বিহঙ্গ
আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৩ এএম
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:১৮ পিএম
সুন্দরবনের জামতলা খালে ঢোকার মখে কেওড়াগাছের ডালে লাল মাছরাঙা। ছবি: লেখক
‘নাইকন ফ্যান ক্লাব’-এর ব্যানারে সুন্দরবনের প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণের জন্য গত ৩১ অক্টোবর রাতে মোংলা জেটিতে নোঙর করা ‘ফেমাস ট্যুর বিডি’-এর ‘দ্য বেঙ্গল অ্যাডভেঞ্চার’ জাহাজে উঠলাম। এবারের সুন্দরবন অভিযানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অভিযাত্রীই আলোকচিত্রী, যার সিংহভাগ আবার পাখি ও বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী। গত ফেব্রুয়ারিতে কুয়াকাটার ‘টেংরাগিরি অভয়ারণ্য’ অভিযানের দীর্ঘ প্রায় নয় মাস পর নাইকন ফ্যান ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি। রাতের খাবারের ব্যবস্থা জাহাজেই হলো। জাহাজ ছাড়ল রাত ১২টা নাগাদ। পরদিন ভোরে আন্দারমানিক হয়ে কচিখালী ও ডিমের চর গেলাম। দ্বিতীয় রাতটা কচিখালীতে কাটিয়ে ভোরে কটকার উদ্দেশে জাহাজ ছাড়ল। আমরা যখন রওনা হলাম তখন ভাটা প্রায় শেষ। ছুটা কটকা খাল হয়ে যাচ্ছি। কাজেই মহাবিপন্ন সুন্দরী হাঁসের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণেই অভিযানের পক্ষী আলোকচিত্রীদের মধ্যে বেশ উত্তেজেনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বিরল ও মহাবিপন্ন পাখিটির দেখা পেলাম না। সাম্প্রতিক সময়ে পাখিটি তেমন একটা নজরে আসছে না। এটা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার।
যাহোক, ছুটা কটকা খাল পাড়ি দিয়ে সুন্দরী বা হোমরা খালে ঢুকলাম। সেখানকার একটি খাঁড়িতে অভিযান চালালাম। কিন্তু থোরমোচা ও সাদা-গলা মাছরাঙা ছাড়া আর কোনো পাখির দেখা পেলাম না। আমাদের প্রথম টার্গেট সুন্দরী হাঁস দেখা থেকে বঞ্চিত হওয়াতে দুর্লভ এক মাছরাঙাকে দ্বিতীয় টার্গেট বানালাম। কিন্তু হোমরা খাল ও তার খাঁড়িতে ওর টিকিটিরও দেখা পেলাম না। বরং প্রচণ্ড রোদ-গরমে সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে জাহাজে ফিরে এলাম।
দুপুরের খাবারের পর বেলা ৩টা নাগাদ কটকা অফিসের কাছে নোঙর করা জাহাজ থেকে বোটে উঠলাম। উদ্দেশ্য কটকা ও জামতলী খালে নৌ-ভ্রমণ করে পাখি খোঁজা ও ছবি তোলা। তা ছাড়া জামতলী টাওয়ার থেকে বাঘের বেডরুম খ্যাত কটকা বন দেখা এবং সেখান থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে বাঘের ভয়সঙ্কুল জামতলী সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ। যাহোক, বোট জামতলী খালে ঢোকার ঠিক মুখে একজোড়া বড় সাদা বকের দেখা পেলাম। ওদের ছবি তুলতে তুলতেই খালপাড়ের কেওড়াগাছের ডালে একটি কালোটুপি মাছরাঙাকে বসে থাকতে দেখলাম। ওর ছবি তুলতে তুলতেই বোটটি পাখিটির কাছে চলে এলো। ফলে পাখিটি উড়ে গিয়ে কেওড়াগাছের গোড়ার দিকের একটি ডালে বসতেই একই ডালে টকটকে লাল আরেকটি পাখি নজরে এলো। সঙ্গে সঙ্গে একযোগে কমবেশি ত্রিশটি ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক ধ্বনি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলল। প্রথম টার্গেটের সুন্দরী হাঁস মিস হলেও দ্বিতীয় টার্গেট মিস হলো না। রাঙা এক মাছরাঙার ছবিতে মন রাঙিয়ে বোট এগিয়ে চলল জামতলী জেটির দিকে।
জামতলী খালে ঢোকার মুখে দেখা রাঙা এই পাখিটি এদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি লাল মাছরাঙা। ইংরেজি নাম Ruddy kingfisher। লালচে মাছরাঙা বা রাঙা মাছরাঙা নামেও পরিচিত। লাল মাছরাঙার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে অনেকে এটিকে পাহাড়ি লাল নামেও ডাকে। অ্যালসিডিনিডি গোত্রের মাছরাঙাটির বৈজ্ঞানিক নাম Halcyon coromanda (হ্যালসিওন করোম্যান্ডা)। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন ও জাপানে এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
রাঙা মাছরাঙার আকার মাঝারি। দৈর্ঘ্যে ২৫-২৭ সেন্টিমিটার ও ওজনে ৬০ থেকে ৯২ গ্রাম। একনজরে টকটকে লালচে পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও পিঠের রঙ গাঢ় লাল। গলা, বুক ও পেট হালকা লাল। কোমর হালকা নীল। চঞ্চুর গোড়া কালচে-লাল ও অগ্রভাগ ফিকে লাল। চোখ কালচে-বাদামি। পা ও পায়ের পাতা প্রবাল-লাল। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও পুরুষগুলো বেশি উজ্জ্বল হয়। অল্পবয়স্ক পাখির দেহের ওপরটা কালচে-বাদামি। দেহের নিচের অংশ লাল ও তাতে কালচে ডোরা দেখা যায়। কোমর ও লেজের ওপরের ঢাকনি গাঢ় নীল। চঞ্চু কালচে ও অগ্রভাগ কমলা-লাল।
লাল মাছরাঙা একমাত্র সুন্দরবনের জলাশয় বা খালের আশপাশে বাস করে। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় দেখা যায়। পানির ওপরে ও কাদার মধ্যে শিকার খোঁজে। মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙ, বড় বড় পোকামাকড় ইত্যাদি বেশ পছন্দ করে। দ্রুত ও জোরে ডানা চালিয়ে সোজাসুজি ওড়ে। তীব্র ও কাঁপা স্বরে ‘টি-টি--টি-টি-টি----’ শব্দে ডাকে। প্রজননকালে মনোরম ‘কুয়িররর-র-র-র-র---’ কণ্ঠে গান গায়।
মার্চ থেকে এপ্রিল প্রজননকাল। এ সময় খালের খাড়া পাড় বা গাছের ডালে ৪৫ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার লম্বা গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। এরপর স্ত্রী তাতে ৩ থেকে ৪টি চকচকে ঘিয়ে রঙের ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১৭ থেকে ২২ দিনে। দুর্লভ এই পাখির ছানাগুলো একসময় বড় হয়ে ওঠে ও নীল আকাশে স্বপ্নের ডানা মেলে। আয়ুষ্কাল ৭ থেকে ৮ বছর।
লেখক : পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