প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:১৯ পিএম
আজ শুক্রবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ২০২৪-২৬ মেয়াদের নির্বাচন।
আজ শুক্রবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির ২০২৪-২৬ মেয়াদের নির্বাচন। চলচ্চিত্র শিল্পীদের নির্বাচন নিয়ে গেল কয়েক বছরে তুমুল আগ্রহ দেখা গেছে সবখানে। আগের নির্বাচনগুলোয় ভোটার, শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালকসহ চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের পদভারে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গমগম করত এফডিসি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মিছিল-স্লোগানে মুখর থাকত এফডিসি প্রাঙ্গণ। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচন ঘিরে এফডিসিতে এক ধরনের উত্তেজনাও ছড়িয়েছে বিগত সময়ে। নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও সারা দেশে শিল্পীদের ভক্ত, সমর্থক ও উৎসুক সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ দেখা গেছে। তবে এবারের চিত্রটা ভিন্ন। কেউ দাবি করছেন সিনেমার চেয়ে নির্বাচন আর সমিতি-সংগঠন নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের মাতামাতিতে বিরক্ত সবাই। তাই এফডিসির যেকোনো নির্বাচন নিয়েই এখন সবার অনাগ্রহ। পাশাপাশি শৃঙ্খলা বজায় রাখার অজুহাতে অতিরক্ষণশীলতাও এবারের শিল্পী সমিতির নির্বাচন আলোচনার বাইরে নিয়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে এসেও খুব একটা জমে ওঠেনি। তবু হবে নির্বাচন। এফডিসির মূল ফটক থেকে শুরু করে পুরো আঙিনা প্রার্থীদের রঙিন পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কাদের হাতে উঠবে চলচ্চিত্র শিল্পীদের নেতৃত্ব? সে প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে চলচ্চিত্রপাড়ায়।
ইতিহাস
চলচ্চিত্র শিল্পীদের পেশাগত স্বার্থ রক্ষায় দেশে দেশে বিভিন্ন সময় গঠিত হয়েছে নানা সমিতি ও সংগঠন। ১৯৮৪ সালে চলচ্চিত্র শিল্পীদের নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। এটি বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএফডিসি)-কেন্দ্রিক একটি সংগঠন। চলচ্চিত্র শিল্পীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজ সমাধা, বিভিন্ন সহায়তা প্রদান এবং নানা দাবি পূরণে ভূমিকা রাখে এ সংগঠন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির প্রথম সভাপতি ছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি নায়করাজ রাজ্জাক। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খল অভিনেতা আহমেদ শরীফ। তবে সে কমিটির মেয়াদ ছিল মাত্র তিন মাস। ১৯৮৪ সালের আগস্টে সমিতির নতুন সভাপতি হন অভিনেতা খলিল উল্লাহ খান। তিনি পরপর দুই মেয়াদে ১৯৮৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। দুবারই তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আহমেদ শরীফ।
তারিখ নিয়ে টালবাহানা
নির্বাচন কমিশনের তফসিলে প্রথমে ১৯ এপ্রিল ভোটের দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু ঈদুল ফিতরের ছুটির ফাঁদে তা পিছিয়ে ২৭ এপ্রিল করার দাবি তোলেন অনেকে। নির্বাচন কমিশন তাতে রাজিও হয়। কারণ ১৯ এপ্রিল ভোট হলে ছুটির পরে এসে প্রার্থীরা প্রচার চালানোর সময় পাবেন না। তা ছাড়া ছুটি কাটাতে যাওয়া অনেক ভোটার এত দ্রুত ঢাকায় ফিরে এসে ভোটও দিতে পারবেন না। কিন্তু মিশা-ডিপজল প্যানেলের দাবির মুখে নির্বাচন কমিশন ভোট পিছিয়ে দেওয়া থেকে সরে আসে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরাও চেয়েছিলাম ঈদের পর সময়স্বল্পতার কারণে পিছিয়ে ২৭ এপ্রিল ভোটের তারিখ নির্ধারণ করব। অনেক প্রার্থী, ভোটারেরও দাবি ছিল। কিন্তু সভাপতি প্রার্থী মিশা সওদাগরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তা করা সম্ভব হলো না। তারা আবেদনে বলেছেন, নির্বাচন পিছিয়ে গেলে খরচ বেড়ে যাবে। পরে সব প্যানেল, সব প্রার্থীর মতামত নিয়েই নির্বাচন পেছানো থেকে সরে আসি।’
এই কমিশনারের ভাষ্য, ‘এবারের নির্বাচন আগের বছরগুলোর মতো না জমার কারণও এটি। অনেকে এখনও ঢাকায়ই ফেরেননি। এ কারণে এবার ভোট পড়ার সংখ্যাও কম হতে পারে।’
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক
২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির এ নির্বাচনে ছয়জন স্বতন্ত্রসহ দুটি প্যানেল থেকে ৪৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্যানেল দুটি হলো মিশা-ডিপজল ও মাহমুদ কলি-নিপুণ। এ সমিতির জন্য সাধারণ সম্পাদক পদটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এ পদে দায়িত্ব পালন করছেন অভিনেত্রী নিপুণ আক্তার। তিনি এবারও আছেন একই পদে প্রার্থী হিসেবে। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন অভিনেতা, প্রযোজক মনোয়ার হোসেন ডিপজল। আর সভাপতি পদে অভিনেতা মিশা সওদাগরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন আশির দশকের জনপ্রিয় অভিনেতা মাহমুদ কলি। দীর্ঘদিন পর তিনি ফিরে এসেছেন চলচ্চিত্র শিল্পীদের নেতৃত্বের হাল ধরতে। গেল মেয়াদের সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন সরে যাওয়ায় নিপুণের প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন মাহমুদ কলি।
আরও থাকছেন যারা
কলি-নিপুণ পরিষদে সহসভাপতি পদে আছেন ড্যানি সিডাক ও অমিত হাসান। সহসাধারণ সম্পাদক পদে বাপ্পি সাহা। সাংগঠনিক সম্পাদক অঞ্জনা রহমান, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মারুফ আকিব, দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক কাবিলা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সম্পাদক মামনুন হাসান ইমন আর কোষাধ্যক্ষ পদে প্রার্থী হয়েছেন আজাদ খান। এ প্যানেলে কার্যকরী পরিষদের সদস্যপদে লড়ছেন সুজাতা আজিম, নাদের চৌধুরী, পীরজাদা হারুন, পলি, জেসমিন আক্তার, তানভীর তনু, মো. সাইফুল, সাদিয়া মির্জা, সনি রহমান, হেলেনা জাহাঙ্গীর ও সাইফ খান।
মিশা-ডিপজল প্যানেলে সহসভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছেন মাসুম পারভেজ রুবেল ও ডি এ তায়েব। সহসাধারণ সম্পাদক আরমান, সাংগঠনিক সম্পাদক জয় চৌধুরী, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আলেকজান্ডার বো, দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক জ্যাকি আলমগীর, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সম্পাদক ডন এবং কোষাধ্যক্ষ পদপ্রার্থী কমল। এ প্যানেল থেকে কার্যকরী পরিষদে সদস্য হতে চান অভিনেত্রী সুচরিতা, রোজিনা, আলীরাজ, সুব্রত, দিলারা ইয়াসমিন, শাহনূর, নানা শাহ, রত্না কবির, চুন্নু, সাঞ্জু জন ও ফিরোজ মিয়া।
আলোচনায় ১৫৩ ভোট
এবার নির্বাচনে মোট ভোটার ৫৭১ জন। এর মধ্যে নতুন ভোটার হয়েছেন ৫০ জন শিল্পী। জায়েদ-মিশা প্যানেল ক্ষমতায় থাকাকালে অনেকের ভোটাধিকার বাতিল হয়েছিল। এরপর কাঞ্চন-নিপুণ প্যানেল বিজয়ী হয়ে এলে উচ্চ আদালত থেকে ১০৩ জন ভোটাধিকার ফিরে পান। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন ও ফিরে পাওয়া মিলে মোট ১৫৩ জনের ভোট এবারের নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সব প্রার্থীই এ ভোটারদের নিয়ে বিশেষ অঙ্ক কষছেন।
চলচ্চিত্রপাড়ায় এ ১৫৩ জন ভোটারকে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ প্রার্থীও হয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, এ ১৫৩ জন ভোটার একটি প্যানেলের জিতে আসার ক্ষেত্রে টার্নিং পয়েন্ট হতে পারেন।
টাকা নিয়ে ঠোকাঠুকি
শিল্পী সমিতির নির্বাচন এলেই টাকা দিয়ে ভোট কেনার বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। গেল কয়েক বছরে এ নিয়ে অনেক বিতর্কই হয়েছে। সর্বশেষ বিদায়ি সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চনও ভোটের জন্য অর্থনৈতিক লেনদেন চলে বলে অভিযোগ করেন। এবারও সেই পুরোনো অভিযোগ উড়ে বেড়াচ্ছে শিল্পী সমিতির আঙিনায়। একটি প্যানেলের কার্যকরী পরিষদের সদস্য পদপ্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্ত বলেন, ‘কিছু কিছু সাধারণ ভোটার একটি প্যানেল থেকে টাকাপয়সা পাচ্ছেন। তবে টাকা ছিটিয়ে লাভ হবে না। তারা টাকা খাবেন কিন্তু ভোটটা ঠিক জায়গায়ই দেবেন।’
তবে টাকা ছড়ানোর ব্যাপারটি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মিশা সওদাগর ও নিপুণ অস্বীকার করেছেন। মিশা বলেন, ‘আমি এমন কিছু শুনিনি। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখানে কেন টাকাপয়সার খেলা হবে! এটি মিথ্যা প্রচারণা। অন্তত আমি বা আমার প্যানেলের কেউ এসবের মধ্যে নেই।’ সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী নিপুণও এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এসব করি না। অন্য প্যানেলের কেউ কেউ করতে পারেন। যদিও হাতেনাতে কোনো প্রমাণ নেই, তবে আমরাও মাঝেমধ্যে এসব শুনি।’
ভোটের শিডিউল
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আজ সকাল ৯টায় শিল্পী সমিতি কার্যালয়ে ভোট গ্রহণ শুরু হবে। মধ্যাহ্নবিরতি দিয়ে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলবে ভোট। গণনা শেষে আজই ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
নিয়ন্ত্রণে যারা
এবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু। সদস্য হিসেবে আছেন এ জে রানা ও বি এইচ নিশান। সমিতির ২০২৪-২৬ মেয়াদের নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। এবারই প্রথম শিল্পীদের নির্বাচনে ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে; যা আলোচনার পাশাপাশি বিতর্কের জন্মও দিয়েছে। যে নির্বাচন ছিল চলচ্চিত্র শিল্পীদের আনন্দঘন পরিবেশে বর্ণাঢ্য মিলনমেলার মঞ্চ, সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতি মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই।