গোয়েন্দাধর্মী সিনেমা নির্মাণ
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৩২ এএম
এমআর-৯ সিনেমার পোস্টার
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের রুচি বদলায়Ñএ উপলব্ধির জায়গা থেকে হাজারো ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া ভারতীয় বাংলা সিনেমা শক্ত অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে যেমন গ্রামের দর্শকের কথা ভেবে বলিউড কিংবা দক্ষিণী ছবির রিমেক করা হয়, তেমন শহুরে মধ্যবিত্ত দর্শক হলে টানতে নবধারার সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। সেসব সিনেমার বড় অংশজুড়ে আছে গোয়েন্দা-থ্রিলার। রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পে বুঁদ হয়ে আছেন সেখানকার দর্শক। লগ্নিকৃত টাকা তুলতে খুব একটা বেগও পান না প্রযোজক।
বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তুখোড় সব গোয়েন্দা চরিত্র দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে ঢালিউডের রুপালি পর্দায় তাদের বিচরণ নেই বললেই চলে। ফলে কল্পনার রাজ্যেই থেকে যাচ্ছে তারা। হালের জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য কয়েকটি নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মাসুদ রানা অবলম্বনে সিনেমা নির্মিত হয়েছে।
বইয়ের পাতা থেকে তুলে গোয়েন্দাদের পর্দায় উপস্থাপন করা হচ্ছে না কেনÑপ্রশ্ন ছিল থ্রিলার নির্মাতা সঞ্জয় সমদ্দারের কাছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের দর্শকের মধ্যে গোয়েন্দা সিরিজ নিয়ে উন্মাদনা কম। কলকাতায় ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সী কিংবা কিরীটি রায়সহ অন্যান্য গোয়েন্দা চরিত্র নিয়ে নিয়মিত চর্চা হয়, সেটা আমাদের এখানে হয় না। তা ছাড়া আমাদের দেশের বাংলা সাহিত্যে সেভাবে গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি হয়নি। মাসুদ রানাও তিন গোয়েন্দা ছাড়া জনপ্রিয় কোনো চরিত্র নেই।’
তরুণ নির্মাতা ভিকি জাহেদ বলেন, ‘ডিটেকটিভ থ্রিলার নির্মাণ বেশ জটিল। বড় ক্যানভাসে করতে হয়। স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করা লাগে। এতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। এসব দিক বিবেচনায় পরিচালকরা সাধারণত এ ঘরানার সিনেমা নির্মাণ করতে চান না।’
তাহলে কি ভালো পরিচালক সংকট আমাদের? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক ভালো মেকার আছেন। গল্প বাছাই থেকে শুরু করে পোস্ট প্রোডাকশন পর্যন্ত যদি ওই পরিশ্রমটা করতে পারি, তাহলে ভালো গোয়েন্দা থ্রিলার সিনেমা বানানো সম্ভব। তবে প্রযোজকদেরও সদিচ্ছা থাকতে হবে। এসব গল্প বোঝা প্রযোজক খুব সীমিত।’
দেশের সর্বাধিক বাণিজ্যিক ঘরানার চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন আবদুল্লাহ জহির বাবু। তিনি বলেন, ‘একটি খুনের ঘটনা এবং পরে রহস্য উন্মোচন হলো গোয়েন্দা সিনেমার কাহিনী। বাণিজ্যিক ধারার সিনেমার মতো ডিটেকটিভ ছবিতে অ্যাকশন কিংবা গান থাকে না, যা দর্শক টানতে পারে। এ দেশে এ জনরার সিনেমার জনপ্রিয়তা আছে, তবে সিনেমা হলে দর্শক টেনে আনার ক্ষমতা নেই। আর সে কারণে প্রযোজক লাভের কথা চিন্তা করে এমন সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী হন না। আমাদের ঢাকার বাইরের দর্শকের কথা চিন্তা করতে হয়। তারাই সিনেমার মূল দর্শক।’
কেবল শহুরে মধ্যবিত্ত দর্শকের জন্য গোয়েন্দাধর্মী সিনেমা নির্মিত হতে পারে না? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আগে শহুরে দর্শকের সংখ্যা জানতে হবে। কলকাতায় সিনেপ্লেক্সে মুক্তি দিয়ে এ ধরনের সিনেমার লগ্নিকৃত টাকা উঠিয়ে আনতে পারেন প্রযোজক। আমাদের কিন্তু তেমন সিনেপ্লেক্স নেই। তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের দর্শকের চিন্তা মাথায় নিয়েই সিনেমার চিত্রনাট্য লিখি। ঢাকার দর্শকের কাছে যে সিনেমাটি ভালো লাগবে, তা ঢাকার বাইরের মানুষের কাছে ভালো লাগবে না। রুচির পার্থক্য আছে। রুচিশীল দর্শক সিনেমা হলে যান কম।’
এদিকে গোয়েন্দা সিনেমা নির্মাণ না হওয়ার পেছনে ভালো চিত্রনাট্যের অভাবকে দুষছেন প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরু। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে কলকাতার মতো প্রচুর গোয়েন্দাধর্মী সিনেমা দেখার দর্শক আছেন। কিন্তু কেউ সে রকম চিত্রনাট্য আমাদের কাছে নিয়ে আসেন না। অথচ বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র আছে। আমরাও চাই তাদের পর্দায় আনতে। কোনো পরিচালক যদি গোয়েন্দা গল্পের চিত্রনাট্য নিয়ে আসেন, তাহলে তাকে আমরা ফেরাব না।’
ঢালিউডে গোয়েন্দা গল্পের সিনেমা না হওয়ার কারণ অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলেন কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অ্যাডজাঙ্কট্ ফ্যাকাল্টি সৌভিক দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে দীর্ঘকাল ধরে গোয়েন্দা উপন্যাস লেখার প্রচলন আছে। অনেক আইকনিক গোয়েন্দা চরিত্র আছেÑব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা বা প্রদোষ মিত্র, হুকাকাশি, কর্নেল, মিতিন মাসি। এমনকি ছোটদের জন্য গোগোল বা পাণ্ডব গোয়েন্দা। পরবর্তীকালেও অনেকে এসেছেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ মিত্র, সমরেশ বসুর মতো সাহিত্যিক আলাদাভাবে গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন, গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করেছেন।’
সৌভিক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সেই অর্থে গোয়েন্দা সাহিত্য বা চরিত্র তৈরি হয়নি। তিন গোয়েন্দা ছাড়া আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। মিসির আলি সে অর্থে গোয়েন্দা নয়। গোয়েন্দা সাহিত্যকে খুব একটা সিরিয়াস সাহিত্য বলে বোধহয় মনে করা হয়নি। আমার ধারণা বাংলাদেশে গোয়েন্দা সিনেমা-সিরিজ না হওয়ার এটা বড় কারণ।’
চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা একটা জায়গায় একমতÑগোয়েন্দা গল্পের সিনেমার দর্শক পদ্মাপারের এ দেশটিতে আছে। কিন্তু গাঁটের টাকা খরচ করে সিনেমা হলে গিয়ে দেখার মানসিকতা কম! ড্রয়িংরুম কিংবা হালের জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে অল্প খরচে এ ধরনের বিদেশি সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তারা। তবে সেই সংখ্যাও সীমিত। তাই এখানে বইয়ের পাতায়ই সীমাবদ্ধ থাকছে গোয়েন্দা চরিত্র।