গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:১০ পিএম
আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:১০ পিএম
দুর্ঘটনার আগের দিন বান্দরবোন সদর থেকে বগালেক যাওয়ার পথে মিলনছড়িতে তিন ভ্রমণসঙ্গীর সঙ্গে জয়নাব খাতুন (সর্বডানে)। ছবি: সংগৃহীত
জয়নবকে আমি যেদিন বাসায় নিয়ে আসি, সেদিন সকালে একসঙ্গে দুজন ব্রেকফাস্ট করলাম। দুজনে মিলে চা বানালাম। কত শত গল্প তার আগের সারা রাত বাসের ইঞ্জিনে বসে বসে। বাসে আসতে আসতে বলছিল, ‘আপু, আমার বাবা আমাকে একটু পর পর ফোন দেয়। ফোন না ধরলে খুব প্যানিক করে। তাই একবার ফোন দিলেই ধরতে হয়।’ তার প্রমাণও আমি পেয়েছি ট্যুরে গিয়ে। এই মেয়েটা এত ভালো ছিল! এখন বুঝতে পারছি কেন এত ভালো ছিল আর কেন সবাই ওকে এত ভালোবাসত। কারণ এই পৃথিবীতে ওর সময় ছিল খুবই অল্প। সবাইকে আপন করে নিতে যে মেয়ের দুই মিনিটও লাগত না- সে-ই চলে গেল সবার আগে, বান্দরবানের দুর্ঘটনায় নিহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জয়নবকে নিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করলেন ভ্রমণসঙ্গী আরফাতুন নাবিলা। প্রথমবার পাহাড় দেখার আনন্দে উৎফুল্ল ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী জয়নব খাতুন। এই ট্যুরের আয়োজক প্যানেলেরও একজন ছিলেন তিনি। হঠাৎ দুর্ঘটনায় তার কুড়িগ্রামের বাড়িতে এখন চলছে শোকের মাতম।
বান্দরবানে রুমা-বগালেক-কেওক্রাডং সড়কে গত শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ একটি পর্যটকবাহী জিপগাড়ি পাহাড়ি খাদে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীসহ দুই পর্যটক মারা যান। এ ঘটনায় ১১ জন আহত হয়েছেন। হতাহত সবাই নারী। ভ্রমণসংগঠন ‘ভ্রমণকন্যা’র হয়ে কেওক্রাডং ভ্রমণে গিয়েছিলেন তারা সবাই। পাহাড় দেখে ফেরার পথে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ৫০০ মিটার পাহাড়ি খাদে পড়ে যায়। জীবনকে অসমাপ্ত রেখেই অনন্তে পাড়ি জমালেন দুই ভ্রমণকন্যা।
এই ট্যুরের আয়োজক প্যানেলের অন্যতম আয়োজক নুসরাত জাহান রিজভী। অন্য অনেকের সঙ্গে নিজের মাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন পাহাড় দেখতে। আনন্দেই কাটছিল তাদের সময়। কিন্তু সেই আনন্দও মুহূর্তে বিষাদে পরিণত হলো। পাহাড় দেখে না ফেরার দেশে চলে গেলেন রিজভীর মা ফিরোজা বেগম। রিজভীও দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন। ভ্রমণ শেষে যেখানে আনন্দচিত্তে ঢাকার ফেরার কথা মা ও মেয়ের। সেখানে মায়ের নিথর দেহ নিয়ে শোকে বিহ্বল রিজভী এখন মাগুরায়।
পাহাড় দেখার জন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রথমবার বান্দরবানে বেড়াতে গিয়েছিল দুই স্কুলশিক্ষার্থী উষসী ও রাফাত। পাহাড়ের খাদে পড়ার পর দশম শ্রেণির ছাত্রী উষসী ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রাফাত অচেতন হয়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সহায়তায় সেখান থেকে উদ্ধারের পর প্রথম তারা বুঝতে পারে, তারা বেঁচে আছে। এর আগে তাদের বহনকারী চাঁদের গাড়ি পাহাড়ি খাদে পড়ে যেতে দেখেছে, কিন্তু তাদের কী হয়েছে আর কিছুই জানতে পারেনি। রাফাত জানায়, গাড়ি গড়িয়ে যাওয়ার সময় সে ছিটকে পড়ে একটি গাছে আটকে যায়। এরপরে আর কিছুই মনে নেই। জ্ঞান ফিরে অনুভব করে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা।
কথা হয় পর্যটকদের গাইড মুনথাং বমের সঙ্গে। তিনি বলেন, পর্যটক দলটি কেওক্রাডং দেখে ফিরছিল। এ সময় গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে উল্টে যায়। হতাহত ব্যক্তিদের প্রথমে স্থানীয় লোকজন ও সঙ্গে থাকা পর্যটকেরা উদ্ধারের চেষ্টা করেন।
ওই ভ্রমণ দলের সদস্যরা জানান, যে জিপগাড়িটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, তাতে চালকসহ ১৪ জন আরোহী ছিলেন। এর মধ্যে দুর্ঘটনার পরপরই পালিয়ে গেছেন চালক।
দুর্ঘটনাকবলিত চাঁদের গাড়িটির ঠিক পেছনের গাড়িতে ছিলেন মিথিলা। তিনি জানান, ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ-ভ্রমণকন্যা সংগঠন থেকে তারা ৫৭ জনের একটি দল কেওক্রাডং ভ্রমণে গিয়েছিলেন। পাঁচটি চাঁদের গাড়ি নিয়ে গত শুক্রবার বান্দরবান জেলা শহর থেকে তারা বগালেকে গিয়েছিলেন। শনিবার সকালে কেওক্রাডং পাহাড়চূড়ায় ভ্রমণ শেষে একসঙ্গে ফিরছিলেন। পাহাড়ি সড়ক দিয়ে নামার সময় একটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুহূর্তের মধ্যে খাদে পড়ে গেলে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনার শিকার জিপগাড়ির সামনের গাড়িতে ছিলেন ভ্রমণ দলের সদস্য চিকিৎসক কামরুন্নাহার। তিনি বলেন, ভ্রমণকন্যা সংগঠন থেকে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে তারা ঘুরে বেড়ান। এবার ২২৬তম ভ্রমণে কেওক্রাডং পাহাড়ে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হলেন।
ভ্রমণকন্যার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গাড়িচালকের বিরুদ্ধে ভ্রমণকন্যার পক্ষ থেকে পুলিশই বাদী হয়ে মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আহত ১১ জনের মধ্যে ৩ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকিরা বান্দরবান সদর হাসপাতালে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।