প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪ ১২:০১ পিএম
স্টার সিনেপ্লেক্সের টিকিটের টাকা থেকে নায্যপ্রাপ্য পান না প্রযোজকরা। এ নিয়েও অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই চলমান।
দেশের সিনেমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে সিনেপ্লেক্স। এ কথা মনে করেন সিনেমাপাড়ার অধিকাংশরাই। দেশজুড়ে সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলো যখন পরিবেশসহ নানা সংকটে ভুগছে, তখন সিনেপ্লেক্সগুলো চড়া দামের টিকিট বিক্রি করেও দর্শক টানছে। গেল কয়েক বছরে অনেক সিনেমাই সিনেপ্লেক্সের হাত ধরে সাফল্য পেয়েছে। বিশেষ করে, বিকল্পধারার বা গল্পপ্রধান সিনেমাগুলো সিনেপ্লেক্সে খুবই ভালো ব্যবসা করেছে। শুধু তাই নয়, সিঙ্গেল স্ক্রিনের প্রেক্ষাগৃহে অবহেলিত অনেক সিনেমা সিনেপ্লেক্সের কল্যাণে সাফল্য পেয়েছে, সেই উদাহরণও রয়েছে।
দেশের সিনেপ্লেক্সগুলোর
মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় স্টার সিনেপ্লেক্স। ২০০৪ সালের ৮ অক্টোবর রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি
শপিং মলে যাত্রা শুরু করে স্টার সিনেপ্লেক্স। নান্দনিক পরিবেশ, সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত
সাউন্ড সিস্টেমসহ নানা অভিনবত্বের মধ্য দিয়ে দেশের সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের কাছে এখন
নির্ভরতার নাম সিনেপ্লেক্সের এই ব্র্যান্ড। বর্তমানে একটি ভিআইপি হলসহ মোট পাঁচটি হল
রয়েছে বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে। এ ছাড়া ধানমন্ডির সীমান্ত স্কয়ার, মহাখালীর এসকেএস টাওয়ার,
মিরপুরের সনি স্কয়ার এবং সামরিক জাদুঘরে এর শাখা রয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও
দাপট নিয়ে চলছে স্টার সিনেপ্লেক্স। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে রয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্সের
শাখা। সেখানের দর্শকরাও প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশের নতুন সব ছবি মুক্তির দিনেই দেখতে পারছে!
ঢাকার উত্তরা, বগুড়া, কুমিল্লাসহ দেশব্যাপী আরও সিনেপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে
বলে আগেই জানিয়েছেন স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান। আসছে অক্টোবরের ৮
তারিখ সিনেপ্লেক্স প্রতিষ্ঠানটি ২০ বছরে পা রাখবে।
পথচলার এমন সাফল্যের সময় হঠাৎ করেই অভিযোগের কাঠগড়ায় পড়তে হচ্ছে স্টার সিনেপ্লেক্সকে। একই সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া দুটি সিনেমার প্রযোজক-পরিচালক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এনেছেন। তারা তাদের সিনেমা সরিয়েও নিয়েছেন। তার একটি হলো ‘শ্যামাকাব্য’, অন্যটি ‘ডেডবডি’। যদিও স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘ডেডবডি’ দর্শক পাচ্ছে না বলেই নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। তবে এ ছবির প্রযোজক ও পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল বলছেন, তিনি নিজেই স্টার সিনেপ্লেক্স থেকে তার ছবিটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
ঘটনার শুরু হয়
শ্যামাকাব্য সিনেমা দিয়ে। এটি মুক্তি পায় ৩ মে। মুক্তির এক দিন পরই ছবিটি স্টার সিনেপ্লেক্স
থেকে সরিয়ে নেন এর পরিচালক বদরুল আনাম সৌদ। এ নিয়ে ফেসবুকে একটি ভিডিওবার্তা পোস্ট
করেছেন তিনি। তাতে এ নির্মাতা বলেছেন, ‘আমি কিছুটা অসম্মানিত বোধ করেছি। মুক্তির পূর্ব
থেকে গতকাল পর্যন্ত আমাকে বারবার বলা হচ্ছিল, ছবি না চললে নামিয়ে দেওয়া হবে। হ্যাঁ,
আমি জানি। ছবি না চললে তো নামিয়ে দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে কোনো গল্পই নেই।
পৃথিবীজুড়ে এটিই স্বাভাবিক, ছবি না চললে নামিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এটা আমাকে প্রতিবার
মনে করিয়ে দিতে হবে না। প্লিজ।’
‘শ্যামাকাব্য’
ছবিটি এখন প্রদর্শিত হচ্ছে লায়ন্স ও যমুনা ব্লকবাস্টার প্রেক্ষাগৃহে- জানিয়ে সৌদ তার
ভিডিওবার্তায় এ-ও বলেছেন, ‘‘আমাকে আরও বলা হয়েছে, প্রদর্শনী নিয়ে যে অভিযোগ করেছি,
হল নম্বর ৩ নিয়ে, সেখানে এখন ‘রাজকুমার’ চলছে শাকিব খানের। সেখানে অনেক দর্শক আছে।
শাকিব খান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্টার। শাকিব খানের ছবি দেখতে প্রজেকশন সিস্টেম যাই
থাক না কেন, দর্শক আসবেই। আর শাকিব খান সেটা অর্জন করেছেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে আমাদের
সিনেমাটা গল্পনির্ভর, আমরা কেউ এত বড় স্টার নাÑ তাতেও কোনো সমস্যা না। সব ধরনের ছবি
হবে। এখন আমার ছবিটি একটি বেটার প্রজেকশনসহ প্রেক্ষাগৃহ পেয়েছে, তারপরও অনেক দর্শক
হয়নি বা শাকিব খানের সিনেমার ধারেকাছে টিকিট বিক্রি হয়নি বলে সেটি আমাকে মনে করিয়ে
দেওয়া হয়েছে এভাবে, ৩ নম্বর প্রেক্ষাগৃহে তো আজকে এত দর্শক, তারপরও কেউ কোনো অভিযোগ
করছে না।’’
কথায় কথায় সৌদ
বললেন, ‘আরে শাকিব খানের সঙ্গে আমার তুলনা করে লাভ নেই। আমার সিনেমাটি নিয়ে আমার সঙ্গে
কথা বলেন এবং আমাকে এ ধরনের কথাগুলো বলবেন না প্লিজ। একজন নির্মাতা ও প্রযোজকের জন্য
এগুলো অসম্মানজনক। প্রত্যেকটা ছবির আলাদা মেরিট থাকে। আমাদের ছবিটার ব্যাপারেও আমাদের
আশাবাদ ছিল, ওয়ার্ড অব মাউথ এবং আমাদের গণমাধ্যমের বন্ধুরা আছেনÑ তাদের প্রচারণায় ছবিটি
আস্তে আস্তে ভালো জায়গায় যাবেÑ এমনটাই বিশ্বাস। কিন্তু তিন দিনের মাথায় সকালে ছবিটি
তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি। মনে হয়েছে, বারবার, কয়েক দিন ধরে আমাকে অসম্মান করা হয়েছে।
বারবার বলেছে, ছবিটি না চললে কিন্তু নামিয়ে দেওয়া হবে। জানি, আমি জানি যে ছবি না চললে
নামিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এটা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া খুবই অসম্মানজনক।’
সরকারি অনুদানে
নির্মিত ‘শ্যামাকাব্য’ সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন সোহেল মণ্ডল ও নীলাঞ্জনা
নীলা। আরও আছেন ইন্তেখাব দিনার, নওরীন হাসান খান জেনি, শাহাদাৎ হোসেন, সাজু খাদেম,
রিমি করিম, এ কে আজাদ, সেতু প্রমুখ।
এদিকে মুক্তির তিন দিন পরেই স্টার সিনেপ্লেক্স থেকে নেমে গেছে ‘ডেডবডি’ সিনেমা। মোহাম্মদ ইকবাল পরিচালিত সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন ওমর সানী, জিয়াউল রোশান, শ্যামল মাওলা ও ভারতীয় নায়িকা অন্বেষা রায়।
ছবির পরিচালক
মোহাম্মদ ইকবাল স্টার সিনেপ্লেক্সের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘যে শাখায় কোনো
দর্শক যায় না এবং টিকিটের দাম অনেক বেশি, সেই হলটিতে ‘ডেডবডি’ দেওয়া হয়। তাই তাদের
হল থেকে সিনেমাটি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুয়েক দিনের মধ্যে সিনেপ্লেক্সের
অনিয়ম নিয়ে এফডিসিতে মানববন্ধন করব। একজন প্রযোজক-পরিচালক অনেক কষ্ট করে সিনেমা নির্মাণ
করে। যখন সিনেমাটি মুক্তি দিয়ে প্রতারণার শিকার হয় সে, তখন নির্মাণে আগ্রহ হারিয়ে
ফেলে। সবাইকে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।’’
‘এর আগে তিন দিনের
মাথায় স্টার সিনেপ্লেক্সের বসুন্ধরা শাখা থেকে ‘শ্যামাকাব্য’ সরিয়ে নেন নির্মাতা বদরুল
আনাম সৌদ। এবার একই ঘটনা ঘটল ‘ডেডবডি’-এর ভাগ্যেও’Ñ যোগ করেন ইকবাল।
এসব প্রসঙ্গে
জানতে চাইলে স্টার সিনেপ্লেক্সের সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন,
‘‘যখন সিনেমা ভালো যায় তখন দেখবেন এসব আলোচনা হয় না। যখন সিনেমা চলে না তখন পরিচালক-প্রযোজকরা
আমাদের ওপর নানা রকম দায় দিতে চান। আমরা এসব নিয়ে কথা বলি না। কারণ সিনেমায় এমনিতেই
নানা সংকট। সবাই মিলেই চেষ্টা করছি এর উন্নয়নের জন্য। কয়েক বছর ধরে বাংলা সিনেমায় দর্শক
ফিরছে। আমরা চাই না সেসব দর্শকও সিনেমাবিমুখ হোক। তাই সিনেমার মান নিয়ে কথা বলতে চাই
না। আমরা বিশ্বাস করি, সিনেমা চললে সব অভিযোগই ভালোবাসায় পরিণত হবে। এখন সিনেমা কেন
চলে না, তার দায় তো হলমালিকের না। গেল কয়েক বছরে পরাণ, হাওয়া, প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গ যেভাবে
ব্যবসা করেছে, সেটা দৃষ্টান্ত। তখন কিন্তু কোনো অভিযোগ ছিল না। এই ছবিগুলো এমনও হয়েছে
একেক শাখায় চারটি-পাঁচটি করে শো চালিয়েছি। দিনশেষে এটা দর্শকের জন্য, তাদের ঘিরেই আমাদের
ব্যবসা। এখন সিনেমা না চললে সেটার দায় আমরা কেন নেব? আমরা তো নামিয়ে দেব বলে সিনেমা
নিই না। চালানোর জন্য নিই। কিন্তু যখন দর্শক আসে না, বাধ্য হয়েই তখন আমাদের নামানোর
সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ‘ডেডবডি’ মিরপুরের সনি স্কয়ার ও বিজয় স্মরণির সামরিক জাদুঘর শাখায়
চলছিল। আমাদের সব শাখার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর্শক আসে সনিতে। এটা প্রমাণিত। এখানে সব
বাংলা সিনেমা খুব ভালো যায়। কিন্তু ‘ডেডবডি’ তিন দিন ধরে দর্শক পায়নি। তাহলে এই ছবিটা
আমরা কী করে চালাব? বিষয়টি আমরা ছবির পরিবেশকদের জানিয়েছি আগের দিন যেÑ কাল থেকে আপনাদের
সিনেমার শো চলবে না। দর্শক আসে না। তখন উনারা বলেছেন যে, ‘ওকে শো বন্ধ করে দিন’। এখন
এ ছবির পরিচালক বলছেন তিনি নাকি সিনেমা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এটি ভুল তথ্য।’’
‘শ্যামাকাব্য’
প্রসঙ্গে স্টার সিনেপ্লেক্সের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ছবি আমরা বসুন্ধরা সিটির ৩ নম্বর
হলে মুক্তি দিয়েছিলাম। পরে ছবির পরিচালক অভিযোগ করলেন যে হলটির সাউন্ড, প্রজেকশন ভালো
না। তার কথা মেনেই আমরা ছবিটি ১ নম্বরে নিয়ে ৩ নম্বরে ‘রাজকুমার’ চালাই। ৩ নম্বরে কিন্তু
রাজকুমার ঠিকই দর্শক পেয়েছে। কিন্তু ১ নম্বরে যাওয়ার পরও ‘শ্যামাকাব্য’ দর্শক পাচ্ছিল
না। আমরা তো উনাদের কথা শুনেছি, উনাদের দাবি মেনেই ছবির হলও পরিবর্তন করেছি। তারপরও
আমাদের দোষটা কোথায়? ছবির পরিচালক দাবি করেছেন তার ছবি চলছে নাÑ এটা তাকে বারবার মনে
করিয়ে অপমান করা হয়েছে। ব্যাপারটা আসলেই কি এমন? একটা ছবি চলছে স্বাভাবিকভাবেই সিনেমাটি
কেমন যাচ্ছে তার আপডেট প্রযোজক ও পরিচালককে দেওয়া হয়। এখন ছবিটি যদি ভালো চলত তাহলে
কিন্তু উনার মন খারাপ হতো না বা অপমান মনে হতো না। ছবিটি চলছে না বলেই হয়তো উনি মনে
করছেন তাকে অপমান করা হচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে এটি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে
সিনেমাটি কেমন যাচ্ছে সেই আপডেট দেওয়া হয়। প্রযোজক-পরিচালকরা সিনেমা নির্মাণ করেন বলেই
আমরা ব্যবসা করতে পারছি। বাংলা সিনেমার উন্নয়নে আমরাও কিন্তু শুরু থেকে নানাভাবে কাজ
করে যাচ্ছি। আমাদের প্রতিপক্ষ ভাবার কোনো কারণ নেই। রাগ করে ‘শ্যামাকাব্য’ ছবির পরিচালক
তার ছবি প্রত্যাহার করেছেন। তারপর আমরা ‘কাজলরেখা’-এর প্রদর্শনী দিয়ে সেই গ্যাপ পূরণ
করেছি।’’
স্টার সিনেপ্লেক্সের
টিকিটের টাকা থেকে নায্যপ্রাপ্য পান না প্রযোজকরা। এ নিয়েও অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই চলমান।
স্টার সিনেপ্লেক্স বিষয়টি কীভাবে দেখে? প্রশ্নের জবাবে স্টার সিনেপ্লেক্সের সিনিয়র
মার্কেটিং ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেখুন কত টাকার টিকিট বিক্রি হবে,
কে কত টাকা পাবে, সেটা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এটা নিয়ে কারও অভিযোগ থাকলে এর জবাব
আমাদের কাছে নেই। টিকিটের টাকার ব্যাপারটা ৬০ বছর ধরেই যেভাবে বণ্টন হয় সেভাবে হচ্ছে।
আগে অনেক হল ছিল। এক সপ্তাহে সিনেমাগুলো অনেক টাকা আয় করত। তাই সে সময় এটা নিয়ে আলোচনা
হয়নি। এখন হল কম। প্রযোজকদের লগ্নির অর্থ ফেরত পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। সেজন্য তাদের
কিছু ক্ষোভ জন্মায়। আর সেটা এসে পড়ে সিনেপ্লেক্সের ওপর। কারণ এখানে টিকিটের মূল্য বেশি।
মনে হয় যে এখানেই ঠকানো হচ্ছে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ।’
এ সময় তিনি দাবি
করেন, ভালো গল্প ও মানের সিনেমা নির্মাণ জরুরি। মার্কেট গবেষণা করে দর্শক কী ধরনের
সিনেমা দেখতে চায় সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। সিনেমা ভালো চললেই এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত
সবাই ভালো থাকবে। তখন কোনো ক্ষোভ বা অভিযোগও সামনে এসে দাঁড়াবে না।