ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:৫৭ এএম
আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:১৪ পিএম
দেশের তরুণরা কৃষিকাজে আগ্রহী হচ্ছেন। ফাইল ফটো
চাকরির পেছনে না ঘুরে উদ্যোক্তা হয়েছেন আব্দুল জব্বার। গড়ে তুলেছেন গরু ও পোল্ট্রি খামার। পাশাপাশি করছেন জমি চাষও। স্নাতক পাস এই তরুণ এখন পুরোদস্তুর একজন কৃষক।
আব্দুল জব্বার জানান, প্রতিবছর কোরবানির ঈদের সময় তিনি ৭-৮টি ষাঁড় বিক্রি করেন। এ সবের গড় মূল্য ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আবাদ করেন শাকসবজিসহ নানা শস্য। কৃষি পেশাতেই প্রতিষ্ঠিত হতে সংগ্রাম করছেন তিনি। ফসলের ন্যায্যমূল্য পেলে অসংখ্য তরুণ কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন বলেও জানালেন তিনি। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তার ভাগ্যের এই গতি।
ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তরুণরা কৃষিবিমুখ, এমনটা জানালেন স্নাতক পাস মো. নুরুল্লাহ নামের একজনও। সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের কথা হয় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদুর রশিদ ভুঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, কৃষকের সন্তান কৃষক হচ্ছেন কি না- সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তরুণদের কৃষিকাজে সম্পৃক্ত করতে হলে সামাজিক মূল্যায়ন, অর্থায়ন ও সার্টিফিকেট দিতে হবে।
২০২৩ সালটি বিশ্বব্যাপী মন্দা ও দুর্ভিক্ষের বছর হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ (এফএও) আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এফএও গত বছরের অক্টোবরে এক প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বের ৪৫টি দেশে খাদ্য ঘাটতিজনিত খাদ্য মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা রয়েছে। এশিয়া মহাদেশের নয়টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও।
এসব আশঙ্কাকে আমলে নিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তরুণদের কৃষিমুখী করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষ তহবিলও করেছেন বলে জানান তিনি। জাতীয় পর্যায়ে একটি তথ্যভান্ডার প্রস্তুত করতে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরকে।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজহারুল ইসলাম খান জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডেটাবেজ তৈরিতে হাত দেওয়া হয়েছে। আমাদের অধীনে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রায় ৬৮ লাখ তরুণের ডেটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। নভেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত ৫০ হাজার তালিকা করা হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হবে জুনে।
তিনি আরও জানান, শুধু কৃষি খাতে কর্মসংস্থান তৈরির ব্যাপারে আলাদা ডেটাবেজ করতে এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি। এর মধ্যে মৎস্য চাষ, কৃষিতে প্রশিক্ষিতদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যুবকদের নিয়ে দেশের ১৪টি মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে কাজ করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ তালিকা তৈরি করবে।
যুব উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রশিক্ষণের বাইরেও রয়েছে অসংখ্য যুবক। সাধারণত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের যুবক হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার হিসাবে, যুবাদের সংখ্যা ৪ কোটি ৫৯ লাখ; যা মোট জনশক্তির প্রায় চার ভাগের এক ভাগ।
এসব তরুণকে কৃষিমুখী করতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, আগ্রহী তরুণদের কৃষি খাতে যুক্ত করতে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রণোদনা দিতে হবে। স্বল্প সুদে অথবা সুদহীন ঋণ দিতে হবে।
ডেটাবেজ তৈরি সম্পর্কে তিনি বলেন, একটি ওয়েবসাইট খুলে তাতে প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্র, শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটের নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। ষষ্ঠ জনশুমারির তথ্য-উপাত্তগুলোও যুক্ত করা যেতে পারে। ৫-৬ বছর আগে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে চলে গেছেন, তাদের তথ্য প্রশাসনের কাছে আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, ‘দেশে শিক্ষিত বেকার তরুণদের সঠিক ডেটা নেই। তাই ডেটাবেজ তৈরিতে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। সরকার যেকোনো টাকাই দিক না কেন সেটি সেন্ট্রাল ডেটা সিস্টেমে আপলোড করলেই সবাই তথ্যটা পাবে। জানতে পারবে অর্থগুলো কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, এ ব্যাপারে অনেকদিন ধরে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে আহ্বান করে আসছি। কিন্তু কোনো কাজ দেখছি না। এটি করা দরকার। সঠিক তথ্য বা ডেটাবেজ না থাকলে অর্থায়ন কোথায় করা হবে, কাদের করা হবে?
শিক্ষিত তরুণদের কৃষি খাতে উদ্বুদ্ধ করতে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানের তহবিলটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার জানান, তহবিল গঠনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট বিষয়। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নির্দেশনা পায়নি।
তরুণদের ঋণ দেওয়া সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, গম ও ভুট্টা চাষে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে পুনঃঅর্থায়নের স্কিম গঠন করা হয়েছে। সেখানে তরুণদের অগ্রাধিকার রয়েছে।
মূলত জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশন থেকে দেশে ফিরে গত বছরের ৬ অক্টোবর বৈশ্বিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় তরুণদের কৃষিমুখী করার বিষয়টি উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীকালে ১ নভেম্বর ‘জাতীয় যুব দিবস-২০২২’-এর অনুষ্ঠানে বিস্তারিত জানান তিনি। এদিন তিনি বলেন, বৈশ্বিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষিত যুবশ্রেণি গড়ে তোলা একান্তভাবে অপরিহার্য। দেশে এখন কত প্রশিক্ষিত যুবশ্রেণি রয়েছে তার একটি ডেটাবেজ তৈরির প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। যুবসমাজের শক্তিকে কাজে লাগাতেই ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ স্লোগান রাখা হয়।