প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৪ ১৩:০৩ পিএম
আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৪ ১৫:০২ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পর এবার ‘দুর্বল’ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ৫০ জনের কম শিক্ষার্থী রয়েছে এমন ৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করার তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। বিগত ১০ বছরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ।
একত্র করার জন্য প্রস্তাবিত স্কুলের নাম, শিক্ষার্থী সংখ্যা, জমির পরিমাণ, যে স্কুলের সঙ্গে একত্র করা হবে তার নাম, বর্তমান বিদ্যালয় থেকে একত্র করার জন্য প্রস্তাবিত স্কুলের দূরত্ব ও প্রস্তাবিত স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যার বিষয়গুলো আমলে নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫টি ক্লাসে ৫০ জন শিক্ষার্থী না থাকার পরও এসব বিদ্যালয় বছরের পর বছর চালানো মানেই রাষ্ট্রীয় অপচয়। কাছের স্কুলের সঙ্গে একীভূত করলে সরকারের খরচ কমার পাশাপাশি শিক্ষার মানও বাড়বে। তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমতও রয়েছে অনেকের। তারা বলছেন, মানহীন শিক্ষক, পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও পড়ালেখার মান ভালো না থাকার কারণে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি করান না অভিভাবকরা। এই সুবাদে যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন-মাদ্রাসাসহ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। তাই এসব নিয়ন্ত্রণ না করে শিক্ষার্থী সংকটের দোহাই দিয়ে জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় বিলুপ্ত করা সমীচীন নয়।
শিক্ষাবিদরা বলেন, প্রাথমিকে শিক্ষক সংকট শুরু থেকেই ছিল। এই সংকটের কারণে প্রাথমিক শিক্ষার মান তলানিতে রয়েছে। ফলে অভিভাবকেরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর আস্থা হারিয়ে তাদের সন্তানদের অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। শিক্ষার্থী কম থাকায় জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় একীভূত করা অনেকটা মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্তের মতো। নিরাময়ের ব্যবস্থা না করা হলে প্রতি বছর আরও শত শত প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংকটে বিলুপ্ত হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় তৃণমূলের শিক্ষক, কর্মকর্তাদের কঠোর জবাবদিহিতা, শিক্ষক সংকট দূর করা, যত্রতত্র বেসরকারি বিদ্যালয় বা মাদ্রাসা গড়ে তোলা থেকে বিরত রাখতে পারলে এই সংকট দূর হবে।
এ প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এই বিষয়ে এখনই মতামত দেওয়া যাবে না। আমরা স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে শিগগির প্রতিক্রিয়া জানাব।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের ৫৬ জেলায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৫০ জনের কম শিক্ষার্থী রয়েছে, এমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৪৪। বিগত ১০ বছরের শিক্ষার্থীর ধারাবাহিকতা যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে যে, প্রতি বছরই ৫০ জনের কম শিক্ষার্থী ছিল এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০০। এ স্কুলগুলোকে পাশের স্কুলের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে সচিব ফরিদ আহাম্মদ এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রেই (ইন জেনারেল) এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। স্থানীয় বাস্তবতা, প্রেক্ষাপট ও পারিপার্শ্বিকতা সবকিছু বিবেচনায় এনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বরিশালের একটি বিদ্যালয়ের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত থেকে আট। পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে সাত থেকে আটজন শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে। এ রকম বিদ্যালয়ের সংখ্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই স্কুলগুলোর সংখ্যা তিনশর কাছাকাছি। যাদের একীভূত করা হবে। যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০-এর নিচে, সেগুলোর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেগুলোতে ১০ বছর ধরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০-এর নিচে, সেগুলোকে পার্শ্ববর্তী অন্য ভালো বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা হবে।
ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘আমরা চাই, যে বিদ্যালয়গুলোয় ৫ থেকে ১০ জন শিক্ষার্থী আছে, সেগুলোকে একীভূত করে দেব। আর যে বিদ্যালয়গুলোর চাহিদা আছে, সেই বিদ্যালয়গুলোয় যা যা সুবিধা দেওয়ার, সেগুলো দেব।’
এক প্রশ্নের জবাবে ফরিদ আহাম্মদ এ বিষয়ে আরও ব্যাখ্যা দেন। তার ব্যাখ্যার মূল বক্তব্য হলো, পঞ্চাশের নিচে শিক্ষার্থী থাকা সব বিদ্যালয়কে একীভূত করা হবে না। স্থানীয় বাস্তবতা, প্রেক্ষাপট ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নিয়ে এই কাজ করা হবে।
