প আয়ের মানুষ। প্রবা ফটো

বাড়ির আশপাশের অনাবাদি উঁচু ও পতিত জমি, খাল-বিলের পাশে ঘাস চাষে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন ঝিনাইদহের প্রান্তিক ভূমিহীন চাষি আর স্বল্প আয়ের মানুষ। প্রবা ফটো

একসময় রাস্তা বা ক্যানেলের দুই ধার ফাঁকা পড়ে থাকত। সে দৃশ্য এখন কল্পনাতীত। গ্রামের রাস্তায় চলতে গেলে চোখে প্রশান্তি এনে দেবে সবুজ ঘাস। মাইলের পর মাইল ঘাস আর ঘাস। কোথাও একটু বড় আবার কোথাও সাত-আট ফুট লম্বা হয়ে কাটার উপযুক্ত হয়ে গেছে।

শুধু রাস্তা-ক্যানেল নয়, বাড়ির আশপাশের অনাবাদি উঁচু ও পতিত জমি, খাল-বিলের পাশে ঘাস চাষে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে ঝিনাইদহের প্রান্তিক ভূমিহীন চাষি আর স্বল্প আয়ের মানুষ। হচ্ছেন লাভবান। হাটে-ঘাটে, মাঠে সর্বত্র এখন সবুজ ঘাস- এ যেন সবুজ বিপ্লব! বাজারে খৈল-ভূসিসহ দানাদার গোখাদ্যের দাম ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় উন্নত জাতের ঘাস চাষে ঝুঁকছেন খামারিরাও।

জেলার শৈলকুপা উপজেলার মাঠঘাট, হাটবাজার ঘুরে দেখা গেছে ঘাস যেন মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হয়ে উঠেছে। এখন গ্রামের মানুষ তাদের গরু-মহিষ বা ছাগলের জন্য বাজার থেকে দুই-চার আঁটি ঘাস কিনে বাড়ি ফেরেন। ঝিনাইদহের শৈলকুপার মধ্যপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী মানিক মিয়া ২০০৮ সাল থেকে ঘাস বিক্রি করে আসছেন। প্রতিদিন অন্তত চার ভ্যান ঘাস বিক্রি করেন। ফাজিলপুর মোড়, কবিরপুর, দুধবাজার, মধ্যপাড়া, তিনরাস্তার মোড়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে সকাল-সন্ধ্যা ঘাস বিক্রি হচ্ছে।

ভ্যানগাড়ি বা বিভিন্ন বাহনে ফেরি করেও বিক্রি হচ্ছে ঘাস। প্রত্যেক বাজারে কমপক্ষে ১০-১৫টি পয়েন্টে সকাল থেকে রাত অবধি ঘাস কিনতে পাওয়া যায়। বেকারত্ব ঘোচাতে ঘাসের ব্যবসায় নেমে পড়েছেন অনেকে। শহরতলি এলাকার ক্ষেত থেকে ২-৩ টাকা আঁটি দরে ঘাস কিনে বিক্রি করেন ৫ থেকে ১০ টাকা আঁটি। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ আঁটি ঘাস বিক্রি হয় বলে জানান শৈলকুপার ঘাস ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান। 

ঘাসের বাণিজ্যিক উৎপাদনও আশাতীত সাফল্যের মুখ দেখছে। সবজি, খাদ্যশস্যসহ নানা ফসলের পাশাপাশি কৃষক ও খামারিরা ঘাস চাষ করছেন। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আবাদ করা ঘাস আশপাশের জেলা এমনকি সাভার, ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ছোট কামারকুণ্ডু গ্রামের যুবক নাজমুল হোসেন সবুজ ১৪ বছর আগে ১০ কাঠা জমিতে প্রথমে ঘাস চাষ শুরু করেন। লাভজনক হওয়ায় এখন তার আট বিঘা জমিতে ঘাসের চাষ। জেলা শহরের হামদহ, মডার্ন মোড়, আরাপপুরসহ কয়েকটি স্থানে ঘাস বিক্রি করেন। আবার জমি থেকেও পাইকার-ব্যবসায়ীরা ঘাস কিনে নিয়ে যান। নাজমুল জানান, তার ঘাস ঢাকার সাভারের বিভিন্ন খামারে এবং চিড়িয়াখানায় হরিণের খাদ্য হিসেবেও বিক্রি হয়। তার দেখাদেখি জেলার অনেকেই এখন ঘাস চাষ করছেন।

বর্তমানে খৈল, ভুসি আর বিছালির দাম আকাশছোঁয়া। এসব বিবেচনায় তাজা নেপিয়ার পাকচং ঘাস পশুপালনকারীদের কাছে বেশি পছন্দের। অন্যদিকে গাভি পালনকারীরা বেশি দুধ পাওয়ার আশায় সবুজ ঘাসকেই গোখাদ্য হিসেবে বেছে নেন। কম পরিশ্রম ও কম পুঁজিতে ঘাস উৎপাদনে বেশি লাভ হয়। তাই গরুর খামারের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘাস চাষ করছেন অনেকে।

ঝিনাইদহ সদরের প্রত্যন্তপল্লী বাদপুকুরিয়া গ্রামের নারী উদ্যোক্তা আম্বিয়া খাতুন লাকী বলছিলেন, গরু পালন আর খামারের জন্য ঘাসের কোনো বিকল্প নেই। তিনি ছয় বিঘা জমি লিজ নিয়ে নেপিয়ার, পাকচংসহ তিন জাতের ঘাস চাষ করছেন গরুর খাবারের জন্য। তার খামারে এখন আড়াইশ থেকে তিনশ লিটার দুধ উৎপন্ন হয়।

জেলার শৈলকুপা উপজেলার পৌর এলাকার যুবক মাজেদুল হক মিঠু এইচএসসি পাসের পর চাকরির আশায় না থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন। শুরুতে কলার চাষ করলেও একসময় গরুর খামার করেন। দেড় লাখ টাকা পুঁজিতে মাত্র তিনটি গাভি কিনে শুরু হয় স্বপ্নযাত্রা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন তার খামারে সংকর জাতের গাভির সংখ্যা ৩০। আম্বিয়া খাতুন লাকীর মতো মাজেদুল হক মিঠুর খামারের গল্পেও ঘুরেফিরে গরুর খাবার হিসেবে আসে ঘাসের কথা। পুষ্টিমান বিবেচনায় উন্নত জাতের ঘাস ছাড়া গরুর খামার কল্পনাতীত বলে জানান তিনি।

শৈলকুপার কবিরপুরের আব্দুল খালেক একজন কৃষক ও খামারি। তার বাড়িতে কয়েকটি গাভি ও বাছুর রয়েছে। আগে তিনি গরুকে খড় খেতে দিতেন। এখন গাভির খাবার হিসেবে উন্নত জাতের ঘাস চাষ করছেন। ঘাস কাটার জন্য মেশিনও কিনেছেন। আব্দুল খালেকের মতো শৈলকুপাসহ জেলার অনেক কৃষকও ঘাস কাটার মেশিন কিনছেন। 

শৈলকুপা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মামুন খান জানান, কাঁচা ঘাস দিলে গরু পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন পায়। ফলে সর্বোচ্চ দুধ দেয় গাভি। আগে কৃষকরা দেশি জাতের গরু পালন করলেও, এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উন্নত প্রজাতির সংকর জাতের গাভি পালন করেন। ফলে ঘাসের চাহিদা বেড়েছে। ঘাস চাষে শৈলকুপা এখন উদ্বৃত্ত উপজেলা, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাটবাজারে ঘাস বিক্রি হচ্ছে, যাচ্ছে জেলার বাইরেও।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মনোজিত কুমার মন্ডল জানান, উন্নত জাতের নেপিয়ার পাকচং একটি হাইব্রিড, দ্রুত বর্ধনশীল এবং উচ্চ উৎপাদনসম্পন্ন ঘাস। এটি গবাদিপশুর জন্য অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন সুস্বাদু ও মিষ্টি প্রকৃতির ঘাস। শীতকাল বা রবি মৌসুমেই গোখাদ্যের সংকট হয় বেশি। তাই সবুজ ঘাস প্রক্রিয়াজাত করে সারা বছর খাওয়ার উপযুক্ত করতে ঝিনাইদহে ঘাস সাইলাইজ বা সংরক্ষণ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে।

