সারোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:১৯ এএম
প্রবা ফটো
জামালপুরের সরিষাবাড়ীর তারাকান্দির দৌলতপুর গ্রামের প্রান্তিক এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য প্রকৃতি রাজ্য- ‘দ্বিজেন শর্মা উদ্যান’। পৈতৃক ১২ বিঘা জমিতে বিস্তৃত এই দুর্লভ গাছের অরণ্য গড়ে তুলেছেন হাসমত আলী। তিনি পেশায় একজন কলেজ শিক্ষক। নেশায় বৃক্ষপ্রেমী। প্রায় ৭০০ প্রজাতির গাছগাছালির এই গাছবাড়ি এখন কেবল গাছের শোভা নয়, এটি হয়ে উঠেছে বন্য পাখি, প্রজাপতি ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়।
ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রতি ছিল হাসমত আলীর অকৃত্রিম টান। কৈশোরে নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার লেখা পড়ে তার প্রকৃতিপ্রেম আরও গভীর হয়। সেই শ্রদ্ধা থেকেই প্রিয় নিসর্গীর নামে গড়ে তুলেছেন এই উদ্যান। যেখানে রয়েছে কানাইডিঙ্গা, বৈলাম, উরিআম, কুরচি, কন্যারি, মাইলাম, চালমুগরা, বাঁশপাতা, ডাকরুম, তাসবি, কেরামন, তুন, শিলবাটনা, গুটগুটিয়া, ট্রাম্পেট, কামদেব, রিটা, চিকরাশি, নাগালিঙ্গম, বাওবাব, কর্পূর, উদাল, কুম্ভি, ঢাকিজাম, তানপুরা, সিভিট, হিজল, তমাল, চাপালিশ, হলদু, আগর, শ্বেতচন্দন, রক্তচন্দন, বইট্টা গর্জন, কাইজেলিয়া, মহুয়া, জহুরী চাঁপা, কুসুম চাঁপা, সুলতান চাঁপা, কাঠালি চাঁপা, স্বর্ণ চাঁপা, নাগেশ্বর চাঁপাসহ চেনা এবং নাম না জানা অসংখ্য বিরল গাছ। উদ্যানজুড়ে আনুমানিক ৬ হাজার বৃক্ষ, প্রতিটি গাছের পরিচর্যা চলে নিবিড় ভালোবাসা ও যত্নে।
এখানে লাগানো কোন গাছটি কোথা থেকে নিয়ে এসেছেন, স্মৃতি থেকে সেসব বলে যাচ্ছেন হাসমত আলী। প্রতিটি গাছের উৎস, পরিচর্যা, এমনকি কোন লতা কখন একটু নিচু হয়ে এসেছেÑ সবকিছু তার নখদর্পণে। যেন গাছগুলো তার নিজের সন্তানের মতো। প্রশ্ন করেছিলাম, এত বিশাল এক বাগান গড়তে খরচ কত? হাসিমুখে জানালেন, হিসাব করে লিখিনি, কিন্তু আনুমানিক ২৫ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। জমির দাম ধরিনি, কারণ এটা তো আমার বাপ-দাদার জায়গা।
উদ্যানটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০২২ সালের শুরুতে। কিন্তু তার গাছের প্রতি ভালোবাসা এবং বাগানের অনেক গাছই তার বাড়িতে লাগানো ছিল অনেক আগে থেকে। প্রকৃতি থেকে ক্রমে অনেক গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষণের তাগিদে তিনি এখানে বাগান গড়ে তোলেন। হাসমত আলী গড়ে তোলা বাগানের দুর্লভ বৃক্ষের মধ্যে রয়েছেন।
দুর্লভ, ভেষজ, ম্যানগ্রোভ, প্রায় ২০ প্রজাতির বাঁশ, ৫০ ধরনের অর্কিড, ফুল, ফল, সৌন্দর্যবর্ধক উদ্ভিদ, ক্যাকটাসসহ অসংখ্য বিদেশি ও স্থানীয় ফলদ বৃক্ষ রয়েছে উদ্যানটিতে। তাই তিনি এসব উদ্ভিদকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করেছেন। ছোটবেলা থেকে গাছের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। কৈশোর থেকে তিনি বাড়ির প্রতিটি কোণায় চারা রোপণ করতেন। বাবা মায়ের কাছ থেকে খরচের টাকা নিয়ে কিনে নিয়ে আসতেন গাছের চারা। বাড়ি ভরিয়ে ফেলতেন নানা জাতের গাছগাছালি দিয়ে। গাছ লাগাতেন রাস্তার ধারে। হাসমত আলীর এখানে উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহের জন্য ছোট আকারের একটি হারবেরিয়ামও গড়ে তুলেছেন। এর জন্য তিনি জাতীয় হারবেরিয়াম থেকে প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছেন।
