ঠাকুরগাঁও প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:৫০ এএম
আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:২২ পিএম
ঠাকুরগাঁওয়ে টাংগন নদী ভরাট করে ধানের চারা রোপণ। প্রবা ফটো
দেশের উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও। জেলার ভৌগলিক সীমানায় রয়েছে ১১টি নদী। জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে টাংগন নদী ও শুক বা সোজ নদী। এই টাংগন নদী আবার বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। যে নদী এক সময় ছিল প্রমত্তা তা এখন অনেকটা শূন্যতায় পরিণত হয়েছে। এই দুই নদী শুকিয়ে কিছু কিছু জায়গায় জেগে উঠেছে ছোট ছোট চর। সেখান থেকে মাটি কেটে ভরাট করা হচ্ছে নদীর অপর প্রান্ত। পাশাপাশি করা হচ্ছে চাষাবাদ।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ সালে টাংগন, শুক ও লাচ্ছি নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৪ কোটি ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৭০০ টাকা। চুক্তিতে ছিল টাংগন নদীর ৩৫ কিলোমিটার খনন। দুই পাড়ে এক লাখ পাঁচ হাজার বর্গমিটার এলাকায় ঘাস ও সাত হাজার গাছের চারা রোপন। খনন, ঘাস ও বৃক্ষ রোপনের কাজটি পায় ঢাকার তাজুল-নিয়াজ জেভি নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি নদী খননের কাজটি উদ্বোধন করেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন। প্রকল্পটি ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হয় ২০২২ সালের শেষ দিকে।
স্থানীয়রা জানান, টাংগন নদী খননের মাত্র ছয় মাসের মাথায় আবারও তা ভরাট হয়ে গেছে। ফলে কিছু কিছু জায়গায় চর জেগে ওঠায় অনেকে সেখানে ধান চাষ করছেন। স্থানীয় অনেক পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছেন।
ঠাকুরগাঁও সদর খালপাড়া গ্রামের প্রবীর দাস প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগে মাছ শিকার করতাম। নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে এখন আর আগের মতো মাছ নেই। অনেকে ধান চাষ করছে। এখন রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি।’
বরুনাগাঁও এলাকার বজলু হক বলেন, ‘নদী থেকে মাছ শিকার করে পরিবারের খরচ মেটাতাম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে নদীতে কোনো মাছ পাওয়া যায় না। খননের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। মাছ শিকার বাদ দিয়ে মানুষের বাসায় কাজ করছি।’
নারগুন ইউনিয়নের কৃষক কুদ্দুস আলী বলেন, ‘নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করতাম। এখন নদীতে পানি হাটু সমান। পানি কমে আসায় কৃষিকাজে তা আর ব্যবহার করা যায় না। নদীটা খনন করা হলে আমাদের উপকার হবে। আমাদের অনেক খরচ কমবে।’
এদিকে শুক বা সোজ নদী ভরাট করে ধান রোপণ করছেন অনেকে। রোড খানকা এলাকায় ধান রোপণ করার সময় কথা হয় আবু নুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বালুতে চর জেগেছে। তাই ধান চাষ করছি। অনেকেই করছে। কেউ বাধা দেয়নি।’
একইভাবে টাংগন নদীর পাশে মাটি দিয়ে ভরাট করে ধানের চারা রোপণ করছেন মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘নদীটা খনন করা হয়েছিল। আবার ভরাট হয়ে গেছে। চরে আমি ধান রোপণ করছি। প্রতিবছর ধান চাষ করি। ধান ভালোই হয়। কেউ কোনো কখনো বাধা দেয়নি।’
এভাবে নদী ভরাট না করে পুণঃখননের দাবি জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঠাকুরগাঁও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনসুর আলী। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘নদীগুলো আবার খনন করা উচিৎ। নদীকে তার পূর্বের প্রমত্তা ফিরিয়ে দেওয়া হোক। নদী ভরাট করে চাষাবাদ বন্ধ করা প্রয়োজন।’
ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের সভাপতি মনসুর আলী বলেন, ‘খনন করলে নদীর নাব্যতা ফিরে আসবে। এতে এলাকার পরিবেশ ফিরে পাবে পূর্বের রূপ।’
নদী দখলের বিষয়ে অবগত রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র আঞ্জমান আরা বেগম বন্যা বলেন, ‘শহরের কোল ঘেঁষে গেছে টাংগন ও শুক নদী। ছোটবেলায় এগুলো অনেক গভীর দেখেছি। টাংগন নদী খনন করা হয়েছিল। কিন্তু তা আবার ভরাট হয়ে গেছে। পুনঃখনন না করায় অনেকে দখল করে চাষবাদ করছেন। নদী এখন ফসলের ক্ষেতে পরিণত হয়েছে।’
নদীগুলো পুনঃখননের আশ্বাস দিয়েছেন ঠাকুরগাঁও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নদী দখল করে চাষাবাদের বিষয়টি শুনেছি। সেগুলো খুব শিগগির দখলমুক্ত করা হবে। পুনঃখনন করা হবে। নদীগুলো পূর্বের রূপে ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি।’
দখলমুক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মাহাবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দখল হওয়া জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। নদী রক্ষায় সরকারের নানামুখী পরিকল্পনা রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে পুণরায় নদীগুলো খননের কাজ শুরু করা হবে।’