সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪ ১৩:২৭ পিএম
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৪ ১৪:৪০ পিএম
রাস্তার পাশে পাট শুকাচ্ছে চাষিরা। শনিবার কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের ভূবিরচর গ্রাম থেকে তোলা। প্রবা ফটো
বাংলাদেশ সোনালি আঁশের দেশ। একসময় প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল এই পাট। কিশোরগঞ্জে চলতি মৌসুমে পাটের ভালো ফলন হলেও দাম নিয়ে হতাশ চাষিরা। পাট জাগ দেওয়া ও দাম নিয়ে চিন্তায় পড়েছে তারা। পাট বিক্রির টাকা দিয়ে মাঠ থেকে পরিবহন খরচ, আঁশ ছাড়ানোর যে খরচ তা পাট বিক্রি করে উঠছে না। খরচের বাকি অর্ধেক টাকা গুনতে হচ্ছে পকেট থেকে। এ বছর পাটের তেমন ক্রেতা না থাকায় কৃষকরা পাইকারদের কাছে কম দামেই পাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
কৃষকরা এখন পাট কাটা, জাগ দেওয়া (পানিতে ডুবিয়ে রাখা) ও ধোয়ার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। কিছু পাট বিক্রিও শুরু হয়েছে। এ বছর জেলায় অনেক বেশি জমিতে পাট চাষ করা হয়েছে। পাট চাষের শুরুতে বৃষ্টিপাত কম থাকায় অনেক স্থানে চাষ কিছুটা দেরিতে শুরু হলেও ফলন ভালো হয়েছে।
একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর এক মণ পাট ঘরে তুলতে প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমান বাজারে প্রতি মণ পাট ১৪০০-১৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে লোকসানেই পাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছর বেশি দামে কিনে রাখা অনেক পাট ফড়িয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের গুদামে মজুদ রয়েছে। এ বছর নতুন পাট বাজারে এলেও তারা ভালো দাম হাঁকছেন না। তাই বেশি দামে পাট কিনে রাখার মতো সাহস পাচ্ছেন না প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের থেকে সাড়া পেলে তবেই পাটের দাম বাড়বে বলেও দাবি করেন তারা।
গত শনিবার সকালে সরেজমিনে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে দেখা গেছে, পাট কাটা, জাগ দেওয়া, পাটকাঠি থেকে পাট ছাড়ানো ও শুকানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। পাটের বীজ বপণ থেকে শুরু করে আঁশ ছাড়িয়ে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা পর্যন্ত যে খরচ হয়, তাতে বর্তমান বাজারদরে পাট বিক্রি করলে লোকসানের মুখে পড়তে হবে কৃষকদের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ মৌসুমে জেলায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৬৫ হেক্টর জমি এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ৩০৫ মেট্রিক টন। তবে আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূলে থাকায় জেলায় আবাদ ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ফলন হয়েছে বাম্পার।
পাটচাষিরা বলছে, প্রতি বছরের মতো এ বছরও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পাটের আবাদ করেছে তারা। তবে উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পাটের দাম কমানোর কারণে লোকসানের মুখে পড়ছে তারা। এ পরিস্থিতিতে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বাজার মনিটরিং করাসহ পাটে ভর্তুকি দিতে সরকারের সুনজর প্রয়োজন বলে মনে করছে ক্ষতিগ্রস্তরা।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের ভূবিরচর গ্রামের পাটচাষি ফরিদ মিয়া মিয়া বলেন, পাট ঘরে তুলতে যে খরচ হয় তাতে করে বর্তমান দাম অনুযায়ী বিক্রি করলে খরচ ওঠানো যাচ্ছে না, লোকসানে পড়তে হচ্ছে। কষ্টটাই বৃথা যায়। বাজারে দাম কমে গেলে আমাদের মতো কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়বে। আমরা ফসল ঘরে তুলে মজুদ করতে পারি না। টাকার জন্য বিক্রি করতেই হয়।
হোসেনপুর উপজেলার রামপুর গ্রামের পাটচাষি তাহের মিয়া বলেন, গত দুই বছর পাটের দাম ভালো থাকায় এ বছর এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তিনি চার বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। বীজ রোপণ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রতি মণ পাট ঘরে তুলতে প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সে পাট এখন বাজারে দাম বলছে ১ হাজার ৪০০ টাকা। লোকসান দিয়েই পাট বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার চৌদ্দশত ইউনিয়নের দরবারপুর মলই বাড়ি গ্রামের পাটচাষি সেতু মিয়া বলেন, কয়েক বছরের তুলনায় এ বছরই পাটের দাম সবচেয়ে কম। অনেক কষ্ট করে পাট জাগ দিতে হয়। এসব কষ্ট সুখে পরিণত হতো যদি পাটের ভালো দাম পাওয়া যেত। এখন তো পাট গলার ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। পাটের দাম বৃদ্ধি করা না হলে অনেক কৃষককে পথে বসতে হবে। জীবনে আর পাটের আবাদ করবেন না বলেও জানান তিনি।
তাড়াইল উপজেলার সেকান্দরনগর গ্রামের কৃষক হেলাল উদ্দিন বলেন, এক বিঘা জমিতে পাট আবাদ করে সার, পানি, কীটনাশক, আঁশ ছাড়ানো মজুরি খরচসহ ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। বিঘায় পাট পাওয়া যায় ৮ থেকে ১০ মণ। মোট খরচ হিসেবে আমাদের কোনো লাভ থাকে না। কষ্ট করে পাট চাষ করে কী লাভ? একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা দিয়ে পাট কাটাতে হচ্ছে। ক্ষেতের আশপাশে পানি না থাকায় দূরে নিয়ে জাগ দিতে হয়। এতে পরিবহন ব্যয় বাবদ আঁটি প্রতি ৫-৬ টাকা খরচ হচ্ছে। অনেকে পুকুর ভাড়া করে পাট জাগ দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে এ বছর পাট চাষে কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়েছেন।
দাম কমানোসহ সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পাট ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মিল মালিকদের পাট কেনার আগ্রহ না থাকায় গত বছর বেশি দামে কিনে রাখা অনেক পাট ফড়িয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের গুদামে মজুদ রয়েছে। এ বছর নতুন পাট বাজারে এলেও তারা ভালো দাম হাঁকছেন না। তাই বেশি দামে পাট কিনে রাখার মতো সাহস পাচ্ছেন না প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের থেকে সাড়া পেলে তবেই পাটের দাম বাড়বে বলেও দাবি করেন তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, অন্যান্য বছর দাম ভালো হওয়ায় এ বছর সে আশায় কৃষকরা বেশি পাট চাষ করেছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। বর্তমানে পাটের দাম নেই। কৃষকরাও হতাশ। তবে পাটের দাম কিছু দিনের মধ্যে বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।