অর্থনীতি
ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:০৪ পিএম
আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:০৫ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। বর্তমানে সেগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে, এসব সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে এখন পর্যন্ত কৃষি নিয়ে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা না যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়টিতে নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তারা মনে করেন, কৃষি খাতের সংস্কার ও উন্নয়নেও একটি কমিশন গঠন করা দরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী এ খাতে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রায় ৪২ শতাংশ কর্মসংস্থান কৃষিনির্ভর। এই জনগোষ্ঠীকে আধুনিক চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা দরকার। তা ছাড়া কোন জমিতে কোন ধরনের ফসল উৎপাদন বেশি হবে, সে বিষয়েও দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। অপরদিকে দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো চিহ্নিত হওয়াও দরকার। এর জন্য কৃষি সংস্কার কমিশন গঠনও সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
৩৪ বছর ধরে রিভিউ নেই কৃষি খাতে
দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক খাত হচ্ছে কৃষি। খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি নির্ভর করে কৃষির ওপর। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায় প্রতিবছর ঘাটতির মুখে পড়তে হয়। এ অবস্থায় আমদানি ছাড়া বিকল্প থাকে না। কৃষি খাতে রিভিউ হলে বছরে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য প্রয়োজন এবং আগামীর চাহিদা
সম্পর্কে একটি রূপরেখা মিলবে। এতে করে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের সাবেক উপাচার্য এবং প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম কৃষি সংস্কার কমিশনের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সত্তর ও আশির দশকের গোড়ার দিকে ছোট আকারে, ১৯৮৮-৮৯ সালে জাতিসংঘের অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার পারফরম্যান্স অ্যান্ড পলিসিস’ নামে বিস্তৃতভাবে কৃষির ওপর মূল্যায়ন প্রকাশিত হয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে অধ্যাপক রেহমান সোবহান পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা থাকাকালে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনটি ‘রিপোর্ট অব দ্য টাস্কফোর্সেস অন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস ফর দ্য ১৯৯০’ শিরোনামে ৪ খণ্ডে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল কৃষি-সংক্রান্ত। এরপর দীর্ঘ প্রায় ৩৪ বছর কৃষি খাত নিয়ে কোনো কমিশন গঠন বা মূল্যায়ন করা হয়নি। কৃষির সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য বর্তমান সরকার একটি কমিশন গঠন করতে পারে। এতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিষয়াদি সম্পর্কে করণীয় কার্যক্রমের সুপারিশ থাকবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে কৃখি খাত চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বে খাদ্যশস্যের যে দাম বেড়েছে, তার ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছে। এ অবস্থায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে হলে কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন করা দরকার। এখন পর্যন্ত সরকারের কৃষি খাত নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ চোখে পড়ছে না। কমিশন হলে এ খাতের জন্য করণীয় ঠিক করা যাবে।
প্রতিবছর কমছে কৃষিজমি
ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে প্রতিবছর কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। বাসস্থান নির্মাণ, শিল্প-কারখানা স্থাপনসহ বিভ্ন্নি কারণে জমির পরিমাণ কমছে। এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্রপস উইংয়ের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) পরিচালক মো. শওকত ওসমান বলেন, দেশে বছরে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি কমছে। এর কারণ হচ্ছেÑ অনেকে চাষাবাদের জমিতে ঘরবাড়ি, ইটভাটা, শিল্প-কারখানাসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করছেন। এ কারণে একসময় দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্যচাহিদা পূরণের সক্ষমতার ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, কৃষিজমি ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। এক ফসলি, দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমিকে কী ধরনের গুরুত্ব দিতে হবে তার কিছু দিকনির্দেশনা থাকলেও সেগুলো মানা হচ্ছে না। এতে প্রতিনিয়ত তিন ফসলি জমিতে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এ কারণে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, কৃষি খাতের সমস্যাবলি চিহ্নিত ও সমাধানের জন্য অবশ্যই কৃষি সংস্কার কমিশন করা প্রয়োজন। আমাদের বর্গাচাষ পদ্ধতি ও অন্যান্য অনেক বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কোনো ধরনের কাজ হচ্ছে না। তা ছাড়া ফসল উৎপাদনে যথাযথ হিসাব ও বাজার ব্যবস্থাপনাও গড়ে ওঠেনি। আমরা কৃষি খাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনায় কী করব, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে হলে একটি সংস্কার কমিশন গঠন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক
খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার সবুজ রহমান চলতি বছর তিন বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছিলেন। সম্প্রতি তিনি বলেন, প্রতি বিঘায় ১৭-২০ মণ ধান উৎপাদন হয়। আমাদের অঞ্চলে ধানের দাম কম। এতে উৎপাদন ব্যয় তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। আমি প্রতি মণ ধান বিক্রি করেছি ১ হাজার ৩২০ টাকায়।
দাম না পাওয়ার পরও কেন ধান চাষ করেন সে বিষয়ে তিনি বলেন, কয়েকটি গরু রয়েছে। এগুলোর জন্য খড়ের দরকার। ধান চাষ করলে খড় পাওয়া যায়, এজন্যও চাষ করি। উৎপাদন ব্যয় কমানো গেলে লাভের মুখ দেখা যেত।
বাগেরহাটের কৃষক রফিকুল ইসলাম মণ্ডল জানান, তিনি এ বছর টমেটো, শিম, বাঁধাকপি, খিরা ও লাউ চাষ করেছিলেন। মৌসুমের শুরুতে কয়েকদিন ভালো বাজার পেলেও পরে আর তেমন দাম পাননি। বর্তমানে প্রতিটি ফুলকপি ৩-৪ টাকা, ১০ টাকা কেজি শিম বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. তাজ উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কৃষির প্রধান খাত হচ্ছে ৪টি। প্রথমত, সকল ধরনের ক্রপস, লাইভস্টক, ফিশারিজ ও ফরেস্ট্রি। কৃষির সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের আয় আসলেই খুব কম। কেননা তারা যে টাকা ফসল ফলাতে ব্যয় করেন আর বিক্রি করে যে টাকা আয় করেন তা খুবই সামান্য। অর্থাৎ তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের ক্ষেত্রে কৃষি সংস্কার কমিশন দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তাই কৃষি রিভিউ কমিশন বা কৃষি সংস্কার কমিশন অথবা টাস্কফোর্স যে নামেই হোক না কেন, একটি কমিশন গঠন করা দরকার। কৃষির সেক্টর বা সাব সেক্টরের অবস্থানকে সুসংহত করতে কমিশন শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি আরও বলেন, কৃষিতে জড়িতদের আয় যেন নিয়মিত থাকে, কৃষি উপকরণের দাম ও উৎপাদিত ফসলের দাম যেন সঠিকভাবে পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্রেতা ও বিক্রেতা কেউই যেন না ঠকে। এসব কাজে পরামর্শের জন্য কৃষি সংস্কার কমিশন বা টাস্কফোর্স কাজ করে থাকে।
ফসলে অধিক হারে প্রয়োগ হচ্ছে কীটনাশক
ধান, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসলের পোকামাকড় দূর করতে বর্তমানে অধিক হারে কীটনাশক ব্যবহার করছেন কৃষকরা। কখনও কখনও অপ্রয়োজনেও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে ১২ হাজার মেট্রিক টন কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল, কিন্তু ২০২০ সালে তা ২৭ হাজারে টনে উন্নীত হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ৯৮ টাকার কীটনাশকের প্রয়োজন হলেও বর্তমানে লাগছে ৮৮২ টাকার।
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন বলেন, দেশে যে যেভাবে ইচ্ছা কীটনাশক ব্যবহার করছে। অযথা কীটনাশক ব্যবহারের কারণে ফসল, জমি, পরিবেশ-প্রতিবেশ নষ্ট হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে। এসব দেখার লোক নেই। তিনি বলেন, গত বছর আমার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে এক ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার করতে দেখে চাষির সঙ্গে কথা বললাম কেন স্প্রে করা হচ্ছে? তিনি জানালেন, তার পাশের ক্ষেতে পোকা ধরেছে। তার ক্ষেতে যাতে না ধরতে পারে সেজন্য অগ্রিম স্প্রে করছেন।
তিনি আরও বলেন, কীটনাশকের ব্যবহার এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, কৃষক নিজের উৎপাদিত ফসলই খাচ্ছেন না। নিজেদের খাবারের জন্য আলাদাভাবে চাষ করছেন। এসব বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির জন্যও কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন করা দরকার। কমিশন গঠন হলে কোন পণ্যের জন্য কী নীতিমালা দরকার তা অন্তর্ভুক্ত হবে।