পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হচ্ছে সরকারি কলেজ
সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৯ এএম
আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:০০ এএম
ছবি : সংগৃহীত
অনার্স-মাস্টার্স স্তরের সব সরকারি কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব আবারও পেতে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুরুতেই অনার্স কোর্স চালু না করে সরকারি কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। সেক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হয়ে দাঁড়াবে কেবল বেসরকারি কলেজগুলোর কার্যক্রম তদারকি করা।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে উচ্চশিক্ষার মান ফেরানোর সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা। তবে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিয়েও তাদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। তাদের মতে, সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করায় যেমন কিছু সাফল্য এসেছে, তেমনি সমন্বয় নিয়ে সংকটও রয়েছে। এখন হুট করে দায়িত্ব না দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা যাচাই, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তৈরি করা উচিত। পূর্ণ প্রস্তুতি না নিয়ে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে জাতীয় শিক্ষানীতির সংশ্লিষ্ট অংশ পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অথবা বিধি সংশোধন করার প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে ইউজিসি বলছে, তারা এ-সংক্রান্ত কোনো চিঠি এখনও পায়নি।
বর্তমানে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় চারটি। এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে অধিভুক্ত করে ব্যবস্থাপনা ও একাডেমিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পর্যায়ে অনার্স ও পাস কোর্সের তদারকি করত। কোর্স কারিকুলাম তৈরি করা, কলেজগুলোর নিবন্ধন, শিক্ষক নিয়োগ এবং চূড়ান্ত পরীক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি দেখভাল করত তারা। কিন্তু দেশে সরকারি-বেসরকারি কলেজের সংখ্যা বাড়তে থাকায় একপর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি কলেজের তদারকির দায়িত্ব পায় প্রতিষ্ঠানটি।
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ২ হাজার ২৫৭টি। আর এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে সরকারি কলেজের সংখ্যা ৫৮৩। তবে তার মধ্যে ৩৭৩টিতে স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পড়ালেখার মনোন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাদের অধিভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠানেই পর্যাপ্ত শিক্ষক কিংবা অবকাঠামো নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাসই হয় না। এ ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতা না থাকার পরও অনার্স কিংবা পাস কোর্স চালুর অনুমতি দিয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। পড়ালেখার মানোন্নয়নে নজর না দিয়ে পরীক্ষার ফরম পূরণ, রেজিস্ট্রেশন, ভর্তি এসব নিয়েই সারা বছর ব্যস্ত থাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউজিসিও একাধিকবার বলেছে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ থেকে স্নাতক সনদধারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের গুণগত মানও আশানুরূপ নয়। এতে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও শিক্ষার প্রত্যাশিত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করার সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমাতে সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার নির্দেশনা দেন। ওই নির্দেশনার পর একই বছরের ডিসেম্বরে ইউজিসির সঙ্গে বৈঠককালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা এ বিষয়ে সম্মতি দেন। কিন্তু নানা কারণে এই প্রক্রিয়া বেশি দূর এগোয়নি। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর সাতটি বড় সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো হলোÑ ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠকে বসেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর এ-সংক্রান্ত নির্দেশনার কথা তুলে ধরে উপাচার্যদের কাছে সরকারের পরিকল্পনার কথা জানান। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী উপাচার্যদের আহ্বান জানান, যেসব জেলায় সরকারি কলেজ আছে, তাদের একাডেমিক মনিটরিংয়ের কাজটা যেন ওই জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্টভাবে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন যে, নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলো হচ্ছে, সেগুলো কেন শুরুতেই আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্স করাচ্ছে। সেই জেলায় আগে থেকেই সরকারি কলেজ থাকতে পারে বা আছে, তাদের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্সগুলো মনিটরিং করুক ওই জেলার বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষামন্ত্রী জানান, এর জন্য আইন সংশোধনের প্রয়োজন হলে সরকার তা করবে।
ভালো উদ্যোগ, তবে শঙ্কাও অনেক
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি সব কলেজেরই অনেক সমস্যা আছে। সেগুলোর পড়ালেখার মান খুব একটা ভালো না। একসময় নামকরা যেসব কলেজ সেগুলোও মান হারিয়েছে। এছাড়া শিক্ষক, অবকাঠামো, অর্থায়নের নানা সংকট রয়েছে। সেগুলোর দিকে না তাকিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বদলালে লাভ কী? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেদেরই তো নানা সমস্যা। সুতরাং এটা দিয়ে আমাদের মূল যে সমস্যা তার সমাধান হবে বলে মনে হয় না।
দায়িত্ব দেওয়ার আগে সক্ষমতা যাচাই করা উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা আছে কি না সেটা যাচাই করা উচিত। শিক্ষার মতো একটা জটিল বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ না করে হুট করে করা উচিত নয়। ঢাকার সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নানা দাবি নিয়ে নিয়মিত রাস্তায় নামতে হচ্ছে।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, উদ্যোগটি খুবই ভালো। একসময় ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৫ শতাধিক কলেজ দেখভাল করত। তবে এখন কলেজের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তাই পূর্ণ প্রস্তুতি না নিয়ে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করলে মারাত্মক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যেটা সাত কলেজ নিয়ে হচ্ছে।
ইউজিসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটি একদিক দিয়ে খুবই ভালো আবার আরেকদিক থেকে সমস্যাও রয়েছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আমি শঙ্কিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো দেখভাল করবে, কিন্তু সরকারি কলেজগুলোতে ঠিকমতো শিক্ষক নেই, অবকাঠামো নেই।
অনেক জেলায় প্রতিষ্ঠিত নতুন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। আবার এমন অনেক জেলাও আছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তবে সেসব জেলার কলেজগুলোর দায়িত্ব পাশের জেলার বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসি যা বলছে
ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, শিক্ষামন্ত্রী আমাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা বলেছেন। তবে এই বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো চিঠি এখনও আসেনি। চিঠি এলে আমরা বলে দেব কোন সরকারি কলেজ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালেও আমরা একটি তালিকা করেছিলাম কোন কলেজ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাবে, সেটা নিয়ে। এখন কলেজের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, তাই চিঠি এলে আমরা নতুন করে তালিকা করে দেব।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, সরকার গুণগত মান নিশ্চিত করে শিক্ষার সম্প্রসারণ চায়। এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাবরেশনের মাধ্যমে যেমন করা যায়, আবার যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা আছে, তাদের আইন সংশোধন করে কিছু কলেজকে অধিভুক্ত করা যায়। এতে কলেজগুলো কিছুটা ভিন্ন মানের হয়ে উঠতে পারে বলে আমরা আশাবাদী।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষানীতিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়েছে, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সেটাও করা যেতে পারে।