ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫ ০৯:০২ এএম
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রথমেই ক্ষতির মুখে পড়েন প্রান্তিক কৃষকরা। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা কিংবা শিলাবৃষ্টির মতো দুর্যোগে ফসলহানি যেন নিয়মিত ঘটনা। তাদের জন্য সরকার নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ খুবই সামান্য। তারপরও কৃষকদের হাতে পৌঁছে না পর্যাপ্ত সহায়তা। ফলে অনেক সময় চাষাবাদের খরচই ওঠে আসে না।
ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা নিয়ে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে। কৃষকদের অভিযোগ, সরকার বছরে হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিলেও প্রান্তিক কৃষকের প্রকৃত ক্ষতির জন্য কোনো স্বচ্ছ ও কার্যকর ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার কৃষক শাহজাহান হোসেন তার দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু গত বছর অকালবৃষ্টি ও উজানের ঢলে তার এক বিঘা জমি টানা এক সপ্তাহ পানির নিচে থাকায় ধান পচে নষ্ট হয়ে যায়। অপর বিঘার ফলনও আশানুরূপ হয়নি।
শাহজাহান হোসেন জানান, তার মতো অনেক কৃষক ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়লেও সরকার থেকে তেমন কোনো সহায়তা পাননি। যারা পেয়েছেন, তারা মাত্র ৫ কেজি বীজ আর ২০ কেজি সার পেয়েছেন। এটা কোনো সাহায্য না, এটা একটা সান্ত্বনা মাত্র, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রথমেই ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষক। কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না। অনেক সময় চাষাবাদের জন্য ঋণ নিতে হয়। দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলে সেই ঋণ শোধ করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় এক বছরে ৬ লাখ কোটি টাকার ফসলহানি-
২০২৪ সালে ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের মতো চার দফা বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের কৃষি খাত ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাঠের ফসল থেকে শুরু করে ফলমূল ও সবজিসহ বিভিন্ন উৎপাদনে এই বিপর্যয়ে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ১৩ হাজার ৫০ দশমিক ৯৮ কোটি টাকা। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ২৫ লাখের বেশি কৃষক।
প্রথম ধাপ : ২০২৪ সালের ২৬-২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টিতে ৫০টি জেলা আক্রান্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ প্রায় ৬২ হাজার ৭৮৩ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রয়েছে আউশ, বোরো, আমন, শাকসবজি, পাট, তিল, মুগ, আদা, হলুদ, ফলমূল, ফুল প্রভৃতি। এতে ফসলহানি হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ৫১৯ মেট্রিক টন। আর ৫ লাখ ৩৭ হাজার ২৩৪ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৯৫০ দশমিক ৯৮ কোটি টাকা।
ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, জামালপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরিয়তপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা।
দ্বিতীয় ধাপ : ১৯–২৩ জুন অতিবৃষ্টি ও উজান (ভারত) থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধায় ২৩ হাজার ৬৩১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এসব জমিতে আউশ, বোনা আমন, আউশ বীজতলা, শাকসবজি, চীনাবাদাম, পাট, রোপা আমনের বীজতলা, মরিচ, তিল ও চীনা ফসল ছিল। এসব জমির ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪৯৯ মেট্রিক টন ফসল নষ্ট হয়। এতে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৫৯ জন কৃষকের ৪৬ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
তৃতীয় ধাপ : ১৬-৩০ আগস্টের অতিবৃষ্টি ও উজান (ভারত) থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ২৩টি জেলা আক্রান্ত হয়। জেলাগুলো হলোÑ নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, নাটোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট ও যশোর। ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। এসব জেলায় আউশ আবাদ, রোপা আমন আবাদ, বোনা আমন, রোপা আমন বীজতলা, শাকসবজি, আদা, হলুদ, আখ, পান, ফলবাগান (কলা ও অন্যান্য), মরিচ, তরমুজ, পেঁপে, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, মুখিকচুর আবাদ ছিল। তাতে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৫১৪ মেট্রিক টন ফসলের ক্ষতি হয়। তাতে ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৮৯ জন কৃষকের ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
চতুর্থ ধাপ : ২৪ সেপ্টেম্বর-১৫ অক্টোবর পর্যন্ত অতিবৃষ্টি ও উজান (ভারত) থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ১৩টি জেলা আক্রান্ত হয়। জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোণা, নীলফামারী, চাঁদপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ। এসব জেলায় ৮২ হাজার ২৩১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জমিগুলোতে রোপা আমন, শাকসবজি, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজতলা, মরিচ, চীনাবাদাম, মাষকলাই, কলা, পেঁপে, আখ, বস্তায় আদা চাষ ও সুলটি কলাই ছিল। জমিগুলোতে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৬৪৪ মেট্রিক টন ফসলের ক্ষতি হয়। সেখানে ৩ লাখ ৯১ হাজার ৫৬০ জন কৃষকের ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। সব মিলিয়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৩ হাজার ৫০ দশমিক ৯৮ কোটি টাকা।
সরকারি অনুদানের পরিমাণ কত-
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকার সীমিত আকারে অর্থ ও উপকরণ দিয়ে থাকে, যা অনেক সময় প্রকৃত ক্ষতির তুলনায় খুবই সামান্য। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনে মূলত বীজ, সার এবং স্বল্প পরিমাণ নগদ অর্থ সহায়তাই দেওয়া হয়, যা প্রাথমিক পুনরুদ্ধারে কিছুটা ভূমিকা রাখলেও কৃষকের পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট নয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য রোপা আমন ধানের বীজ ও সার বাবদ অর্থ মন্ত্রণালয় ২৬ কোটি ১১ লাখ ৫২০ টাকা ছাড় দেয়। এতে ২ লাখ ২৭ হাজার ৭০৪ জন কৃষককে ৫৫ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি ধান বীজ, ১৯ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি ডিএপি সার এবং ১৮ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি এমওপি সার দেওয়া হয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ সেপ্টেম্বর খরিপ-২ মৌসুমে পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় শীতকালীন সবজির বীজ ও নগদ অর্থ সহায়তার জন্য ৬১৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে উপকৃত হয় ১ লাখ ৫০ হাজার কৃষক। একই অর্থবছরে ১ অক্টোবর বোরো ধানের (হাইব্রিড) জন্য এবং ১৬ অক্টোবর উফশী জাতের বোরো ধানের জন্য আলাদাভাবে আরও ৬১৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা করে ছাড় দেওয়া হয়।
অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তায় ৩ নভেম্বর আরও ৬১৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা পুনর্বাসন সহায়তা দেওয়া হয়, যার আওতায় ৯৪ হাজার প্রান্তিক কৃষক সবজির বীজ এবং ১ লাখ ২০ হাজার কৃষক সরিষার বীজ পান।
এই সহায়তা সম্পর্কে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, ‘আমরা কৃষি পুনর্বাসন বা প্রণোদনা দিয়ে থাকি। পুনর্বাসনের আওতায় কৃষককে ৫ কেজি বীজ, ২০-৩০ কেজি সার এবং পরিবহনের জন্য কিছু অর্থ দেওয়া হয়। আর প্রণোদনার ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জনপ্রতি এক থেকে দেড় হাজার টাকা দেওয়া হয়।’
তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘সব কৃষককে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয় না। যেসব এলাকায় প্রকৃত ক্ষতি হয়, সেসব এলাকায় নির্দিষ্ট সংখ্যক কৃষক এই সহায়তা পান।’ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনরায় উৎপাদনে ফেরাতে আরও বড় পরিসরের অর্থায়নের প্রয়োজন থাকলেও তা বাস্তবায়নে সরকারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সময় এসেছে ক্ষতিপূরণ শব্দটি কেবল সরকারি ফাইলে নয়, কৃষকের হাতে বাস্তব সমর্থন হয়ে পৌঁছানোর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি বিবেচনায় নিয়ে কৃষি বীমা, আধুনিক তথ্যভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং মোবাইলভিত্তিক ক্ষতিপূরণ বিতরণের ব্যবস্থা করা দরকার।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য সরকারের ‘কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা’ কার্যক্রম থাকলেও তা কার্যকরভাবে কৃষকের পুনরুদ্ধারে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, এই সহায়তা কার্যক্রমে বীজ, সার ও কিছু নগদ অর্থ দেওয়া হয়, কিন্তু সেটি অত্যন্ত সামান্য। এ সহায়তা দিয়ে কৃষকের প্রকৃত ক্ষতির সামান্য অংশও পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের ক্ষয়ক্ষতির যথাযথ হিসাব বর্তমানে মাঠপর্যায়ে তোলা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এখন সময় এসেছে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ানোর। শুধু প্রতীকী সহায়তা নয়, কৃষক যেন পুনরায় উৎপাদনে ফিরতে পারেন, সেই সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা প্রয়োজন।
বীমা কাঠামোর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, অনেকে কৃষি খাতে বীমা চালুর কথা বলছেন, এটি নীতিগতভাবে ভালো উদ্যোগ হতে পারে। তবে বাস্তবে বেসরকারি খাত এতে আগ্রহ দেখাবে না, কারণ এ খাতে ঝুঁকি অনেক বেশি। অন্যদিকে অনেক প্রান্তিক কৃষকই প্রিমিয়ামের টাকা বহন করতে পারবেন না।
এ অবস্থায় তিনি পরামর্শ দেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে, একে কমানো সম্ভব নয়। তাই কৃষিকে দুর্যোগ-সহনশীল কৃষিতে রূপান্তর করতে হবে। এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দুর্যোগ সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন অত্যাবশ্যক।
বন্যা বা খরা সহনশীল ধানের জাত, লবণাক্ততা সহনশীল সবজির জাতÑ এসব উদ্ভাবন এবং বিস্তারে নজর দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে কৃষকের টিকে থাকার উপায় এটাইÑ বলেন অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের শুধু নগদ সহায়তা নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দরকার বলে মনে করেন একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে কৃষি বীমা, ঋণ ছাড়, ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ, আধুনিক চাষ প্রযুক্তি এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা। সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে, যেন কৃষকরা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে।