আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৫৪ এএম
হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের পুকুরপাড়ে একটি মুরগি-ডাকা ব্যাঙ। ছবি : লেখক
সাড়ে এগার বছর আগের কথা। তখন আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স অর্থাৎ প্রাণিচিকিৎসা ও প্রাণিসম্পদ অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। বিরল ও দুর্লভ পাখি-প্রাণীর প্রজনন প্রতিবেশ নিয়ে তিন বছরব্যাপী একটি গবেষণা প্রকল্পের কাজের জন্য হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে এসেছি। সঙ্গে রয়েছেন সহকর্মী সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (বর্তমানে এই অনুষদের ডিন)। জুন মাস, প্রচণ্ড গরম। ডরমিটরিতে না আছে বিদ্যুৎ, না আছে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট। চানপুর চা-বাগান পেরিয়ে সাতছড়ির দিকে এগুলেই মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না।
পাখির খোঁজে সেই ভোরে বের হয়েছি। প্রায় ৫ ঘণ্টা বনের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে সকাল ১১টা ৫৩ মিনিটে পার্কের অফিসের পেছনের বড় পুকুরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এখানকার পুরোনো একটি পাকুড়গাছের খোঁড়লে বিশাল আকারের এক তক্ষকের (Tokay Gecko) বাস বলে শুনেছি। কাজেই ওকে খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু গাছের খোঁড়লের দেখা পেলেও অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তক্ষকের দেখা মিলল না। আসলে ওরা সাধারণত রাতে পোকামাকড় খেতে বের হয়। তবে তক্ষকের দেখা না পেলেও বড় পুকুরে কটি বক দেখে ওদের দিকে ক্যামেরা তাক করতেই পুকুরপাড়ের একটি খাঁজে ভিন্ন রকমের এক ব্যাঙের দেখা পেলাম। এ রকম ব্যাঙ আগে কখনও চোখে পড়েনি।
রাতের বেলা মাথায় হেডলাইট লাগিয়ে তদানীন্তন ফরেস্ট রেঞ্জার মুনির খান, তার সহধর্মিণী বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী তানিয়া খান ও সহকর্মী জিন্নাহকে নিয়ে আবারও বের হলাম। উদ্দেশ্য গাছের খোঁড়লের ভেতর থাকা তক্ষকটিকে খুঁজে বের করা। বেশ লুকিয়েচুরিয়ে গাছের কাছে এসে তক্ষকের দেখা পেলেও মাথা ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। তবে নিরাশ হতে হলো না। অফিস ঘরের চাল ও কার্নিশের নিচে অন্তত তিনটি তক্ষকের দেখা মিলল। এরপর পুকুরপাড়ের সেই খাঁজের দিকে টর্চের আলো ফেলতেই দুপুরের সেই ব্যাঙের সঙ্গে আবারও দেখা হয়ে গেল। তবে এবার আর ওর ছবি তুললাম না। এরপর অফিসের উল্টোদিকে ডরমিটরির পাশ দিয়ে বনের ভেতর নেমে গিয়ে শুকনো ছড়া ধরে হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার হাঁটার পর ছড়ার এক বাঁকে গর্তের মধ্যে জমে থাকা পানি থেকে একটা কিছুকে উঁকি মারতে দেখলাম। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে দ্রুত কয়েকটা ক্লিক করলাম। দুপুরের সেই ব্যাঙটির মতোই একটি ব্যাঙ। তখন রাত ৮টা ৪৪ মিনিট। এরপর আরও কয়েকটি একই প্রজাতির ব্যাঙের দেখা পেলাম। একটি খাঁদে এদের প্রচুর ব্যাঙাচিরও দেখা মিলল।
এতক্ষণ যে ব্যাঙের কথা বললাম সে এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান উভচর প্রাণী মুরগি-ডাকা ব্যাঙ। কোপের ব্যাঙ বা কোপের আসামি ব্যাঙ নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Cope’s Frog, Cope’s Assam Frog, Long-tongued Frog, Palebrown Small Frog বা Assam Forest Frog। র্যানিডি (Ranidae) গোত্রের প্রাণিটির বৈজ্ঞানিক নাম Hylarana leptoglossa (হাইলারানা লেপ্টোগ্লোসা)। সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের পত্রঝরা, আধা চিরসবুজ ও চিরসবুজ বনাঞ্চল ও বাঁশবনে বাস করে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে দেখা যায়।
মুরগি-ডাকা ব্যাঙের আকার মাঝারি। দেহের দৈর্ঘ্য ৪.৫ থেকে ৭.০ সেন্টিমিটার। মাথা কিছুটা চ্যাপ্টা ও নাক প্রায় চোখা। দেহের ওপরটা চকোলেট-বাদামি, তাতে ছোট ছোট কালো দাগ। দেহের নিচটা সাদা, তাতে অস্পষ্ট দাগ। প্রজনন মৌসুমে পুরুষের স্বরথলি কালো রঙ ধারণ করে। সামনের পায়ের আঙুলগুলো মুক্ত ও পেছনেরগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ পাতার সঙ্গে যুক্ত। ব্যাঙাচিগুলো কালো রঙের।
এরা স্যাঁতসেঁতে বনাঞ্চল, জলস্রোতের অববাহিকা, জলাশয়ের পাশের ঝোপঝাড় ইত্যাদিতে বাস করে। নিশাচর হলেও প্রজনন মৌসুমে দিনের বেলায়ও দেখা যায়। সচরাচর একাকী, জোড়ায় বা ছুটা দলে থাকে। মূলত কীটপতঙ্গ খায়। এ ছাড়াও কেঁচো এবং অন্যান্য ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণীও খেতে পারে। বেশ দ্রুত ডাকে। নামেই বলে দেয় যে এদের ডাক কতকটা মুরগির ডাকের মতো। মে থেকে আগস্টে প্রজনন করে। জলজ উদ্ভিদসমৃদ্ধ স্থির পানিতে ডিম পাড়ে। ব্যাঙাচি কাদা ও ঘোলা পানিতেও বাঁচতে পারে।