তবে এ ধরনের সব বিদ্যালয় বন্ধ হবে না জানিয়ে ফরিদ আহাম্মদ উদাহরণ দিয়ে বলেন, রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৪২। কয়েক বছর ধরেই এ সংখ্যা ৪২। কিন্তু এই বিদ্যালয় একীভূত করা হবে না। কারণ এই ৪২ জন শিক্ষার্থী ৭ থেকে ৮ কিলোমিটারের জায়গার মধ্যে থেকে আসে। এমন প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, ২০১৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে ২৬ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত রেজিস্টার্ড, আন-রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি বিদ্যালয় সরকারীকরণ করা হয়। এদের মধ্যে প্রায় ২১ হাজার শিক্ষক ছিলেন যোগ্যতাবিহীন। বারবার সময় দেওয়ার পরও তারা যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। আবার অনেক স্কুলে ছিল নামমাত্র শিক্ষার্থী। গোঁজামিল তথ্য দিয়ে স্কুলগুলো চালাচ্ছেন কিছু শিক্ষক। তারা বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন।
প্রাথমিকে কমছে শিক্ষার্থী সংখ্যা
বেশ কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষাবিদ জানান, কয়েক বছর ধরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। এর কারণÑ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দক্ষ শিক্ষক ও অবকাঠামোর অভাব। এছাড়া অনেক স্কুলে রয়েছে শিক্ষক সংকট। যারা আছেন তারা শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো পাঠদান করেন না। ফলে শিক্ষার মান খারাপ হচ্ছে। এ কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। আর সেই সুযোগ নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যত্রতত্র গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসা। এসব বিদ্যালয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
খোদ সরকারি হিসাবেও উঠে এসেছে এই চিত্র। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ২০২০ সালের জরিপ নিয়ে প্রকাশ করেছে ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২১’। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮৬ লাখ ২৯ হাজার ৮৮ জন। এরপর প্রতি বছর বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে কমেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০২১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৯৬৭ জনে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২২ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয়শুমারিতেও (এপিএসসি) উঠে এসেছে একই ছিত্র। ২০২৩ সালে প্রকাশিত শুমারির তথ্য বলছে, ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি (কিন্ডারগার্টেনসহ) প্রাথমিক স্কুল ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ২টি। ২০২১ সালে কমে হয় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি। আর ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টিতে; যার মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে প্রাথমিক বিদ্যালয় কমেছে ১৮ হাজার ৪৬৩টি। মূলত কমেছে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও ফেনীর ডিসি এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, তার জেলায় যত্রতত্র এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও আশঙ্কাজনকভাবে উপস্থিতি কমতে দেখা গেছে।
বিষয়টি সবার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ দাবি করে সেদিন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় নিবন্ধন ছাড়াই যত্রতত্র গড়ে উঠছে কওমি ও নূরানি মাদ্রাসা। সে কারণে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর হার কমছে। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন ডিসিরা।
ডিসিদের বক্তব্য তুলে ধরে ওইদিন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কখন শিক্ষার্থীরা স্কুলগুলোতে ভর্তি হয়, সেই সময়টাতে এসব (অনিবন্ধিত মাদ্রাসা) প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা যায় কি না, সেগুলো নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে আলোচনা করব। তবে অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর হার বাড়বে, আর নিবন্ধিত ও সরকারের শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী কমবে, এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। বিষয়টি আমাদের সবসময় মাথায় রাখতে হবে।
একীভূত করার সিদ্ধান্ত হলো যেভাবে
২০২২ সালে দেশের একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খান। তিনি পঞ্চাশের কম শিক্ষার্থী থাকা বিদ্যালয়গুলোকে কাছাকাছি দূরত্বের বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেন। এরপর গত বছর ৭ ডিসেম্বর অধিদপ্তরের পলিসি ও অপারেশন শাখার পরিচালক মনীশ চাকমা স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, অধিদপ্তরের মাসিক সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পঞ্চাশের কম শিক্ষার্থী এমন স্কুলের বিষয়ে বিভাগীয় উপপরিচালকদের কাছে প্রস্তাবনা চাওয়া হয়েছে। এরপর দেখা যায়, দেশের ৫৬টি জেলায় ৯৯৪ স্কুলে ৫০ জন শিক্ষার্থী নেই। এ তালিকার বেশিরভাগই জাতীয়করণ করা বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৪ থেকে ৩০ জন। কোথাও কাগজে-কলমে ১৩ থেকে ১৪ জন হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ প্রতি মাসে সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। সেই তালিকা ধরে এখন এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩০০ স্কুলকে পাশের স্কুলের সঙ্গে একীভূত করা হবে।