আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:০৫ পিএম
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:১৩ পিএম
ভারতের রাজস্থানের ভারতপুর পক্ষী অভয়ারণ্যের বাবলা গাছে হলুদকপালি কাঠঠোকরা। ছবি : লেখক
ভারতের রাজস্থান প্রদেশের ভরতপুরে অবস্থিত বিখ্যাত ভরতপুর পক্ষী অভয়ারণ্য বা কেওলাদেও জাতীয় উদ্যানে পাখি পর্যবেক্ষণে এসেছি। সকাল থেকে নানা প্রজাতির পাখি পর্যবেক্ষণ করে ও ওদের সুন্দর সুন্দর সব ছবি তুলে কালো কাঁচিচোরা বা রামকরের (Glossy ibis) একটি ভালো ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় আমার কাছেই লক্ষ করলাম ভারতের কোনো একটি বার্ডিং ক্লাবের সদস্যদের পাখি চেনাচ্ছেন একজন পাখি বিশেষজ্ঞ। তাদের কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমাদের দেশের একটি বিরল ও তথ্য অপ্রতুল পাখির নাম কানে এলো। কালো কাঁচিচোরার ছবি তোলা বাদ দিয়ে দ্রুত ওদের দিকে তাকালাম। আমার ঠিক পাশের বাবলা গাছটিতে ওরা পাখিটি দেখেছে।
ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ওদের এক সদস্যের অঙ্গুলি নির্দেশিত স্থানের দিকে ক্যামেরা তাক করলাম। একবারের চেষ্টাতেই পাখিটিকে দেখতে সক্ষম হলাম। তবে বাবলা গাছের কণ্টকময় ডালাপালার আড়ালে থাকা ছোট্ট পাখিটি ঠিকমতো ফোকাস করতে পারছিলাম না। যাহোক, শেষমেশ অনেক কষ্টে বেশকিছু চলনসই ছবি তুলতে পারলাম। বাংলাদেশে পাখিটিকে কোনোদিন দেখব কি না জানি না। কিন্তু একটি নতুন পাখি আমার পক্ষীতালিকায় যোগ করতে পেরে মনে মনে ভারতের বার্ড ক্লাবটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে খানিকটা দূরের একটি গাছের মগডালে বসে থাকা বড় চিত্রা ঈগলের দিকে ক্যামেরা তাক করলাম। এগারো ফেব্রুয়ারি ২০২০-এর ঘটনা এটি।
ভরতপুরে দেখা ছোট্ট পাখিটি এদেশের এক বিরল ও তথ্য অপ্রতুল আবাসিক পাখি হলুদকপালি কাঠঠোকরা। হলুদ কপালযুক্ত পাকড়া কাঠঠোকরা বা হলদেচাঁদি কাঠকুড়ালি নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে সোনা কাঠঠোকরা। ইংরেজি নাম Yellow-crowned Woodpecker, Yellow-fronted Pied Woodpecker বা Yellow-fronted Woodpecker । বৈজ্ঞানিক নাম Leiopicus mahrattensis (লিওপিকাস মাহরাটেনসিস)। চট্টগ্রাম বিভাগে এই পাখিটি দেখার পুরোনো তথ্য রয়েছে। তবে, বহুদিন পাখিটির কোনো খোঁজ ছিল না। সর্বশেষ ২০০২ সালে একবার কর্ণফুলির কাছে দেখা গিয়েছিল বলে জানা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের আবাসিক পাখি এটি।
প্রাপ্তবয়স্ক হলুদকপালি কাঠঠোকরা লম্বায় ১৭ থেকে ১৮ সেমি ও ওজনে ২৮ থেকে ৪৬ গ্রাম। কপাল ও মাথার সামনের অংশ কমলা-হলুদ। চোখ ও ঘাড়ের মাঝামাঝি হলদে-বাদামি ডোরা এবং ঘাড়ের দু-পাশে হলদে-বাদামি পট্টি রয়েছে। থুতনি ও গলা সাদা। ঘাড়-মাথা বাদে দেহের ওপরটা কালচে-খয়েরি যার পুরোটাজুড়ে রয়েছে অসংখ্য সাদা ফোঁটা। ধূসরাভ ডোরাসহ দেহতল হালকা হলুদ। পেটের নিচে এক ফালি লালের পোচ দেখা যায়। চোখের রঙ কালচে। চঞ্চু নীলচে-কালো। পা, পায়ের পাতা ও নখ কালচে। স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে সামান্য পার্থক্য থাকে। পুরুষের মাথার চাঁদির পিছন দিক ও ঘাড় উজ্জ্বল লাল, স্ত্রীর ক্ষেত্রে যা সোনালি-বাদামি। অনুজ্জ্বল দেহ ও পেটের মোটা ডোরা ছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে পুরোপুরি স্ত্রী পাখির মতো।
এরা উন্মুক্ত বন, বাগান, কুঞ্জবন, ঝোপঝাড়, কৃষিজমি ও মানুষের আবাস এলাকার চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছে বিচরণ করে। একাকী, জোড়ায় বা ছোট পারিবারিক দলে দেখা যায়। গাছের বাকলে আঘাত করে ও ফাটলে চঞ্চু ঢুকিয়ে পোকামাকড়, শূককীট, পিঁপড়া, উইপোকা, মথ, গুবরে পোকা ইত্যাদি বের করে এনে খায়। ফুল ও পাকা ফলের রসেও অরুচি নেই। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কিছুক্ষণ পর পর ‘চাক-চাক---’ শব্দে ডাকে। আর ভয় পেলে ‘ক্লিক-ক্লিক---’ বা ‘ক্লিকর-র-র-র---’ শব্দ করে।
ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস প্রজননকাল। এ সময় এরা গাছের ডালে আঘাত করে মৃদু ‘ডর-র-র-র-র---’ শব্দে ড্রাম বাজায়। গাছের ছোট ডালে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায় অথবা কোনো পুরোনো বাসা ব্যবহার করে। স্ত্রী পাখি সচরাচর সাদা রঙের তিনটি ডিম পাড়ে। প্রজনন ও বংশবৃদ্ধিসংক্রান্ত তথ্যেও অপ্রতুলতা রয়েছে। আয়ুষ্কাল পাঁচ বছরের বেশি।
লেখক : পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