সেলিম আহমেদ ও শোয়াইব আহমেদ
প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৩৯ এএম
আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৩০ এএম
বুয়েটের প্রশাসনিক ভবনের সামনে রবিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারীরা। দুজন শিক্ষার্থী লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। প্রবা ফটো
মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগে আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে তিন দিন ধরে আন্দোলন করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের এই আন্দোলন নিয়েও এরই মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত তৈরি হয়েছে।
একটি পক্ষের অভিযোগ, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বললেও আন্দোলনকারীদের মূল টার্গেট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ঠেকানো। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে এই আন্দোলনের ফায়দা লুটছে ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরসহ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। ছাত্রদলসহ অন্যান্য সংগঠনও এই সুযোগে বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকতে চায়। তাদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় গোপনে এসব সংগঠন শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। চলমান আন্দোলনেও তাদের ইন্ধন থাকার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
অন্যদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না চাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মতাদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়। আমরা চাই না- ক্ষমতার লোভ ও অপচর্চা আবারও এসে আমাদের শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে ফেলুক। আমরা সবাই গর্বের সঙ্গে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনার চর্চা আমাদের অন্তরে লালন করি। আমরা হিযবুত তাহরীরের সম্পূর্ণ বিপক্ষে এবং কারও শিবির-সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তার বহিষ্কার চাই।’
রবিবার (৩১ মার্চ) বিকালে বুয়েটের ড. এমএ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীরা এসব কথা বলেন।
গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টিকে কালো আইন উল্লেখ করে সেখানে অবিলম্বে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু করার আহ্বান জানিয়েছেন ছাত্রলীগ নেতারা।
নানামুখী স্বার্থের খেলায় বুয়েটের পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। চলমান আন্দোলন কোন পথে যাচ্ছে, এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। ওই ঘটনায় করা মামলার রায় হয় ২০২১ সালে। রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। বুয়েট কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির ২৬ ছাত্রকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ হয়। ওই বিক্ষোভের মুখে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
এরপর সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও গত বুধবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে নেতাকর্মীদের একটি বহর বুয়েট ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করে। ওই ঘটনাকে ন্যক্কারজনক আখ্যা দিয়ে শুক্রবার বিকাল থেকে পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ।
শুক্র ও শনিবার আন্দোলনের পর গতকাল রবিবারও আন্দোলনের ডাক দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। একই দিন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবিতে পাল্টাকর্মসূচি দেয় ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা গতকাল ক্যাম্পাসে অবস্থান নেননি। বিকালে লিখিত বক্তব্যে আন্দোলনকারীরা জানান, নিরাপত্তাজনিত তীব্র শঙ্কার কারণে কেউ কোনো ধরনের সমাগম করেনি। নিরাপত্তার কারণে রবিবার ক্যাম্পাসে অবস্থান না নেওয়ার মানে এই নয় যে, বুয়েট শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্ররাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের দাবি থেকে সরে এসেছে।
ছাত্রলীগের সমাবেশে সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলা কি সমাধান? বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কালাকানুন বাতিল করতে হবে। আইন অনুসারে গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
বুধবার রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই দিন তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বুয়েটের ভেতরে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে গিয়েছিলেন। বৃষ্টির কারণে তখন ক্যাফেটেরিয়াতে যান।
আন্দোলনের ‘ইন্ধনদাতা’ কারা
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি আদৌ বন্ধ রয়েছে কি না এবং চলমান আন্দোলনের পেছনে কারও ইন্ধন আছে কি নাÑ তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষার্থী ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা হয়। তারা কেউ কেউ জানান, প্রত্যক্ষ কমিটি না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সক্রিয় ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। এর মধ্যে ছাত্রশিবির, হিযবুত তাহরীর, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনের অবস্থান ছিল শক্তিশালী। তারা অনেকটা গোপনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। এ সময় তারা গত বছরের ৩০ জুলাই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বুয়েটের ২৪ শিক্ষার্থীর শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরেন। ওই ঘটনায় বুয়েট কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের একাধিক নেতাও দাবি করেছেন, বুয়েটে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম রয়েছে।
