ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:৫৫ পিএম
আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:০১ পিএম
দুই মাসে কৃষকদের কাছ থেকে এক ছটাক ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি ময়মনসিংহ খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। সরকারি গুদামে ধান নিয়ে আসছেন না কৃষক। খুলনা ও বগুড়া জেলাতেও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। তারপরও নিজেদের সফল দাবি করছেন এসব কর্মকর্তা। আবার কালো তালিকা থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে লোকসানে চাল দিচ্ছেন মিল মালিকরা। যদিও খোলাবাজারে দাম বেশি পাচ্ছেন বলে মিলমুখো হচ্ছেন না সাধারণ কৃষক।
সরকার ২০২২-২৩ আমন মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজিতে ধান ও ৪২ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল সংগ্রহ শুরু করে গত ১০ নভেম্বর। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭০ শতাংশ, ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ৯০ শতাংশ ও ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শতভাগ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ধানের ব্যাপারে লিখিতভাবে না হলেও মৌখিকভাবে একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে ৩ লাখ মেট্রিক টনের বিপরীতে ধান সংগ্রহ হয়েছে ১ হাজার ২৬৮ মেট্রিক টন। সংগ্রহের হার শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। একই সময়ে সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ মেট্রিক টন। সেখানে সংগ্রহ হয়েছে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৭৮১ মেট্রিক টন। সংগ্রহের হার ৩৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, মূলত বাজার ব্যবস্থা ধরে রাখতে এ সংগ্রহ অভিযান চলে। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে ধান। তবে চাল সংগ্রহ করে মিলারদের কাছ থেকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ৫৯ লাখ ৮৬ হাজার টন।
ময়মনসিংহ জেলা খাদ্য নিন্ত্রয়ক কার্যালয়ের প্রধান ইকবাল বাহার চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, কৃষকরা সরকারি দামের চেয়ে খোলাবাজারে বেশি দামে ধান বিক্রি করছেন। সেজন্য তারা সরকারি গুদামে আসছেন না। আমরা সব রকমের প্রচার চালিয়েছি, কিন্তু কৃষকদের সাড়া নেই।
খুলনা জেলা খাদ্য নিন্ত্রয়ক কার্যালয়ের প্রধান মো. তাজুল ইসলামও একই ধরনের কথা বলেন। তিনি বলেন, সরকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রে আমরা সফল। কেননা বাজারে আমাদের চেয়ে বেশি দামে ধান বিক্রি করতে পারছেন কৃষক।
সরকারি গুদামে কেন ধান দেন না- এমন প্রশ্নের উত্তরে ময়মনসিংহ জেলার কৃষক মতিউর রহমান বলেন, সরকারি দামের চেয়ে খোলাবাজারে বেশি দাম পাওয়া যায়। মণপ্রতি সরকার দিচ্ছে ১ হাজার ২২০ টাকা আর খোলাবাজারে মিলছে ১ হাজার ৪০০ টাকার বেশি। পার্থক্য প্রায় ২০০ টাকা। তা ছাড়া গুদামে ধান নিলে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অনেক সময় ধান নেওয়া হয় না। আমরা চাই ঝক্কিঝামেলা এড়াতে। আমরা ধান কাটার পরপরই বিক্রি করে দেই, কিন্তু সরকার ধান কিনতে শুরু করে অনেক পরে।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার জানান, তারা কালো তালিকা থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে সরকারি গুদামে চাল দিচ্ছেন। প্রতি কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা লোকসান যাচ্ছে তাদের। কেননা হাস্কিং মিলে প্রতি ৬০ কেজি ধানে খরচ হয় ৯০ টাকা, কিন্তু অটোতে খরচ হয় ১২০ টাকা। বর্ষা মৌসুমে এক মণ ধানে ২০ কেজি ও আমন মৌসুমে ২৬ কেজি চাল হয়।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. রায়হানুল কবির জানান, রাজশাহী বিভাগে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ হাজার ৭৬৪ মেট্রিক টন। তারা সংগ্রহ করেছে ৬ মেট্রিক টন। সংগ্রহের হার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫ হাজার ২৩৭ মেট্রিক টন। সংগ্রহের হার ৩৭ দশমিক ২৯ শতাংশ। রংপুর বিভাগের ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬২ হাজার ৩৪৪ মেট্রিক টন; হয়েছে ৩ মেট্রিক টন। সংগ্রহের হার শূন্য দশমিক শূন্য শতাংশ। চালের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ২৫৪ মেট্রিক টন; হয়েছে ৭৮ হাজার ৪২৪ মেট্রিক টন। সংগ্রহের হার ৬৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার ৯৭১ মেট্রিক টন; হয়েছে ১৯ মেট্রিক টন। এখানে সংগ্রহের হার শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ। সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ হাজার ১৫২ মেট্রিক টন; হয়েছে ১১ হাজার ২৩ মেট্রিক টক। সংগ্রহের হার ২২ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
ময়মনসিংহে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩১ হাজার ২৭৬ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু এক ছটাকও সংগ্রহ হয়নি। চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা যেখানে ৭৫ হাজার ৫১০ মেট্রিক টন ছিল, সেখানে হয়েছে ২৩ হাজার ৪৮ মেট্রিক টন। সংগ্রহের হার ৩৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। খুলনায় ৪০ হাজার ৪৬৯ মেট্রিক টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ধান সংগ্রহ হয়েছে ১ মেট্রিক টন। সংগ্রহের হার শূন্য দশমিক শূন্য শতাংশ। চালের লক্ষ্যমাত্রা ৬৫ হাজার ৮৬০ মেট্রিক টনের বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ২৩ হাজার ৫১২ মেট্রিক টন বা ৩৫ দশমিক ৭০ শতাংশ।
চট্টগ্রামে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৪২ হাজার ৭২১ মেট্রিক টনের বিপরীতে হয়েছে ১০৩ মেট্রিক টন। সংগ্রহের হার শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ। চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা যেখানে ৫০ হাজার ১৮ মেট্রিক টন, সেখানে হয়েছে ১৩ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন বা ১৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সিলেটে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ২০ হাজার ৭১৩ মেট্রিক টন; হয়েছে ৭১০ মেট্রিক টন বা ৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ হাজার ৯৫৪ মেট্রিক টন; হয়েছে ২ হাজার ৩৮১ মেট্রিক টন বা ১৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এ ছাড়া বরিশালে ধানের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার ৭৪২ মেট্রিক টনের বিপরীতে হয়েছে ৩৪৬ মেট্রিক টন। অর্জনের হার ১ দশমিক ১৩ শতাংশ। সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ হাজার ১৫ মেট্রিক টন। সংগ্রহ করেছে ৩ হাজার ৬২৫ মেট্রিক টন বা ১৬ দশমিক ১১ শতাংশ।
সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক বলেন, সারা দেশে সার্বিকভাবে ধান সংগ্রহ হয়েছে শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। চাল সংগ্রহ হয়েছে ৩৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ে পূরণ হবে। ২০২২-২৩ মৌসুমের আমন সংগ্রহের জন্য দেশের ৭ হাজার ৯৪টি চালকলের মালিকের সঙ্গে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন চাল কেনার চুক্তিও করা হয়েছে। কৃষক বাজারমূল্য বেশি পাচ্ছেন, এটিই বড় ব্যাপার। তারা সরকারি গুদামে ধান-চাল দিক আর না দিক ন্যায্যমূল্য তো পাচ্ছেন সেটিই কাম্য।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ মৌসুমে ৬ লাখ ২৬ হাজার ৯৯১ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সংগ্রহ হয় ৬ লাখ ২৬ হাজার ৬৫৭ মেট্রিক টন। দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৬ টাকা কেজি। সিদ্ধ চালের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৬১৮ মেট্রিক টন। সংগ্রহ হয় ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪০৭ মেট্রিক টন। দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৬ টাকা কেজি। আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৩ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। সংগ্রহ হয় ৪৩ হাজার ৪০১ মেট্রিক টন। দাম ছিল ৩৫ টাকা কেজি।
বগুড়ায় ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয় ২৯ নভেম্বর। ১ হাজার ২২২ মেট্রিক টন ধান এবং ২৬ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চাল সংগ্রহের জন্য ৬৮৫টি মিলের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ১ মেট্রিক টন ধান ও ৮ হাজার ৬৮৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। সুনামগঞ্জেও একই চিত্র দেখা গেছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন যশোর সংবাদদাতা রিপন হোসেন চঞ্চল, সুনামগঞ্জের সাইদুর রহমান আসাদ, বগুড়ার মোহন আখন্দ ও নওগাঁর এম আর ইসলাম রতন।