সৌম্য প্রীতম
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৩ ১৪:৫২ পিএম
মামুনুর রশীদ। বাংলাদেশের বিনোদন জগতে কিংবদন্তি একজন অভিনেতা। নাট্যজন হিসেবেও তাকে সম্মানিত করেন সহকর্মী ও অনুরাগীরা। সম্প্রতি তার একটি বক্তব্য ঘিরে চলছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা।
মামুনুর রশীদ দেশের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় নিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই নিচ্ছেন বিপক্ষে অবস্থান। অনেকে আবার মামুনুর রশীদকে সমর্থন দিয়ে দাবি করছেন, দেশের রুচি ও সংস্কৃতির উন্নয়নে দীর্ঘদিনের যে পথচলা সেখানে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে অন্যতম মামুনুর রশীদ। দীর্ঘজীবন জনরুচির টিভি নাটকে কাজ করেছেন। জনরুচি উন্নত করার সংগ্রামও করেছেন তিনি। আবার জনরুচি বা জনসংস্কৃতির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃতও হয়েছেন। মামুনুর রশীদরা অবশ্য এক বিশাল দুর্ভিক্ষের মধ্যেই সাংস্কৃতিক যাত্রা শুরু করেছিলেন। ষাটের দশকে দেশের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে মামুনুর রশীদদের হাত ধরেই এ দেশ পেয়েছিল তার সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা। তাকে নিয়ে ট্রল, কটাক্ষ দেখে বিচলিত শিল্পীসমাজ। তারা মনে করেন ‘এন্টারটেইনার’ ও ‘শিল্পী’র মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট করার সময় এসেছে। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে মামুনুর রশীদকে নিয়ে নানা কটু কথা ও অপমানসূচক ভিডিও, ছবি। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে অনেকেই তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেক শিল্পী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে জানিয়েছেন প্রতিক্রিয়া। বরেণ্য নির্মাতা
নাসির উদ্দীন ইউসুফ
অর্ধশতাব্দী পূর্বে শিল্পাচার্যের উচ্চারণ “রুচির দুর্ভিক্ষ”। এ সত্য একালে ধ্বনিত হলো নাট্যকার মামুনুর রশীদের কণ্ঠে। মামুনুর রশীদের প্রতি কতিপয় ব্যক্তির অশ্লীল বাক্যবাণ প্রমাণ করে কি চরম রুচির দুর্ভিক্ষকালে আমাদের বসবাস।
সুবর্ণা মুস্তাফা
দীর্ঘ বছর আগে জয়নুল আবেদিনের কথা আবারও সামনে নিয়ে আসার জন্য মামুন ভাইকে ধন্যবাদ। সময়ের প্রয়োজনে তিনি কথাগুলো বলেছেন।
আফজাল হোসেন
শিল্পাচার্য যখন রুচির দূর্ভিক্ষের কথা বলেছিলেন তখন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা মানুষ কম ছিল, নাকি ছিলই না। অমন কথায় কারো গায়ে ফোস্কা পড়েছিল- এমনটা শোনা যায়নি। তখন কি তাহলে সকলের গায়ের চামড়া মোটা ছিল? নাকি তখন কথাটা অনুধাবন করবার সাধ্য ছিল মানুষের- তাই উচ্চবাচ্য না করে স্বীকার করে নিয়েছিল, মন্তব্যটা ভুল নয়। এখন রুচির দূর্ভিক্ষের কথা বললে মানুষ রে রে করে তেড়ে আসবে। দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতে একাট্টা হয়ে হামলে পড়বে। এমন উদাহরণই উপযুক্ত প্রমান যে সত্যি সত্যিই আমাদের এখন রুচির দূর্ভিক্ষ চলছে। সময়টা বড় অদ্ভূত, একদল ছড়ি ঘুরিয়ে অহরহ চোখ রাঙাচ্ছে। যখন তখন নিজেদের রুচি, জ্ঞান অনুযায়ী যেমন খুশী তেমন বলে, করে যাচ্ছে- তাতে রা নেই কারো। কিন্তু যে মানুষের প্রগতিশীল ভূমিকা রয়েছে, সামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য যাঁর অবদান অশেষ- তাঁর এক মতামতে ফেনিয়ে উঠছে গেলো গেলো রব। যুক্তির মন থাকলে স্বীকার করতেই হয়, নানা রকমের অবনতিকেই এখন ইনিয়ে বিনিয়ে উন্নতি বলে দাবী করার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। সে অভ্যাস আমাদের এতটাই সাহসী বানিয়ে দিয়েছে যে নির্দ্বিধায় বুক ফুলিয়ে যার যেমন ইচ্ছা- তেমনটা করা, বলা যায়। সেই করা বা বলায় অনুসারী তৈরি হয়, বিপুল করতালি পেয়ে স্বেচ্ছাচারের উদ্যম বাড়ে। কোনদিক থেকেই এসব কান্ড বাধাগ্রস্থ হয়না, বিপরীতে সামাজিক স্বীকৃতি বলে গন্য করা হয়। এই ভয়ঙ্কর নীতিহীন কর্মকান্ডে তারাই ঘি ঢালে- যারা বিবেক বোধ বন্ধক রেখে নিজ উন্নতির সোপান ভেঙে চলেছে। দুই পক্ষ পরষ্পরের হয়ে ওঠে এক লক্ষ্যে- বিশেষ হতে হবে। সকল স্বাভাবিকতা তছনছ করে দিয়ে শুধু নিজ নিজ স্বার্থরক্ষা, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বেশরম চেষ্টা- এটাই বড় মাপের রুচিহীনতা, রুচির দূর্ভিক্ষ। জ্ঞানহীনের রুচিহীনতার চেয়ে জ্ঞান থাকা মানুষের রুচিহীনতা অনেক বেশি ভয়ানক। এই দুই পক্ষ মেড ফর ইচ্ছা আদার কাপল হলে সমাজে।
মাসুম রেজা
রুচির দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গে আমি মনে করি মামুন ভাই কারও নাম উল্লেখ না করলেও পারতেন। তবে রুচির দুর্ভিক্ষের বিষয়টি তিনি যথাযথভাবেই বলেছেন। এ কথাটির জন্য তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে যেভাবে ব্যবচ্ছেদ করা হচ্ছে তাতে রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার দরকার পড়বে না। মামুন ভাই তার সাক্ষাৎকারে এটাও বলেছেনÑ অবকাঠামো উন্নয়নের যে বন্যা বয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে রুচি এবং সংস্কৃতি উন্নয়নের প্রচেষ্টাও নিতে হবে। রুচির এ দুর্ভিক্ষ কাদের কারণে হয়েছে, কেন হয়েছে তার হয়তো একটা গঠনমূলক আলোচনা উত্থাপন করা যেত মামুন ভাইয়ের এই কথার প্রসঙ্গে। তা না হয়ে যেটা হচ্ছে তা কি ঠিক হচ্ছে?
চঞ্চল চৌধুরী
, ‘এর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়। দায়ী আপনি বা আমি, দায়ী আমাদের নিম্ন মানসিকতা। আপনি কাকে অনুসরণ করবেন বা সমর্থন দেবেন বা কে হবে এ দেশে আপনার রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক আদর্শ, চূড়ান্ত ভাবনার এই সময়টুকুও বোধ করি পেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো অবজ্ঞা করার মতো হলেও, আমাদের সন্তানরা ভবিষ্যতে অনুসরণ বা শ্রদ্ধা করার মতো কাউকে পাবে না। পরিচিত হতে হবে আপনার রুচিতে জন্ম দেওয়া কোনো ভাইরাল বিনোদন ব্যক্তির উত্তরসূরি হিসেবে। কারণ আপনি বা আমি ঠিক বেঠিক বা উচিত অনুচিতের পার্থক্য ভুলে সস্তা বিনোদনপ্রিয় জাতিতে পরিণত হয়ে গেছি।
অভিনয়শিল্পী সংঘের প্রতিবাদ
বুধবার (২৯ মার্চ) সন্ধ্যায় সংগঠনটি একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতির চুম্বকাংশে বলা হয়েছে, ‘একটি বিশেষ সম্প্রদায় মামুনুর রশীদের বলা একটি শব্দ, লাইনকে ব্যবহার করে যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, বিভাজন তৈরি করছে তা ভীষণ নিন্দনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য। যে বা যারা এ কাজটি করছেন তারাই শিল্প ও সংস্কৃতির প্রধান শত্রু। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা মামুনুর রশীদের সঙ্গে একমত। রুচি ও মূল্যবোধের ভীষণ অবক্ষয় চলছে। অদ্ভুত আঁধার এক পৃথিবীতে আজ!’
টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ
‘রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বক্তব্য রেখেছেন মামুনুর রশীদ’ শিরোনামে একটি বিবৃতি দিয়েছে সংগঠনটি। বিবৃতির চুম্বকাংশে বলা হয়েছে, ‘রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে টেলিভশন নাট্যকার সংঘের সম্মানিত উপদেষ্টা বরেণ্য নাট্যজন শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদের সময়োপযোগী একটি লেখা নিয়ে কয়েকদিন যাবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে বিপক্ষে প্রদত্ত মতামত এবং বিপক্ষে মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে রুচিহীন ও মানহানীকর বক্তব্য আমাদেরকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে রুচির দুর্ভিক্ষ এখন প্রায় সবক্ষেত্রে, সব মহলে বিদ্যমান। শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদ সে বিষয়ে কিছুটা বলেছেন শুধু। তাতেই এই অবস্থা। আমাদের দায়িত্ব শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদের দেওয়া সতর্ক বার্তা হৃদয়াঙ্গম করে সমন্বিতভাবে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করা।
এ ছাড়াও অনেক নাট্যকার, নির্মাতা, প্রযোজক ও শিল্পীরা মামুনুর রশীদের জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করছেন।