কয়েক শিক্ষার্থী আরও জানান, সম্প্রতি বুয়েট শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক ইমেইলে পাঠানো হয়েছে হিযবুত তাহরীরের একটি জিহাদি মেইল। প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষার্থীর ইমেইলে জিহাদি বার্তা পাঠানো হলেও সর্বশেষ তথ্য অনুসারে সব শিক্ষার্থীর রোল নম্বর ধরে একাধারে সেটি পাঠানো হচ্ছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রম শুধু ইমেইলে সীমাবদ্ধ নেই, বুয়েটের বিভিন্ন হলের দেয়ালে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এমন কিছু কিউআর কোড- যা স্ক্যান করলে চলে আসে হিযবুত তাহরীরের জিহাদি বার্তা। এ ছাড়াও বুয়েটের এই আন্দোলন উস্কে দেওয়ার পেছনে ছাত্রশিবির তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন টেলিগ্রাম গ্রুপ বাঁশের কেল্লায় ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেÑ এমন অভিযোগও রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী জানান, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ঠেকানো গেলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে শিবির-হিযবুত তাহরীরসহ অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন। কারণ এখন তারা ক্যাম্পাসে কৌশলে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ছাত্রলীগ এলে তা পারবে না। সেই আশঙ্কা থেকেই তারা এই আন্দোলনকে উস্কে দিয়ে ফায়দা লুটতে চায়।
গত শনিবার বুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঁচ শিক্ষার্থী। সেখানে তাদের একজন তানভীর মাহমুদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে একটি অন্ধকার সংগঠনের ইন্ধনে বুয়েটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। বুয়েটে কার্যক্রম চালাচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির হয়ে যিনিই কথা বলছেন, তাকেই ছাত্রলীগ ট্যাগ দিয়ে অত্যাচার করা হচ্ছে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী গতকাল জানান, ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হন বুয়েটের শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি। এ ছাড়াও ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল সন্দেহভাজন হেফাজতকর্মীর হামলায় গুরুতর আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগকর্মী আরিফ রায়হান দীপ। এরপর ২ জুলাই ভোরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির সর্বশেষ বলি হন আবরার ফাহাদ। এ ছাড়াও ক্যাম্পাসে যখন ছাত্ররাজনীতি ছিল তখন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য বিরাজ করেছে। এ নিয়ে নানা সময় সংঘর্ষ, হলের সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। তাই এখন আবার ছাত্ররাজনীতি ফিরলে সেসব ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছেন তারা। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি আর না ফেরানোই তারা সমীচীন মনে করেন।
বুয়েট শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বর্জন
ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে উত্তাল বুয়েট শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা বর্জন করেছেন। গতকাল ২০তম ব্যাচের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় একজন ব্যতীত সব শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০তম ব্যাচের ১ হাজার ২১৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ হাজার ২১৪ জনই রবিবার পরীক্ষায় অংশ নেননি। গত শনিবার ২২তম ব্যাচের প্রথম টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাতেও কোনো শিক্ষার্থীই অংশগ্রহণ করেননি।
যা বললেন উপাচার্য
ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে বুয়েট উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেছেন, তখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে তাদের আবার উদ্যোগী হতে হবে।
তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে বুয়েট ক্যাম্পাসে আবারও ছাত্ররাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হবে। রাজনীতি না করলে শিক্ষার্থীদের চোখ খুলবে না, দেশের প্রতি তাদের প্রেম আসবে না। এই বিষয়গুলো তারা (শিক্ষার্থী ও শিক্ষক) চিন্তা করে যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে (ছাত্র) রাজনীতি ওপেন হতে পারে।
ক্যাম্পাসে উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রমের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, আমরা ক্লাসে সবাইকে ছাত্র বা শিক্ষার্থী হিসেবে দেখি। এর বাইরে তারা কী ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, সেটা দেখার জন্য আমাদের কোনো মেকানিজম নেই। আমরা শুধু তথ্য দিতে পারব। আমরা পরীক্ষা বা একাডেমিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। কিন্তু যদি কোনো রাষ্ট্রীয় বিষয় হয়, তাহলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
বুয়েট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ডিবি
আন্দোলনের নামে নিষিদ্ধ-ঘোষিত বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। সেখানে আমাদের টিম রয়েছে। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করছি। তদন্ত করে পরবর্তীকালে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ আন্দোলনের সংশ্লিষ্টতায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি।