আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৮ এএম
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারিখিল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে একটি পুরুষ নীলশির দামা। ছবি : লেখক
অতিবিরল একটি পাখি দেখলাম জীবনে এই প্রথম। মাত্র ১ মিনিট ২২ সেকেন্ডের জন্য। তবে পাখিটির অস্থিরতার কারণে মাত্র ২৫টি ছবি তুলতে পারলাম। সব অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলা সম্ভব হলো না। অপেক্ষায় থাকলাম পাখিটিকে দ্বিতীয়বার দেখার জন্য। কোনো এক প্রজাতির পাখিকে জীবনে প্রথম দেখার উত্তেজনা ও মজা দুটোই আলাদা। আর সে কারণেই ওকে দ্বিতীয়বার দেখার অপেক্ষা বেশ দীর্ঘ মনে হচ্ছে। একেকটি মিনিট যেন ১০ মিনিটের সমান মনে হচ্ছে। এভাবে প্রায় ২৬ মিনিট অপেক্ষার পর একটি বড় ভীংরাজ পাখি দেখে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। মাত্র সাতটি ছবি তোলার পর আরেকটু কাছ থেকে ছবি তোলার জন্য যেই না সামনের দিকে এগিয়েছি, অমনি মাটিতে পড়ে থাকা একটি গাছের ডালের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম। এমনিতেই পায়ের অবস্থা খারাপ, তার ওপর ফটিকছড়ির হাজারিখিল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের ছড়া থেকে প্রায় এক ঘণ্টায় চার কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা হেঁটে এই পর্যন্ত আসতেই আমার পায়ের বারোটা বেজে গেল। কাজেই হোঁচট খাওয়াটা আমার জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতোই হয়ে গেল।
সঙ্গে আনা ফোল্ডিং টুলে মিনিট পনেরো চুপচাপ বসে রইলাম। বিশ্রাম নেওয়ার ফাঁকে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। হঠাৎই মিটার পাঁচেক সামনে একটি গাছের মরা ডালে রঙিন একটি পাখিকে বসতে দেখলাম। প্রথমে পরিচিত একটি পাখি বলে মনে হলো। কিন্তু টুল থেকে উঠে খানিকটা সামনে এগোতেই ভুল ভাঙল। জায়গাটা বেশ অন্ধকার। গাছটিও একটি বাঁকের মধ্যে। দ্রুত একটি ক্লিক করে সাক্ষী ছবি নিয়ে নিলাম। না, এমন রঙিন পাখি আগে খুব কমই দেখেছি এবং পাখিটিকে কোনো দিনই দেখিনি। পক্ষী আলোকচিত্রী ইমরুল হাসান ও ডা. আশিকুর রহমানকে সংকেত দিলে তারাও আমার সঙ্গে যোগ দিল। আরও কয়েকটি ছবি তোলার পর পাখিটিকে চিনতে আর অসুবিধা হলো না। বছর তিনেক আগে ঢাকার জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে এই প্রজাতির একটি স্ত্রী পাখি দেখেছিলাম। তবে এর সঙ্গে স্ত্রীটির চেহারার কোনো মিলই নেই। আসলে রঙিন এই পাখি হলো পুরুষ। অত্যন্ত বিরল পরিযায়ী পাখিটি কালেভদ্রে এ দেশে আসে। সাহসী ও শান্তশিষ্ট পাখিটি আমাদের সঙ্গে প্রায় নয় মিনিট থাকল। আর আমরা পাখিটিকে কোনো প্রকার বিরক্ত না করে সুন্দর সুন্দর সব ছুবি তুলে নিলাম। ভিডিও করলাম। এ বছরের ১২ জানুয়ারির ঘটনা এটি।
এতক্ষণ অনিন্দ্য সুন্দর যে পুরুষ পাখিটির গল্প করলাম, সে এ দেশের অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি নীলশীর দামা। নামটি এ দেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত। পাখিটির ইংরেজি নাম Blue-caped Rock Thrush। মাসসিক্যাপিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Monticola cinclorhyncha। হিমালয়ের পাদদেশ অধ্যুষিত দেশগুলো, যেমনÑ নেপাল, ভুটান, উত্তর ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের আবাসিক পাখিটি শীতে দক্ষিণ ভারত ও মিয়ানমারে পরিযায়ী হয়। শীতের আবাসে পরিযায়ণ ও শীত শেষে ফেরার পথে কালেভদ্রে অল্প কয়েক দিনের জন্য এ দেশে বিশ্রাম নেয়। তাই সচরাচর মার্চ ও অক্টোবরে দেখা মেলে। কিন্তু এবার এটিকে জানুয়ারিতে দেখা গেল।
প্রাপ্তবয়স্ক নীলশীর দামার দেহের দৈর্ঘ্য ১৬ থেকে ১৯ সেন্টিমিটার, প্রসারিত ডানা ৩৩ থেকে ৩৬.৮ সেন্টিমিটার ও ওজন ২৯ থেকে ৪১ গ্রাম। স্ত্রী-পুরুষের পালকের রঙে বিস্তর পার্থক্য থাকে, বিশেষত প্রজননকালে। এ সময় পুরুষের মাথা ও ঘাড়-গলা উজ্জ্বল আকাশি-নীল ধারণ করে। চঞ্চু থেকে চোখ হয়ে একটি চওড়া কালো পট্টি পিঠের কালোর সঙ্গে মিশে যায়। ডানার গোড়া হয় গাঢ় নীল। ডানা ও লেজ হয় চকচকে কালচে-নীল। ডানার মাঝখানে চকচকে সাদা ছোপ থাকে। লেজের তলা, বুক ও পেট উজ্জ্বল গেরুয়া-কমলা। চঞ্চু শ্লেটের মতো নীল যার গোড়া বাদামি। চোখ কালো। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল অনুজ্জ্বল বাদামি। প্রজননহীন ও প্রথম বছরের অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পালক ফ্যাকাশে। কালচে পিঠ ঘিয়ে-হলদে ছিটযুক্ত, অনেকটা আঁশ-ছোপের মতো। অন্যদিকে স্ত্রীর পালক অত্যন্ত সাদামাটা। দেহের ওপরের পালক ধূসর জলপাই-বাদামি। পিঠের শেষভাগে কোমরের কাছে বাদামি ডোরাকাটা দাগ রয়েছে। দেহের নিচের অংশে হালকা ঘিয়ে-সাদার ওপর বড় বড় বাদামি আঁশ-ছোপ।
গ্রীষ্মে ওরা শুকনো খোলামেলা জঙ্গল, ঘাসে ঢাকা পাথুরে ঢাল ও পাইনগাছের বনে বাস করে। সচরাচর পাহাড়ের ১,০০০ থেকে ২,২০০ উঁচুতে দেখা যায়। অন্যদিকে শীতের আবাসে ঘন কাষ্ঠল বন-বাগান ও বাঁশঝাড়ে বিচরণ করে। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় থাকে। গাছপালার ওপর কিংবা মাটি থেকে পোকামাকড়, শূককীট, পাকা ফল ইত্যাদি খুঁজে খায়। মাঝেমধ্যে লেজ নাড়ায়। শীতে চুপচাপ থাকলেও গ্রীষ্মে ‘পেরি-পেরি—-’, ‘পিইই-পিইই-পিইই—-’, ‘গেইঙ্ক-গেইঙ্ক—-’ বা ‘টি-টিউ, টি-টিউ, টিলো-টিউ—-’ শব্দে ডাকে।
এপ্রিল থেকে জুন এদের প্রজননকাল। এ সময় নিজ আবাস এলাকায় পাথর বা বোল্ডারের খাঁজে বা মাটির ওপর শিকড়-বাকড়ে অথবা অল্প উচ্চতায় বাঁশের কঞ্চির খাঁজে কাপের মতো ছোট, কিন্তু অগোছালো বাসা বানায়। গোলাপি-সাদার ওপর লালচে-বাদামি গাঢ় ছোপযুক্ত চারটি ডিম পাড়ে। প্রায় ১৫ দিন তা দেওয়ার পর ডিম ফোটে। বাসা বানানো, ডিমে তা দেওয়া ও ছানা লালন-পালনের কাজ স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে করে। ছানারা প্রায় ১৬ দিনে উড়তে শেখে। তারপরও বাবা-মা আরও প্রায় দুই সপ্তাহ ওদের খাওয়ায়। আয়ুষ্কাল ৫ থেকে ১০ বছর।