ঝিনাইদহ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মনোজিত কুমার সরকার জানান, ঝিনাইদহ জেলায় মোট ৬৩৭ একর জমিতে ঘাস চাষ হয়। বছরে গড় উৎপাদন ২৫ হাজার ২৮৯ মেট্রিক টন। উৎপাদিত ঘাসের দাম ১০ কোটি ১১ লাখ ৫৬ হাজার টাকার ওপরে। জেলায় ছয় শতাধিক ডেইরি ফার্মসহ ছোট ছোট চার হাজার গরুর খামার রয়েছে। 

অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও ঘাস চাষকে খুবই ইতিবাচক দেখছেন। তারা বলছেন, অনাবাদি, পতিত জমি চাষের আওতায় আসছে। এর মাধ্যমে চাষিরা বাড়তি আয় করতে পারছেন। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘাসের বেচাকেনাসহ সবুজ ঘাস থেকে পরিবেশবান্ধব বিশুদ্ধ অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আজগর আলী। 

নেপিয়ার পাকচংসহ এ জাতের ঘাস রোপণের তিন মাসের মাথায় কাটার উপযোগী হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে একই গোছা (গোড়া) থেকে চারা গজায়। সেক্ষেত্রে ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে কাটার উপযোগী হয়। একটি গোছা থেকে ১২-১৫ কেজি ঘাস হয়। একটি গরুর জন্য প্রতিদিন ১৫-১৬ কেজি ঘাস প্রয়োজন হয়। একবার রোপণ করলে তিন-চার বছর ঘাস পাওয়া যায়। ফলে খরচ কম হয়। আবার মৌসুমি, একবর্ষী চাষও করা যায়। 

প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্যমতে জমি চাষ, ঘাসের বীজ বা কাটিং সংগ্রহ, সেচ-সার, শ্রমিক খরচসহ প্রতি বিঘা জমিতে প্রথম তিন মাসে ২০ হাজার টাকা ব্যয় করলে ঘাস কাটা ও বিক্রির উপযোগী হয়ে যায়। পরেরবার থেকে প্রতি কাটিংয়ে গড়ে ১১ হাজার টাকা খরচ হয়, দেড় মাস অন্তর এভাবে ছয়বার ঘাস কাটা যায়। আর প্রতিবার আট টন করে বছরে এক বিঘা জমিতে ৪৮ টন ঘাস উৎপাদন হয়। স্থানীয় বাজারে গড়ে ৪ টাকা কেজি দরে ১ লাখ ৯২ হাজার থেকে প্রায় ২ লাখ টাকার ঘাস বিক্রি করা যায়। ৭৯ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ বাদে বছরে নিট আয় হয় ১ লাখ ১৩ হাজার টাকার বেশি।

জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের মতে, মাথাপিছু আড়াইশ মিলিগ্রাম দুধের চাহিদা অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর ১৫৬ লাখ মেট্রিক টন দুধ দরকার, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১৩০ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ প্রতিবছর ২৬ লাখ মেট্রিক টন দুধের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। কাঁচা ঘাসের উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্যামিতিক হারে দুধের উৎপাদনও বাড়তে থাকে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চলার পাশাপাশি দুধ উৎপাদনেও বাংলাদেশ অচিরেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা