× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

লবণ-ভূমিতে সবুজ বিপ্লব

ফারুক আহমাদ আরিফ, খুলনা থেকে ফিরে

প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৪৪ এএম

আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২৩:০০ পিএম

খুলনার দাকোপ উপজেলার লবণাক্ত জমিতে মাচায় ভিন্ন প্রজাতির তরমুজ চাষ। প্রবা ফটো

খুলনার দাকোপ উপজেলার লবণাক্ত জমিতে মাচায় ভিন্ন প্রজাতির তরমুজ চাষ। প্রবা ফটো

খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইলসহ দেশের সমুদ্র উপকূল ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে লবণাক্ততার কারণে আমন ছাড়া অন্য কোনো ফসল হতো না। অধিকাংশ সময় খালি পড়ে থাকা জমিগুলোয় বর্তমানে বছরজুড়ে শাক-সবজি চাষ করছেন কৃষকরা। এতে নিজেদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারসহ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহরে। বলা চলে, এসব জেলায় কৃষকদের শাক-সবজি চাষে বিপ্লব ঘটেছে।

ইউটিউব দেখে একফসলি ২৮ শতক ধানের জমিতে পলিমালচ পদ্ধতিতে লাউ চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন বাগেরহাট জেলার তরুণ কৃষক প্রণব দাস। তিনি বলেন, একটা সময় বাজারে দোকান ছিল আমার। করোনার সময় লকডাউন চলাকালে দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন প্রথমে ইউটিউব দেখে লাউ চাষ করি। আমাদের এখানে শুধু আমন ধানের চাষ হতো। তারপর সারা বছর পতিত পড়ে থাকত জমি। লাউ চাষ করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই ২০০ থেকে ২৫০টি করে লাউ সংগ্রহ করা যাচ্ছে। সকালে লাউ তুলে বিক্রি করে আবার বিকালে ক্ষেতে গিয়ে দেখা গেছে অন্য লাউও বড় হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় তুলতে না পারলে পরদিন সকালে বড় হয়ে যাবে। তখন সেগুলোও তোলা হতো।

তিনি বলেন, প্রথমে ইউটিউব দেখে চাষ শুরু করলে পরবর্তীতে কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় ক্ষেতের যত্ন শুরু করি। বর্তমানে পলিমালচ পদ্ধতিতে বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করছি। আমার দেখাদেখি অনেকেই এ পদ্ধতিতে চাষ করে সফল হয়েছে। আগে যেখানে অন্য জেলা থেকে শাক-সবজি এনে চাহিদা পূরণ করা হতো, এখন কয়েক বছরের চাষাবাদে উল্টো আমরা নিজেদের ও স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করছি।

পলিমালচ পদ্ধতিতে সবজি চাষ

কোনো কিছু দিয়ে মাটি ঢেকে দেওয়াকে বলা হয় মালচিং। আর যে দ্রব্য দিয়ে ঢাকা হয় তাকে বলে মালচ। যেসব সবজি চাষ করা হয়, সেসব বেডের মাটি ঢেকে দেওয়ার জন্য পলিথিন বা প্লাস্টিক জাতীয় বস্তু ব্যবহার করা হয় তখন তাকে পলিমালচ পদ্ধতি বলা হয়। এ পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম, স্কোয়াশ, বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করা হয়।

এ পদ্ধতি ব্যবহারের উপকার সম্পর্কে বাগেরহাট সদর উপজেলার কৃষক জীবন নারায়ণ বলেন, এতে দু-এক প্রকার ছাড়া কোনো আগাছা জন্মায় না। পানির পরিমাণও লাগে কম। মাটিতে দীর্ঘদিন রস থাকে। লবণাক্ততার প্রভাব থাকে না। সারের পরিমাণও অর্ধেক লাগে। তিন বারের জায়গায় নিড়ানি দিতে হয় একবার। 

সদর উপজেলার জুগিডাঙ্গা গ্রামের কৃষক চয়ন নন্দী বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে ধান ছাড়া কোনো ফসল হতো না। আমি যখন সবজি চাষ শুরু করি তখন সবাই বলেছে, হবে না। তারপর পলিমালচ দিয়ে চাষ শুরু করি। প্রথম দিকে মানুষ পাগল বলত। যখন ভালো ফলন হলোÑ তখন অন্যরা আগ্রহী হয়ে ওঠে। এখন অনেক কৃষক এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। 

তিনি বলেন, সাধারণত বেগুনের গাছ ৩-৪ মাসের মধ্যে মারা যায় কিন্তু এ পদ্ধতিতে চাষ করলে দীর্ঘদিন বাঁচে। গাছের ডালপালা কেটে দিলে আবার নতুন ডাল জন্মায়।

চয়ন নন্দী আরও বলেন, ধান চাষ করলে দেখা যেত আসল টাকাই ওঠানো কষ্ট হয়ে যেত। বর্তমানে সবজি চাষ করে ১০ হাজার টাকা খরচ করলে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিক্রি করা যায়।

বিনা চাষে আলু

খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলায় বিনা চাষে আলু, পেঁয়াজ ও রসুন চাষ করছেন কৃষকরা। সেখানকার কৃষক মনজ কান্তি রায় বলেন, ধান কাটার পর পরিত্যক্ত জমিতে আলু রোপণ করেছি। এখানে কোনো ধরনের চাষ দেওয়া হয়নি। ধান কাটার পরপরই মাটি যখন নরম থাকে তখন আলুর বীজ রোপণ করা হয়। বীজের চারপাশে জৈবসার ও খড় বা লতা-পাতা দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এটি বারি আলু-৭২ প্রজাতির। এই আলুর ফলনও ভালো।

বারি-৭২ প্রজাতির আলুর চাষ সম্পর্কে কৃষি কর্মকর্তা অনুপ কুমার বলেন, লবণাক্ত জমিতে এই আলু আবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। ধান কাটার পর ভেজা জমিতে আলুর বীজ রোপণ করে ঢেকে দিতে হয়। ঢেকে দেওয়ার কারণে মাটির আর্দ্রতা ঠিক থাকে ও সূর্যের আলো না পড়ায় লবণাক্ততাও বাড়ে না।

সর্জন বা নালা পদ্ধতিতে সবজি চাষ

সর্জন বা নালা পদ্ধতিতে লাউ, পেঁপে, টমেটো, শসা, খিরা, চাষ করে সফলতা পাচ্ছেন খুলনা অঞ্চলের কৃষকরা। সরেজমিন দেখা গেছে, একশ শতক বা ৩ বিঘা ক্ষেতের কোথাও শসা, কোথাও খিরা, কোনো কোনো অংশে লাউ এবং টমেটো চাষ হয়েছে। এসব গাছ অন্য সব অঞ্চলের গাছ থেকে অনেকটাই সতেজ।

সর্জন পদ্ধতি হলো, নিচু জমিতে বাঁধের মতো করে দুই পাশে ড্রেন বা নালা তৈরি করা। এসব নালায় জমে থাকা পানি দিয়ে সেচ দেওয়া হয়। তাতে করে বর্ষার পানি ধরে রেখে পরবর্তী ৪-৬ মাস সেচ দেওয়া যায়। অনেকটা পুকুরের পাড়ের মতো।

নালা পদ্ধতিতে চাষ করা কৃষক প্রসেনজিত হালদারের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তার জমি পাশের জমির মতোই নিচু ছিল। শুধু আমন মৌসুমে ধান চাষ হতো। নালা কেটে সবজি চাষ করছি। এতে করে ধানের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকার ফসল বিক্রি করা যাচ্ছে। নালা মালচিং পদ্ধতিতে চাষের কারণে পানিও কম দিতে হয়। কেননা নালার ভেতরে পানি থাকায় মাটিতে রস ধরে রাখে। আবার শুধু গাছের গোড়ায় পানি দিতে হয় বলে সেচও কম লাগে।

কৃষক প্রসেনজিত হালদার বলেন, এই জমিতে ধান চাষ করলে ১০ মণ ধান হতো। তাতে গড়ে ১৫-১৬ হাজার টাকা বিক্রি করা যেত। কিন্তু সবজি চাষ করে দুই লাখ টাকার বেশি বিক্রি করা হয়েছে। 

সম্প্রতি খুলনা ও বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে ও কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা এসব চিত্র উঠে এসেছে।

খুলনা অঞ্চলে সবজি চাষের বিপ্লবে সহায়তা করা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ‘ক্লাইমেট-স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলনা কৃষি অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন’ প্রকল্প।

প্রকল্পটির পরিচালক শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, খুলনা অঞ্চলে মূলত ৪টি প্রধান সমস্যা। প্রথমত শুষ্ক মৌসুম তথা রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে সেচের পানির প্রচণ্ড অভাব থাকে। দ্বিতীয়ত মাটিতে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। তৃতীয়ত বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা এবং চতুর্থত মাটির নিচের পানিতেও লবণাক্ততা। তা ছাড়া অপরিকল্পিত ঘের, বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়া, লবণ পানির অনুপ্রবেশ ইত্যাদি। প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় ফসল উৎপাদনও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এসব সমস্যা মোকাবিলায় কৃষকরা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলছে। এখানে আমনই প্রধান ফসল ছিল। প্রচুর জমি পতিত থেকে যেত। এখানে ৫ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ১ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমি রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে পতিত পড়ে থাকত। 

তিনি বলেন, এসব জমিতে পানি ব্যবস্থাপনা তথা বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করা, বোরো পিট বা পানি সংরক্ষণ করে ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ক্লাইমেট-স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে এখানে সূর্যমুখী, ভুট্টা, তরমুজসহ বিভিন্ন প্রকারের ফসল ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এসব শস্য ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট। পাশাপাশি আন্তঃফসল, রিলে ফসল, মিশ্র ফসলসহ এসব ফসল চাষের কারণে কনজার্ভেশন এগ্রিকাল তথা সংরক্ষণশীল কৃষি চাষ হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, মাটিতে সরাসরি সূর্যালোক না পড়ায় নিচের লবণ ওপরে আসতে পারে না। এতে করে মাটির আর্দ্রতাটা বজায় থাকে। ফলে মাটির স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। তখন কৃষকরা অন্য একটি ফসল চাষ করে আয় বাড়াতে পারছে।

তিনি আরও বলেন, ক্লাইমেট-স্মার্ট প্রযুক্তি, কৃষি সম্প্রসারণ ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মসূচির কারণে গত ৪ বছরে খুলনা কৃষি অঞ্চল তথাÑ খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইলে ফসলের নিবিড়তা ১৭০-১৮৪ শতাংশ হয়েছে। এখানে ২৫টি ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তির মধ্যে ১৫-১৬টি প্রযুক্তি কৃষক গ্রহণ করেছে।

শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, এসব প্রযুক্তি যেসব কৃষক ব্যবহার করেছে তারা তাতে স্থির আছে। পাশাপাশি তাদের দেখে অন্য কৃষকরাও উৎসাহিত হয়ে তা ব্যবহার করছে। কৃষকরা যেহেতু এসব প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে তাই আশা করি আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে কৃষকরা আরও বেশি করে ব্যবহার করবে। বর্তমানে এখানকার একফসলি জমিগুলো দু-ফসলি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্লাইমেট-স্মার্ট প্রযুক্তিসহ অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় ফসলের নিবিড়তা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে খুলনার দাকোপ উপজেলায় ফসলের নিবিড়তা বেড়েছে ১৩৯ শতাংশ। তা ছাড়া কয়রা, পাইকগাছা, বুটিয়াগাটা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি এবং বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, মোংলা, রামপাল অঞ্চলে বেশি কাজ করা দরকার। কেননা এখানে লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি বেশি। আমরা এখানে কাজও করছি প্রচুর। আমরা ৩৪ হাজার ৫০০ কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ১২ হাজার ৩০০ কৃষককে প্রদর্শনী দিয়েছি।

খুলনা অঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে উল্লেখ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছাইফুল আলম বলেন, খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততাসহ আরও বেশকিছু সমস্যা বিদ্যমান। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটি অন্যান্য স্থানের চেয়ে খুলনা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। সেখানে আমাদের বেশকিছু প্রকল্প রয়েছে। তার মাধ্যমে আমরা লবণাক্ততা ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায় এমন ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। বিভিন্ন দপ্তর, এনজিও ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। যাতে করে কোনোটি ওভারল্যাপিং না হয়। সমন্বিতভাবে কাজ না করলে কৃষকরা বিভ্রান্ত হয় ও কিছু কিছু জায়গা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এ অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ পতিত জমিগুলোকে আবাদের আওতায় নিয়ে আসতে পর্যায়ক্রমে কাজ করা হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা