মো. মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:০০ এএম
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৪৩ পিএম
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি : সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দের পদত্যাগ দাবিতে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। অনেকেই মনে করছেন, ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ যথাযথ কার্যকর না হওয়াই শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মুখোমুখি অবস্থানের প্রকৃত কারণ। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পর্ষদের সমন্বয়ের মাধ্যমে তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিচ্ছেন সিনিয়র শিক্ষকরা।
শিক্ষক সমিতির দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সমুন্নত রাখতে এ দুইজনের পদত্যাগের বিকল্প পথ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট আইন থাকলেও উপাচার্য আইনের তোয়াক্কা না করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাচারিতা কায়েম করেছেন। উপ-উপাচার্য বেনু কুমার উপাচার্যকে সতর্ক করার পরিবর্তে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গী হয়ে তিনিও এই পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন।
তবে এসব অভিযোগ বারবার অস্বীকার করছেন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে শিক্ষক সমিতি নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই আন্দোলন করছে। শিক্ষক সমিতি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সিন্ডিকেট নির্বাচন, অতিরিক্ত নিয়োগ বন্ধ, শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তদন্ত, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের মাধ্যমে নিয়োগ ও পদোন্নতি বোর্ড পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে আসছে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার হাছান মিয়া বলছেন, শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্ল্যানিং কমিটি তিন মাসের মধ্যে সুপারিশ না করলে উপাচার্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিতে পারবেন। ১৯৯৪ সালের সিন্ডিকেট আইন উপাচার্যকে এই ক্ষমতা দিয়েছে। এ ছাড়া ইউজিসির একটা নির্দেশনাও আছে, অবসরজনিত শূন্য পদগুলো সংশ্লিষ্ট অর্থবছরেই পূরণ করতে হবে। সর্বোপরি আইন মেনেই এই নিয়োগগুলো হচ্ছে।
গত ৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত বাংলা ও আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। চিঠিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধি-৯ যথাযথভাবে প্রতিপালন না করে সেসব বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের কার্যক্রম চলছে তা স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হলো। কিন্তু ইউজিসির নির্দেশকে তোয়াক্কা করেননি উপাচার্য। দুই বিশেষজ্ঞের অনুপস্থিতেই নাট্যকলা বিভাগে শিক্ষক নির্বাচনী নিয়োগ বোর্ড সম্পন্ন করেছেন তিনি। আর ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদ বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কোরাম পূর্ণ হয়েছে। তাই বোর্ড হয়েছে।’ এর জবাবে শিক্ষক সমিতি বলছে, প্রশাসন কোরাম পূর্ণ হওয়ার কথা বললেও দুইজন বিশেষজ্ঞ ছাড়া এই নিয়োগ বোর্ড বসানো উচিত হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের দাবি, ’৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি পরিচালিত না হওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। আবার অনেকে বলছেন, এই আইনের বয়স ৫০ বছরের অধিক। যুগের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে এর হালনাগাদ জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব আইন মানা হচ্ছে না
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এর ১২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য (রাষ্ট্রপতি) সিনেট মনোনীত তিনজনের একটি প্যানেল থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকরা বলছেন, এখানে এ আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এখানে সর্বশেষ সিনেট মনোনীত উপাচার্য নিয়োগ হয় ১৯৮৮ সালে।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন সিরাজ উদ দৌলাহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকট সৃষ্টির কারণ ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুসরণ না করা। এই সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী একটি কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেট। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতি থেকে শুরু করে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সিন্ডিকেটে। উপাচার্য পদাধিকার বলে এই পর্ষদের সভাপতি। বর্তমানে এ পর্ষদের ১৭টি পদের মধ্যে ৫টিই শূন্য। একজন সদস্য আছেন যিনি এই পদে পরবর্তী প্রতিনিধি না আসায় ২৮ বছর ধরে সিন্ডিকেট সদস্য। সিন্ডিকেটে ডিন ক্যাটাগরির পদে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১২ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর। সিন্ডিকেটে ডিন ক্যাটাগরিতে নির্বাচন দিতে ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর উপাচার্যকে চিঠি দেন সব অনুষদের ডিন। তখন বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন উপাচার্য ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন। এ ঘটনা নানা আলোচনার জন্ম দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সিন্ডিকেটে সিনেট মনোনীত দুইজন প্রতিনিধি থাকবেন। এদের মধ্যে একজন হবেন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি, অন্যজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রতিনিধি। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে দুই বছরের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয় এসএম ফজলুল হক ও অধ্যাপক ড. আবদুল করিমকে। আবদুল করিম ২০০৭ সালে মারা যাওয়ার পর থেকে এই পদটি শূন্য। অন্যদিকে এসএম ফজলুল হক ২৮ বছর ধরে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে রয়ে গেছেন।
সিন্ডিকেট সদস্য ড. নঈম উদ্দিন হাসান আওরঙ্গজেব চৌধুরী বলেন, সিন্ডিকেট নির্বাচন দেওয়ার এখতিয়ার উপাচার্যের। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ছয়জন শিক্ষক প্রতিনিধি থাকার কথা। সেখানে চারজন আছেন। দুইজন নেই। বাকি দুই ক্যাটাগরিতেও শিক্ষক প্রতিনিধি থাকলে সিন্ডিকেট আরও প্রতিনিধিত্বশীল হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিনেট। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করা হয়। কিন্তু কয়েক দশক ধরে সিনেটের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নির্বাচন হচ্ছে না। মোট ১২টি ক্যাটাগরিতে ১০১ জন সিনেট সদস্য থাকার কথা। সর্বশেষ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি (২৫ জন) নির্বাচন হয় ১৯৮৬ সালে। ২৫টি পদের মধ্যে ৯টি পদ অবসরজনিত কারণে শূন্য। সিনেটে সর্বশেষ শিক্ষক প্রতিনিধি (৩৩ জন) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালে। এর অবসরজনিত শূন্য পদ ৭টি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এর ২২নং ধারা অনুযায়ী, সিনেটের ১০১ সদস্যের পাঁচজন হবেন ছাত্র প্রতিনিধি, যারা শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। চাকসু নির্বাচন না হওয়ায় ৩৪ বছর ধরে সিনেটে শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। ফলে শিক্ষার্থী-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোয় সংকট চলছে।
রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, ‘যে পর্ষদগুলো আছে বিশেষ করে সিনেট ও সিন্ডিকেট তা পরিপূর্ণভাবে গঠন করা উচিত। তাহলে সমস্যাগুলো কমবে বলে আমি মনে করি।’ তিনি বলেন, এই সংকটের মূল কারণ আইন অমান্য করার সংস্কৃতি। বিভিন্ন অভিযোগ বিষয়ে প্রশাসন, শিক্ষক সমিতি, ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুদক প্রতিনিধি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। তাহলে আসল বিষয়টি বেরিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি।
কিন্তু গত বছরের ২৯ অক্টোবর ‘শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড’ পুনর্গঠনে উপাচার্যকে অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান চিঠি দিলেও তা আমলে নিচ্ছেন না চবি উপাচার্য। চিঠি দেওয়ার পর তিনটি সিন্ডিকেট সভা হলেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি উপাচার্য। সম্প্রতি চিঠির বিষয়টি গণমাধ্যমে আসে।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী বলেন, আমরা কখনোই উপাচার্যের পদত্যাগ চাইনি। বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী চলছে না। উপাচার্য যেমন ইচ্ছা তেমন করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। এ কারণে আমরা বারবার প্রশাসনকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন দাবি জানালেও তারা তা বাস্তবায়ন করছেন না। তাই আমরা বাধ্য হয়ে এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইফতেখার চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় এখন গভীর অন্ধকার কূপে পড়ে গেছে। সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আইন দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেই এই আইনের অপব্যবহার করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগ পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি পরে কথা বলবেন জানিয়ে আর কথা বলেননি। কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীরকে ফোন করা হলে তিনিও সাড়া দেননি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানকে বারবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। উপাচার্য শিরীণ আখতারের কার্যালয়ে একাধিকবার গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।