সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৪৮ এএম
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:১৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে এক মাসেরও কম সময় বাকি। অথচ এখনও ছাপাই শুরু হয়নি প্রায় ৯ কোটি বই। যেসব বই ছাপা হয়েছে, সেগুলোও নানা জটিলতায় মাঠপর্যায়ে পৌঁছানো যাচ্ছে না। এদিকে নতুন শিক্ষাক্রমের অষ্টম ও নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের পাণ্ডুলিপিই এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আবার যেসব বই ছাপা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই গতবারের থেকেও নিম্ন মানের কাগজে ছাপা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব মিলিয়ে গত দুই বছরের মতো এবারও সরকারি পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে ‘লেজেগোবরে’ অবস্থা দেখা দিয়েছে।
এনসিটিবি সূত্র জানাচ্ছে, এ অবস্থায় আগামী বছর আর প্রতিবছরের প্রথম দিনের মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের নতুন বই তুলে দেওয়ার উৎসব করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সংসদ নির্বাচনকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে ইতোমধ্যে পেছানো হয়েছে বই উৎসব। যদিও এর জন্য দায়ী মূলত পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ না হওয়া এবং মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দিতে না পারার ব্যর্থতা। এবার নির্বাচনের পরে ১০ অথবা ১১ জানুয়ারি বই উৎসব হবে বলে জানিয়েছে ওই সূত্র।
মুদ্রণ-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হরতাল-অবরোধের কারণে বই ছাপায় বিঘ্ন ঘটছে। এর মধ্যে নতুন সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে সময়মতো পাণ্ডুলিপি না পাওয়া। এ ছাড়া গত বছরের মতো এবারও কয়েকটি প্রেসে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতি থেকে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিলেও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। সমিতির দাবি, এনসিটিবির চেয়ারম্যানের মদদেই নিম্নমানের কাগজে বই ছাপা হচ্ছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, চলতি বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠদান শুরু হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী বছর থেকে শুরু হবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ফলে পাল্টে যাবে পুরোনো বই। গত বছর শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছে দিতে মার্চ মাস পেরিয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাব পড়েছে চলতি শিক্ষার্থীদের সিলেবাস সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে। আগামী বছরও একই অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এনসিটিবি উৎপাদন শাখা জানায়, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৩ কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রায় ৩১ কোটি বই ছাপার কাজ করছে এনসিটিবি। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের মোট বই ১৮ কোটি ৬১ লাখ ১ হাজার ২০৬। আর প্রাথমিক স্তরের বই প্রায় ৯ কোটি ৫০ লাখ। এ ছাড়া ইবতেদায়ি ও মাদ্রাসার জন্য ২ কোটি ৭১ লাখ ৭৩ হাজার ১৩৫টি বই ছাপা হবে। এবার অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই ও টিচিং গাইড (টিজি) দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল রবিবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট শাখা জানায়, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিকের প্রায় ৯০ শতাংশ বই ছাপার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। মাধ্যমিক স্তরের মোট ২১ কোটি বইয়ের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ কোটি ছাপা হয়েছে, বাকিগুলো কাজ চলছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৯ কোটি বই ছাপার কাজ বাকি।
পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত হয়নি ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের
এদিকে এখনও অষ্টম ও নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করতে পারেনি এনসিটিবি। এজন্য আরও এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। মুদ্রণকারীদের প্রশ্ন, ‘বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিতে যদি নভেম্বর পেরিয়ে যায়, তাহলে বই ছাপব কখন?’ বই ছাপার কাজের চুক্তির জন্য অর্থছাড় না মেলায়ও মাঝখানে কিছুদিন ছাপার কাজ বন্ধ ছিল।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এ বছর বইটি নিয়ে নানা বিতর্ক উঠেছিল। তাই খুব গুরুত্ব নিয়ে বইটির পাণ্ডুলিপি তিন ধাপে পর্যালোচনা করায় কিছুটা সময় লাগছে। এক সপ্তাহের মধ্যে পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করে মুদ্রণকারীদের দেওয়া হবে।
এর আগে বিতর্কের মুখে চলতি বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটির পাঠদান প্রত্যাহার করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এবারও নিম্নমানের কাগজে ছাপা হচ্ছে বই
গত বছরের মতো এবারও এনসিটিবির নির্ধারিত দর থেকে ৩৫ শতাংশ কম দরে কাজ নিচ্ছেন মুদ্রণকারীরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র সিন্ডিকেট করে বেশি কাজ নেওয়ার জন্য এনসিটিবির নির্ধারিত দর থেকে কম দরে টেন্ডার দিয়েছে। গত বছরও এ চক্রটি একই কায়দায় কাজ নিয়েছিল। পরে তারা কাগজ সংকট, পাল্পসহ নানা সংকটের অজুহাত তুলে নিম্নমানের কাজ দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানোর পর দেখা যায়, অধিকাংশ বই নিম্নমানের নিউজপ্রিন্টে ছাপানো। এবারও কাজ পেতে কম দর দেওয়ায় আগামী শিক্ষাবর্ষে নিম্নমানের কাগজের বই সরবরাহ করা হতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোয় তাদের বিরুদ্ধে নামমাত্র ব্যবস্থা নিয়েছে এনসিটিবি। মানহীন কাগজে ছাপার জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ছাপানো বই কেটে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিম্নমানের বই ছাপার জন্য এনসিটিবিকে দায়ী করছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের ভাষ্য, গত বছরসহ অতীতে যারা নিম্নমানের বই দিয়েছিল, তাদের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। ছোট ছোট কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নামমাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বড়রা ছিল অধরা। এই আশকারা পেয়ে তারা মাথায় উঠেছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষামন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে এ নিয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে এনসিটিবির সহযোগিতায় সক্ষমতার অধিক কার্যাদেশপ্রাপ্ত দুটি মুদ্রণপ্রতিষ্ঠান বোর্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে নিম্নমানের কাগজে পাঠের অযোগ্য পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে। এসব প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের (জানুয়ারি মাস) ৪-৫ মাস পরে পাঠ্যবই সরবরাহ করলেও তা এনসিটিবি নথিভুক্ত করে নাই। এনসিটিবির চেয়ারম্যানের নির্দেশে সফটওয়্যার জালিয়াতি করে এই অনিয়ম করা হয়। এবারও সেই প্রতিষ্ঠান দুটিকে সর্বোচ্চ কাজ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে মুদ্রণ শিল্প সমিতি।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, এবার মাধ্যমিকের বই প্রতি ফর্মা (৮ পৃষ্ঠা) প্রাক্কলন করা হয় ৩ টাকা ১০ পয়সা। এর বিপরীতে মুদ্রণকারীরা ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে শুরু করে ২ টাকা ধরে টেন্ডার দিয়েছে, যা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে গড়ে ৩০-৩৫ শতাংশ কম।
প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রথম কম দর দেওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের দেওয়া বইগুলোর অধিকাংশ নিম্নমানের হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরপরও কয়েক বছর ধরে একই কৌশলে ছাপার কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘বই হয়তো সময়মতো চলে যাবে। কিন্তু আমরা কয়েকটি প্রেস থেকে বই সংগ্রহ করে দেখেছি, এবার ইতিহাসের সবচেয়ে সর্বনিম্ন মানের কাগজে পাঠপুস্তক ছাপানো হচ্ছে। বইয়ের মান নিয়ে বোর্ডের কোনো আগ্রহ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘গত বছরও অনেক প্রেস মানহীন কাগজে বই ছেপেছিল। তখন কয়েকটি ছোট প্রেসকে লোকদেখানো শাস্তি দেওয়া হয়। রাঘবগোয়ালরা ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। যার ফলে এবারও নিম্নমানের কাগজে বই ছাপা হচ্ছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিকের ছাপার কাজ মোটামুটি শেষ। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শেষ হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির অর্ধেক এবং নবম শ্রেণির ৭৫ শতাংশ কাজ বাকি। তবে এই ছাপার কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে বলে আশা করছি।’
নিম্নমানের কাগজে বই ছাপা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুই-একজন হয়তো নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়েছে। তবে ধরা পড়লে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’