প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩২ পিএম
ঢাকাই সিনেমার নন্দিত নায়ক জাফর ইকবাল। একই সঙ্গে গায়কও ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার ভিড়ে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। স্বাধীনতার ডাক শুনে অস্ত্র হাতে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধেও। জীবন তার অনেক সংগ্রামের রঙে রঙিন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যখনই ঢাকাই সিনেমার আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলে উঠলেন তখনই অকাল মৃত্যু কেড়ে নিল সব আলো। চিরসবুজ এই নায়কের ৩২তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ। ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।
ঢাকাই ছবিতে জাফর ইকবাল ছিলেন সত্তর ও আশির দশকের হার্টথ্রুব নায়ক। তাকে স্টাইল আইকন হিসেবে নিয়েছিলেন সেসময়ের তরুণরা। তার অভিনীত ছবি দিয়ে সহজেই লাভবান হতেন পরিচালক ও প্রযোজকরা। এখন নিরবেই কেটে যায় তার জন্মদিন, মৃত্যুদিন।
জাফর ইকবাল জন্মেছিলেন ১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে। বাড়িতে গান-বাজনার রেওয়াজ ছিল। তার বোন শাহানাজ রহমতুল্লাহ একজন সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজও নামকরা সংগীতজ্ঞ। তিনি ছিলেন সংগীত পরিচালক। বহু চলচ্চিত্রের জন্য গান করেছেন।
ভাই ও বোনের মতো জাফর ইকবালও প্রথমে গানের ভুবনেই যাত্রা করেছিলেন গায়ক হিসেবে। গানের চর্চাটা করতেন সেই শৈশব থেকেই। ১৯৬৬ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুককে নিয়ে গঠন করেন ব্যান্ড গ্রুপ ‘রোলিং স্টোন’। এলভিস প্রিসলি ছিল তার প্রিয় তারকা। স্কুলে কোনো ফাংশন হলে তিনি গিটার বাজিয়ে প্রিসলির গান গাইতেন। ‘পিচ ঢালা পথ’ ছিল ব্যান্ড গড়ে তোলার পর তার প্রথম গাওয়া গান।
ভাই আনোয়ার পারভেজের সুরে নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত ‘বদনাম’ ছবিতে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ গান গেয়ে চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে তার অভিষেক হয়। নায়ক হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় হলেও আমৃত্যু গানকে ভালোবেসেছেন তিনি।
প্রথম প্লেব্যাকেই ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান এই অভিনেতা। এরপর সুরকার আলাউদ্দিন আলী তাকে দিয়ে অসংখ্য চলচ্চিত্রে কাজ করিয়েছিলেন। তার জনপ্রিয় কিছু গানের মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ অন্যতম। নিজের কণ্ঠে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শিরোনামে একটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যুগে ‘সুখে থাকো নন্দিনী’ গানটি গেয়ে দারুণ সাড়া ফেলেছিলেন।
এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর উদযাপন বিশেষ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’ গানটি। পরে শিল্পী রফিকুল আলমও গানটি গেয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগে জাফর ইকবাল চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। গান গেয়েই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অভিনেতা খান আতাউর রহমানের সঙ্গে। তার অভিনীত প্রথম ছবির নাম ‘আপন পর’। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালে। খান আতাউর রহমান পরিচালিত এ ছবিতে তার সঙ্গে ছিলেন কবরী। এ সিনেমার ‘যা রে যাবি যদি যা’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়।
এরপর যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন জাফর ইকবাল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। ‘সূর্যসংগ্রাম’ ও এর সিকুয়্যাল ‘সূর্যস্বাধীন’ চলচ্চিত্রে ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন।
১৯৭৫ সালের ‘মাস্তান’ ছবিটি তাকে সে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের রাগী, রোমান্টিক, জীবন-যন্ত্রণায় পীড়িত কিংবা হতাশা থেকে বিপথগামী তরুণের চরিত্রে তিনি ছিলেন পরিচালকদের অন্যতম পছন্দ। ধীরে ধীরে সামাজিক প্রেমকাহিনী ‘মাস্তান’ -এর নায়ক জাফর ইকবাল রোমান্টিক নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে এক গ্রামীণ তরুণের চরিত্রেও দর্শক তাকে গ্রহণ করে দারুণভাবে।
ক্যারিয়ারে জাফর ইকবাল প্রায় ১৫০টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। যার বেশিরভাগই ছিল ব্যবসা সফল। তিনি প্রযোজক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ‘প্রেমিক’ সিনেমাটি তার প্রযোজনায় নির্মিত হয়।
জাফর ইকবাল অভিনীত ত্রিভূজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ হৃদয়’ দারুণ ব্যবসা সফল হয়। এ ছবিতে চম্পা ও ববিতা- দুই বোনের বিপরীতে তার অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে।
ববিতার সঙ্গে তার জুটি ছিল দর্শক নন্দিত। ববিতার বিপরীতে ৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এই জুটির বাস্তব জীবনে প্রেম চলেছে বলেও গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় হতাশ হয়েই জাফর ইকবাল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান বলে জোর গুঞ্জন উঠেছিল। অনেকেই বলেন, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারো ঘরণী’ গানটি জাফর ইকবাল ববিতার জন্যই গেয়েছিলেন। যদিও প্রেমের বিষয়ে ববিতা বা জাফর ইকবাল কেউ-ই কখনো মুখ খুলেননি।
তবে ব্যক্তিজীবনে ভালোবেসেই তিনি বিয়ে করেছিলেন চলচ্চিত্রের বাইরের মানুষ সোনিয়াকে। সোনিয়া-জাফর দম্পতির দুই ছেলে সন্তানও রয়েছে।
জাফর ইকবাল অভিনীত ‘ভাই বন্ধু’, ‘চোরের বউ’, ‘অবদান’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘দিনের পর দিন’, ‘বেদ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘মেঘবিজলী বাদল’, ‘নয়নের আলো’, ‘সাত রাজার ধন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘প্রেমিক’, ‘নবাব’, ‘প্রতিরোধ’, ‘ফুলের মালা’, ‘সিআইডি’, ‘মর্যাদা’ ,‘সন্ধি’, ‘বন্ধু আমার’, ‘উসিলা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র সুপারহিট হয়।