× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সেই তিনজনের স্মৃতিতে অনন্য হুমায়ূন আহমেদ

মহিউদ্দিন আলী মাহি

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২২ ১৪:৪৭ পিএম

আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২২ ১৫:০৭ পিএম

সেই তিনজনের স্মৃতিতে অনন্য হুমায়ূন আহমেদ

নিজের কলমের জাদুতে পাঠকদের মন জয় করেছেন তিনি। বলা যায় গল্প পড়তে পাঠকদের একরকম বাধ্যই করেছেন। সেই গল্প থকে পর্দায় উপহার দিয়েছেন জনপ্রিয় সব চরিত্র। নব্বই দশকে তার নাটক-সিনেমাগুলো এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, সাদাকালো টেলিভিশনের সামনে সন্ধ্যা হলেই ভিড় জমে যেত ছোটপর্দার দর্শকদের। নাটকের চরিত্র দেখে কেউ হয়তো প্রাণ খুলে হাসছে তো, কেউ আবার গল্পের চরিত্রের সঙ্গে নিজের জীবনের গল্প মিলিয়ে নীরবে কেঁদেছে। তবে দিন শেষে প্রতিটি মানুষই তার নির্মাণ হৃদয়ভরে উপভোগ করেছে। 

তার নাটকের গল্প দর্শকদের এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, অনেকেই নাটকে তার চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে নিজের সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটির নাম মোনা, পুষ্প, বকুল, বাকের, তৈয়ব, মজিদ রেখেছেন। তাদের এমন জনপ্রিয় করার পেছনে যিনি মূল কারিগর ছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। আজ তার ৭৪তম জন্মবার্ষিকী।

হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রে কাজ করে অনেক তারকাই আলোচনায় এসেছেন। সাফল্য পেয়েছেন অভিনয়ে। তাদের মধ্যে ডা. এজাজ, ফারুক আহমেদ ও স্বাধীন খসরুএই তিনজন অন্যতম। পর্দায় মজার চরিত্রে এই তিনজনকে তুলে ধরেছেন হুমায়ূন। বহু নাটক ও চলচ্চিত্রে তাদের চরিত্রগুলো আজও দর্শককে মুগ্ধ করে। শুধু তাই নয়, এই তিনজনকে নিয়ে সিরিজ আকারে বেশ কিছু নাটকও তৈরি করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেসব নাটকে হাসির আড়ালে জীবনের নানা বোধ ও সংকটকে ফুটিয়ে তুলতেন তিন অভিনেতা। যেখানে স্বাধীন খসরুর মামা চরিত্র ছিলেন ডা. এজাজ। আর তার বন্ধু হিসেবে অভিনয় করতেন ফারুক আহমেদ। 

হুমায়ূনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’। এই নাটকে বিখ্যাত ঢোলবাদক তৈয়ব নামে একটি চরিত্র আছে। যেটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, পরবর্তীতে অভিনেতা ফারুক আহমেদ নিজের নামের চেয়ে তৈয়ব নামেই বেশি পরিচিত হয়ে যান। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীরা তার সঙ্গে মজা করে জিজ্ঞেস করতেন‘ও তৈয়ব, খবর কী?’

গুণী এই নির্মাতার জন্মদিন উপলক্ষে অভিনেতা ফারুকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিদিনের বাংলাদেশের। ফারুক বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ ভাই আমার জন্য একটা আশীর্বাদ ছিলেন। আমি আমার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তার লেখা ও নির্দেশনায় কাজ করেছি। তিনি আমাকে সবসময় তার পছন্দের চরিত্রটি দিতেন। আমি কখনও তার সঙ্গে কাজ করে ক্লান্ত হইনি। জীবনের অনেকটা সময় তার সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছি। বলতে গেলে পরিবারের থেকে বেশি সময় হুমায়ূন ভাইয়ের শুটিং সেটে কাটিয়েছি।’ এ সময় হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা ও তার সঙ্গে কাটানো স্মৃতি নিয়ে ফারুক আরও বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে স্মৃতির শেষ নেই। কোনটা রেখে কোনটা বলব। শুধু এইটুকুই বলব যে তাকে হারানোর যে স্মৃতি, সেটি আজীবনেও ভোলা হবে না আমার। তবে অসুস্থ হওয়ার পর যখনই ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, তিনি একটা কথাই বলতেনফারুক আর কিছুদিন বেঁচে থেকে যেতে পারলে ভালো হতো। জীবন আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। শেষবেলায় এসে খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আমি জীবনকে কী দিলাম।’

হুমায়ূনের জানপ্রিয় নাটকের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘হাবলংগের বাজারে’। এই নাটকে বেশ কিছু জনপ্রিয় চরিত্র রয়েছে, যেগুলো দর্শকদের প্রাণভরে উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছে। নাটকে চেয়ারম্যানের ছেলে মজিদ চরিত্রটি অন্যতম। এ চরিত্রে অভিনয় করে নিজের অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন ডাক্তার অভিনেতা এজাজ। মজিদ চরিত্রে তিনি একজন মানসিক রোগীর ভূমিকায় অভিনয় করেন, যে বিয়ে করতে চায় না। মাথা গরম হলে তার মাথায় পানি ঢালা লাগে। 

সেই মজিদ হুমায়ূন আহমেদের ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে তাকে হারানোর আক্ষেপ ও তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আমার অভিনয়ে পদার্পণের বিষয়টি সবারই কমবেশি জানা। তবে অভিনয় শুরু করার পর প্রথমদিকে আমি খুব ভয় পেতাম। এমন গুণীজনের সামনে কীভাবে নিজেকে প্রমাণ করব সেই বিষয়টি সবসময় আমাকে আলাদা করে চিন্তিত করে তুলত। তবে শুরু থেকেই তার বুদ্ধিদীপ্ত নির্দেশনা ও আদরে নিজেকে অল্পদিনের মধ্যেই প্রমাণ করে ফেললাম।তিনি আমার ওপর আস্থা রাখতে শুরু করলেন। এরপর অভিনয়ের পাশাপাশি প্রডাকশনের সবার দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দিলেন। সবাই কী খাবে, কীভাবে ঘুমাবে সব আমি দেখাশোনা করতাম। কাজের মাধ্যমে স্যারকে আমি কতটা সন্তুষ্ট করতে পেরেছি সেটি আমি জানি না। তবে একটা ঘটনা বলি। আমরা ‘শ্যামল ছায়া’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলাম। চলচ্চিত্রের নির্মাতার চেয়ারে স্যার বসা। একটি দৃশ্য আছে, যেখানে আমি এবং অভিনেতা ফারুক আহমেদ দুজন দেশ স্বাধীনের সংবাদ শুনতে পাই। এরপর নৌকা থেকে পাড়ে তাকিয়ে দেখি আমাদের দেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে। লাল-সবুজের পতাকা দেখে আমরা দুজন স্যালুট দেই। এরপর দৃশ্য শেষ হওয়ার পর দেখি স্যারের চোখের দুইপাশ দিয়ে পানি পড়ছে, যা দেখে আমরা ইউনিটের সবাই ইমোশনাল হয়ে যাই। পরে রাতের বেলা স্যার আমাকে ডেকে বলেন, ‘ডাক্তার ভালো করেছ। তোমার অভিনয় দেখে মনে হচ্ছিল আসলেই মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে আছি।’

তারা তিনজনের আরেকজন অভিনেতা স্বাধীন খসরু। বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে স্থায়ী হয়েছেন। সেখানে থেকে প্রিয় লেখক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে সরব হয়েছেন। জানিয়েছেন নিজের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে একজন পিতৃতুল্য মানুষ ছিলেন। তিনি আমার গুরু। উনি আমার শিক্ষক, বন্ধু, অতঃপর একজন ভালো সঙ্গী। তার সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। উনাকে আমি ভাই ডাকতাম। তার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কথা বলার সাধ্য আমার নেই। প্রতিনিয়ত আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। তার সঙ্গে ‘দখিন হাওয়া’তে থাকার স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে। আড্ডায় তিনি ছিলেন মধ্যমণি। আমার দেখা একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক তিনি। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কিংবা কোনো সংকটে তার কলামে বিষয়গুলো উঠে আসত। 

একবার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদজননী জাহানারা ইমাম হলের নামকরণ নিয়ে অনেক ঝামেলা চলছিল। সেসময় পুলিশ তাকে প্রটোকল ছাড়া সেখানে যেতে বারণ করেছিল। কিন্তু তিনি দলবল নিয়ে সিলেট চলে যান এবং অনশন করেছিলেন।

ক্রিকেটপাগল হুমায়ূনকে নিয়ে স্বাধীন খসরু বলেন, এমনিতে তিনি ক্রিকেট বুঝতেন না। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে কোনো খেলা মিস করতেন না। একদিন কাপাসিয়ায় ‘শ্যামল ছায়া’ ছবির শুটিং সেটে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন বাংলাদেশের খেলা কবে? আগামীকাল খেলা হওয়ার কথা জানতে পেরে তিনি শুটিং বন্ধ করে দিলেন। বললেন, শুটিং বন্ধ থাকলেও কেউ ঢাকা যেতে পারবে না। কারণ তিনি সবার সঙ্গে একসঙ্গে নুহাশপল্লীতে ওই দিন খেলা দেখবেন। 

আরেকবার সুইজারল্যান্ডে শুটিংয়ে গিয়েছিলাম। ওইসময় বাংলাদেশের সিরিজ চলছিল ইংল্যান্ডের মাটিতে। আশরাফুলের সেঞ্চুরি করা ম্যাচটি যাত্রাপথে থাকার কারণে দেখতে পেলাম না। হুমায়ূন ভাই তখন অনেক আফসোস করছিলেন। পরে সুইজারল্যান্ডে যেখানে ছিলাম সেখানে ক্রিকেট খেলা দেখার ব্যবস্থা ছিল না। সেদিন আবারও বাংলাদেশের ম্যাচ ছিল। সেদিন প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূর পাড়ি দিয়ে আমরা জুরিখে পৌঁছলাম। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করছিলাম। কিন্তু সবাই সেখানে ফুটবল খেলা দেখায় ব্যস্ত। পরে একটি অস্ট্রেলিয়ান পাবে গিয়ে হুমায়ূন ভাই অনেক অনুরোধ করলেন বাংলাদেশের খেলা দেখার ব্যবস্থা করতে। তার কথায় গলে গিয়ে পাব মালিক খেলা দেখার ব্যবস্থা করেন।

স্বাধীন খসরুর বক্তব্য, তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই, তবে তার শূন্যতা প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায় আমাদের। তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম আজীবন বাংলা সাহিত্যে বেঁচে থাকবে। এখনও বৃষ্টি পড়লে তার কথা মনে পড়ে। আসলে তিনি তো প্রকৃতিতে এখনও বেঁচে আছেন। এমন মানবিক মানুষকে কেউ ভালো না বেসে থাকতে পারে!

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা