বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪ ২২:২৬ পিএম
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৪ ০৯:০৮ এএম
বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রবেশকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা। প্রবা ফটো
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের প্রবেশকে কেন্দ্র করে ফের উত্তাল হয়ে উঠল বুয়েট। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ছাত্রলীগের একটি দল বুয়েটে প্রবেশের পর শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন- আবরার ফাহাদ হত্যার পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও গতকাল গভীর রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালান। এর প্রতিবাদে শুক্রবার দিনব্যাপী আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগ নেতাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ ও কার্যক্রমে জড়িতের অভিযোগে থাকায় বুয়েটের ২১ ব্যাচের এক শিক্ষার্থীর হলের আবাসিকতা (আসন) বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে।
শুক্রবার (২৯ মার্চ) রাত সাড়ে ৯টার দিকে বুয়েটের রেজিস্ট্রার ড. মো. ফোরকান উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, ২৮ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সেগুলো হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হলো। এছাড়া সার্বিক বিষয়ে তদন্তপূর্বক সুপারিশ প্রদান করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর টার্ম/সেমিস্টার ফাইনালসহ সকল একাডেমিক কার্যক্রম চলমান থাকবে।’
গভীর রাতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের প্রবেশের প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে এক সংবাদ সম্মেলন করেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। সংবাদ সম্মেলনে ৩০ ও ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেন তারা।
একই সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে তারা ছয়টি দাবি উত্থাপন করেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দেন তারা। এর আগে দুপুরে ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনের পর মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। এসময় তারা ‘ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা এই বুয়েটে হবে না’, ‘বুয়েট থেকে করব ছাড়া, পলিটিকসে যুক্ত যারা’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। রাত ৮টায় প্রথম দিনের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করে শিক্ষার্থীরা।
পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন, আগামীকাল (শনিবার) সকাল ৮টা থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রবেশদ্বারে অবস্থান করবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সমস্ত একাডেমিক ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন।
শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সন্ধ্যার পর মিটিংয়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে ছাত্রলীগের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকায় বুয়েটের ২১ ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হবে বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
২০১৯ সালে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। এরই মধ্যে গত ২৮ মার্চ মধ্যরাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের প্রবেশের পর শিক্ষার্থীরা শঙ্কা করছেন, ক্যাম্পাসে নতুনভাবে ছাত্ররাজনীতি ফেরানোর পাঁয়তারা চলছে। তারই প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন।
বুয়েটে ছাত্রলীগের নেতাদের প্রোগ্রামের ঘটনাটিকে ‘ন্যক্কারজনক’ উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, ২৮ মার্চ রাত ১টার দিকে আমরা জানতে পারি, বুয়েটে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা এসেছেন এবং তারা ক্যাম্পাসের মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। রাত সাড়ে ১০টার পর যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারে না, সেখানে রাজনৈতিক বহিরাগতরা কীভাবে ঢুকল?
তাদের দাবি, বিপুল সংখ্যক বহিরাগত লোক মিছিলের মতো করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকেন। এসময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের চিনতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পরও ক্যাম্পাসে রাতের আঁধারে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা ক্যাম্পাসের মর্যাদার প্রতি তীব্র অপমানজনক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রকল্যাণ পরিদফতর কোনোভাবেই কি ন্যক্কারজনক এ ঘটনার দায় এড়াতে পারে?
যা বলছেন ছাত্রলীগ সভাপতি
গভীর রাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশে বলেন, ‘আমি যাইনি, ওদিকে আসার পথে দেখা হয়েছে।’
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে তিনি বলেন, ‘বুয়েটের শিক্ষার্থীদের যে সংবেদনশীলতা রয়েছে, একটি স্পিড নিয়ে আন্দোলন করেছে; শিক্ষার্থীদের এ অবস্থানকে স্বাগত জানাই। ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতির জন্য তারা একটি বার্তা দিচ্ছে। বুয়েটের ছাত্ররাজনীতির কাঠামো কেমন হবে, তা বুয়েটের শিক্ষার্থীরাই নির্ধারণ করবে। একজন শিক্ষার্থীর যেমন রাজনীতি না করার অধিকার রয়েছে, তেমনি রাজনীতি করারও অধিকার রয়েছে। ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে সমৃদ্ধ করে।’
সাদ্দাম হোসেন আরও বলেন, ‘নেতিবাচক ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের যে অবস্থান— মূল্যবোধ, তার প্রতি বুয়েট প্রশাসনের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। একইসঙ্গে একজন শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং জাতির পিতার আদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে মানসিক নিপীড়নের শিকার হন, সেক্ষেত্রেও তাকেও নিরাপত্তা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক দায়িত্ব। এর ব্যতয় ঘটলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নেব, আমরা মনে করি— প্রশাসনের থাকার কোনো নৈতিক অবস্থান নেই।’
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্পষ্ট বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে বুয়েটের সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২৮ মার্চের মধ্যরাতে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক ২১তম ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বির বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার ও হলের আসন বাতিল করা; ইমতিয়াজের সঙ্গে বুয়েটের বাকি যেসব শিক্ষার্থী জড়িত ছিল, তাদের বিভিন্ন মেয়াদে হল ও টার্ম বহিষ্কার করা; বহিরাগত রাজনৈতিক যারা ক্যাম্পাসে ঢুকেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তারা কেন, কীভাবে প্রবেশের অনুমতি পেল, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট জবাবদিহি বুয়েট প্রশাসনকে দিতে হবে; উপরোক্ত ১ ও ২ নম্বর দাবি আগামীকাল সকাল ৯টার মধ্যে বাস্তবায়ন করা না হলে সব ব্যাচের শিক্ষার্থী ডিএসডাবলুর (ছাত্রকল্যাণ পরিচালক) পদত্যাগ করতে হবে; ক্যাম্পাসে মধ্যরাতে বহিরাগতদের প্রবেশের কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এর প্রতিবাদ হিসেবে ৩০ ও ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনালসহ সব অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জন এবং আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।