উদ্যানের মধ্যে রয়েছে দুটি ছোট ছোট জলাধার। গুল্মজাতীয় জলজ উদ্ভিদ রয়েছে। সেখানে উদ্যানের পাখিরা জলকেলি করতে পারে। পাখির খাদ্যের জোগান দিতে তিনি রোপণ করেছেন অনেক ফলদ বৃক্ষ। গাছ সংরক্ষণের পাশাপাশি হাসমত আলী উদ্যানের মধ্যে গড়ে তুলছেন একটি প্রজাপতি পার্ক। এ কাজে তাকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন। দ্বিজেন শর্মা উদ্যানের এ প্রজাপতি পার্ক সম্পর্কে কথা হয় অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রজাপতি পরাগায়নে সাহায্য করে, সবুজ বন টিকিয়ে রেখে পরিবেশের বিপর্যয় রোধে ভূমিকা রাখে। প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতা বা সবুজ বনভূমি না থাকার স্বল্পতা দূর করতে প্রজাপতি পরাগায়ন করে বীজ উৎপন্ন করে গাছপালা টিকিয়ে রাখে। এখানে প্রজাপতির জন্য প্রয়োজনীয় শতাধিক গাছের সমাহার ঘটিয়ে এ পার্ক তৈরি করা হয়েছে। প্রজাপতির জন্য হোস্ট প্ল্যান্ট হিসেবে উল্লেখযোগ্য গাছের মধ্যে রয়েছেÑ জবা, নয়নতারা, কসমস, টগর, রঙ্গন, অলকানন্দা, গাঁদা, জুঁই, করবী, মুসেন্ডা, মাধুরীলতা, কামিনী, লেবু, লিচু, কদম, এরিকাপাম, আশ শেওড়া, লজ্জাবতী, ঝুমকোলতা ও আঙ্গুরলতার মতো গুল্ম প্রজাতির প্রায় শতাধিক গাছ। এখানে প্রজাপতির প্রায় ১৫/২০টি প্রজাতি দেখা যায়, যেগুলো পার্শ্ববর্তী পরাগায়নবান্ধব উদ্ভিদের দ্বারা সমর্থিত।
হাসমত আলী প্রজাপতি সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড -২০২১’ এবং দুর্লভ উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য ডিভাইন কেয়ার ফাউন্ডেশন কর্তৃক ‘গ্রিন ক্লাইমেট লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড-২০২৩’ লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি বৃক্ষ গবেষণা, সংরক্ষণ, উদ্ভাবন বিভাগে জাতীয় পুরস্কার-২০২৩ লাভ করেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে হাসমত আলী তার উদ্যান চত্বরে স্বল্প পরিসরে একটি হারবেরিয়াম স্থাপন করেছেন। এখানে তিনি বিভিন্ন উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করেন। বিশেষ করে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ হারবেরিয়াম করে প্রজাতি সংরক্ষণ করবেন।
প্রকৃতিবিষয়ক বইপত্রের প্রতি তার রয়েছে দুর্নিবার টান। সংগ্রহ করেন বৃক্ষ নিয়ে লেখা নানান বইপত্র। উদ্যানকে আরও গতিশীল করার জন্য এখানে গড়ে তোলা হয়েছে হাসনা আব্দুল্লাহ প্রাণ প্রকৃতি পাঠাগার। ২০২১ সালে এ পাঠাগারটির যাত্রা। এই পাঠাগারের অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি প্রাণ-প্রকৃতি, উদ্ভিদ সম্পর্কিত অনেক বই রয়েছে। পাঠক এই পাঠাগারে এসে উদ্ভিদ ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে এবং আগ্রহী করে গড়ে তুলতে পারে। এখানে গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসমত আলী বলেন, ‘পাঠাগারকেন্দ্রিক একটি সংগঠন গড়ে তুলতে চাই। আমাদের গ্রাম তো একদম প্রত্যন্ত এলাকা। এখানে শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ কম। তারপরও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বই পড়তে আগ্রহী করব।’
হাসমত আলী বিশ্বাস বলেন, নতুন প্রজন্ম প্রকৃতি ও সৃজনশীল শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠলে তারা একসময় তার গড়ে তোলা উদ্যানের হাল ধরতে পারবে।