শারমিন সুলতানা সুমি
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:১৮ পিএম
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৩৯ পিএম
গত ২০ বছরে বেঁচেছি। তুমুল বাঁচা বেঁচেছি। গানে, গল্পে, সৃষ্টিতে, ঝগড়া, আপসে অভিমানে, অপমানে, অবহেলায়, প্রাপ্তিতে, ভালোবাসায়, সাহসে, হার না মানায়; পাগলের মতো আনন্দ নিয়ে বেঁচেছি। আর কি চাই! ছোট্ট একটা জীবন। এক জীবনে কয়জন এমন পায়। ২০ বছর বয়সি একটা ব্যান্ডের অনেক মৌলিক বাংলা গান আছে। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পাওয়া গান আছে। ব্যান্ডটি অনেক গুণী মিউজিশিয়ানকে যত্নের সঙ্গে মানুষের সামনে এনেছে, দেশ-বিদেশে মাতৃভাষার গান নিয়ে সুনাম কুঁড়িয়েছে। শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি প্রান্তে মানুষ এই ব্যান্ডের নিজেদের তৈরি করা গান গায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে আর কি চাইবার আছে আমাদের!
ইচ্ছাশক্তির প্রাচুর্য আর আমার সীমিত সাধ্য থেকে নানা সংগ্রামের মাঝেও গান নিয়ে এগোতে চেয়েছি সব সময়। স্নেহ দিয়ে আগলে রাখতে চেয়েছি চিরকুট পরিবারকে। যদিও স্নেহের জায়গাটা ঠিকঠাকমতো যোগাযোগে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। যেটা আমাকে কষ্ট দেয় বলতে দ্বিধা নেই। তবে যখন যা-ই করেছি, সবাইকে নিয়ে করেছি। করেছি অন্ধের মতো ভালোবাসা নিয়ে। সততা দিয়ে, শ্রম দিয়ে, একাগ্রচিত্তে। (মধুর কিংবা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে, এত প্রেম নিয়ে ছোট চিরকুট এর ২০ বছরের এই প্রচেষ্টা; ভালবেসে মাথায় তুলে তাকে কালের পরিক্রমায় আপনারা বানিয়েছেন এক মহাকাব্য। কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা ছাড়া আর কি বা দিতে পারি!)
এই ২০ বছরে অনেক কিছু পেরেছি কি না জানি না। কিন্তু বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ভাণ্ডারে জমা রেখেছি আহারে জীবন, মরে যাবো, উধাও, খাজনা, জাদুর শহর, কানামাছি, দুনিয়া, ভালোবাসলে কেন খিদে পায় না, এই শহরের কাকটাও জেনে গেছে, বাংলার কথা, বুকা বুকা, খালাস, দেখা হোক দেখা হবে, সাঙ্গু, বন্ধু গো, তারুণ্যসহ অসংখ্য গান, যা আপনাদের ভাষায় আপনাদের গান।
২০ বছরে বাংলা গান নিয়ে ছুটেছি বিশ্বের পথে-প্রান্তরে। যেখানেই গিয়েছি, মানুষ আমাদের আপন করে নিয়েছে, আমাদের গান ভালোবেসেছে। যখনই সুযোগ পেয়েছি, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল বাংলা গানকে বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দিতে। বাংলা গান নিয়ে চিরকুট ঘুরে বেড়িয়েছে ইউএসএ, ইউকে, নরওয়ে, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা মিউজিক ফেস্টিভ্যালে। বিশ্বসংগীতের অন্যতম বড় উৎসব এসএক্সএসডব্লিউ মিউজিক ফেস্টিভ্যাল থেকে শুরু করে নিজের দেশের ৫০ বছর পূর্তিতে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কিংবদন্তি ব্যান্ড স্করপিয়ন্সের সঙ্গে একই মঞ্চে পারফর্ম করা, আপনাদের দোয়া, সহযোগিতা আর আমাদের প্রচেষ্টায় চিরকুট অর্জনে বারবার ছাড়িয়ে গেছে নিজেদেরকেই।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সব সময় চেয়েছি, চিরকুটকে প্রতিভাবান মিউজিশিয়ানের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তৈরি করতে। ইমন-পাভেলরা যখন ছোট ছিল; ওদের নিয়ে আলাপ করতাম, চিরকুট এক সময় ২০০-৩০০ মানুষ বাজাবে। ইমন গিটার ডিপার্টমেন্ট দেখবে, পাভেল ড্রামস দেখবে, নীরব তার জায়গাটা দেখবে। আমরা সবাই মিলে অনেক বড় একটা মিউজিক্যাল পরিবার হয়ে উঠব। অনেক ফোক গান করব, দেশের গান করব। নতুন নতুন কাজে এক বিশাল পরিবার হবে চিরকুট। এখন যদিও সবার প্রাইওরিটি বদলে গেছে। তবে হবে হয়তো। কারণ চিরকুট তো থেমে থাকতে জানে না।
আরও পড়ুন: বিশ্বকাপ বানিয়ে চমকে দিল বেলাল খানের ছেলে!
আমি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, চিরকুটে অবদান রেখেছেন অসংখ্য গুণী সদস্য। ভবিষ্যতেও চিরকুট যতদিন তার যাত্রা অব্যাহত রাখবে, আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে, সে অনুযায়ী নতুন মিউজিশিয়ানদের সাপোর্ট দিয়ে যাব। আর তৈরি করতে থাকব নতুন নতুন বাংলা গান।
একটা ব্যান্ড প্রতিষ্ঠানের মতো। এখানে নানা কাজ থাকে, কিছু শৃঙ্খলা থাকে, কমিটমেন্টের জায়গা থাকে। ব্যান্ডে প্রতিবন্ধকতা আসে, সাফল্য আসে। এই সব কিছুর ভেতর দিয়েই এগিয়ে যায় ব্যান্ডের যাত্রা। আজ ২০ বছরের এই সুন্দর সময়ে বলতে চাই, চিরকুটের যদি কোনো ব্যর্থতা থাকে, তার সকল দায় আমি নিজের কাঁধে তুলে নিতে চাই। আর চিরকুটের যত সাফল্য, তা আমি সবার মধ্যে ভাগ করে দিতে চাই। ধন্যবাদ জানাতে চাই চিরকুটের পেছনে নানাভাবে কাজ করার সকল কারিগরকে। রাসেল, সাইফুল, অনিক, সুমন, ইয়ার হোসেন, শান্ত, বাবু, মানিক, সিদ্ধার্থ (মৃত) সঞ্চয় ভাই, সুমন দত্ত ভাইসহ সবাইকে। আমাদের প্রাক্তন লাইভ সাউন্ড ইন্জিনিয়ার মারুফ কামরুল হাসান ভাই এবং বর্তমান সাউন্ড ইন্জিনিয়ার সাগর ভাইকে। আমাদের দীর্ঘ এই যাত্রায় যারা বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই সবাইকে। আমি ধন্যবাদ দিতে চাই আমাদের সদস্যদের সবার পরিবারকে, দেশের গণমাধ্যম থেকে শুরু করে নেপথ্যে কিংবা প্রকাশ্যে যারা সব সময় সহযোগিতা করে গেছেন তাদের।
একজনকে দায়িত্ব নিয়ে ব্যান্ডকে সামনে এগিয়ে নিতে হয়, অনেকের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি সেই দায়িত্বটাই পালন করার চেষ্টা করে গেছি। এর জন্য কখনও কঠোর হতে হয়েছে, কখনও কোমল। কিন্তু নাম, যশ, খ্যাতির দিকে না তাকিয়ে বরং কাজটা এগিয়ে নেওয়াই আমার কাছে মুখ্য ছিল। তবে একটা ব্যাপার বুঝেছি, সবাইকে খুশি করা ভীষণ কঠিন কাজ। এর ভেতরেও যারা বোঝার তারা কোনো কারণ ছাড়াই পাশে থেকেছেন। যারা বোঝার না; হাজার যত্ন-ভালোবাসা দিয়েও তারা খুঁত খুঁজে গেছেন। তারপর নিয়মিত বিরতিতে ‘বর্গী আসে ব্যান্ডে’। মানে প্রচুর তৃতীয় পক্ষ তো থাকেই। তবে এসবের সুবিধা হলো এগুলোর মাধ্যমে এই একটা ব্যান্ড-জীবন আমাকে নানাভাবে জীবন দেখিয়েছে। কত দর্শনে ভাবতে শিখিয়েছ। ধৈর্য শিখিয়েছে। জীবন আসলেই এক অদ্ভুত সমীকরণ।
এসব চলবেই। সবার ভালোবাসায় এভাবেই দায়িত্বটা পালন করে যেতে চাই। তবে এই কঠিন যাত্রায় একজনের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, সে আমাদের ড্রামার-প্রডিউসার পাভেল আরিন। একটা ব্যান্ডে স্টেজে বাজানো যত সহজ, কিন্তু এর পেছনের পথটা পাড়ি দেওয়া ততটাই কঠিন, সেই পথটাতে পাওয়া যায় খুব কম মানুষকে। সেই পথে পাভেল-নীরবকে আমি সব সময় পাশে পেয়েছি। আর বছরের পর বছর স্টেজে তো ইমন, পাভেল, নীরব যখন বাজিয়েছে, আগুন ধরিয়েছে এক সঙ্গে। এখন যুক্ত হয়েছে তাওকির, নেওয়াজ আরও অনেকে।
আজ গর্ব নিয়ে বলতে পারি, এত বছর শুধু গান গাওয়ার জন্যই গান গায়নি চিরকুট। গানের মাধ্যমে চেষ্টা করেছে যতটুকু সম্ভব পৃথিবীর জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার। গানের মাধ্যমে আমরা নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে বলতে চেয়েছি, মানুষকে সচেতন করতে চেয়েছি। করোনার কঠিন দুঃসময়ে গান দিয়ে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। তরুণ প্রজন্মের জন্য সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী রেখে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে জলবায়ু সচেতনতায় কাজ করার চেষ্টা করেছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হলেও ‘নদী রক্ষা’ যেন চিরকুটের সত্তার সঙ্গেই মিশে রয়েছে। চিরকুট এখন শুধু আমাদের ব্যান্ড না। চিরকুট এখন গণমানুষের ব্যান্ড। আমরা শুধু গান লিখেছি, সুর করেছি, গেয়েছি। কিন্তু চিরকুটকে রূপকথায় পরিণত করেছেন আপনারা, যারা ভালোবেসে হৃদয়ে নিয়েছেন।