শরিফুল ইসলাম, খুবি
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৩ ১১:০১ এএম
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। ফাইল ছবি
খুলনার গল্লামারীতে প্রতিষ্ঠিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রমের ৩৩ বছর পূর্ণ করে ৩৪ বছরে পদার্পণ করছে। শনিবার (২৫ নভেম্বর) খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে ৪টি ডিসিপ্লিনে ৮০ শিক্ষার্থী নিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়। একই বছরের ২৫ নভেম্বর শিক্ষা কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। প্রতিবছর এ দিনটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়ে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্কুল বা অনুষদের সংখ্যা ৮টি এবং ডিসিপ্লিন বা বিভাগের সংখ্যা ২৯টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি। যার মধ্যে ৩৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষক আছেন পাঁচ শতাধিক, যার এক-তৃতীয়াংশই পিএইচডিধারী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১৪। ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত ৫৪:৪৬, যা দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কর্মকর্তা তিন শতাধিক এবং কর্মচারীর সংখ্যা ৫০০। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ৬টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রায় ১৫ হাজার গ্র্যাজুয়েটকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিজ্ঞানপত্র দেওয়া হয়েছে।
দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট, সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নবম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই মনে হবে এক শান্ত ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। নেই কোনো কোলাহল, নেই শব্দদূষণ। বিশেষভাবে চোখে পড়বে একই রঙে রাঙানো ভবনগুলোর দেয়াল। প্রশাসনিক বা একাডেমিকসহ কোনো ভবনের গায়ে চিকা মারা নেই। নেই কোনো স্লোগান লেখা, নেই কোনো ব্যানার, ফেস্টুন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই প্রথম চোখে পড়বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুউচ্চ ম্যুরাল, যার গায়ে উৎকীর্ণ আছে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। এ ছাড়া রয়েছে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন ভবন, ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবন, আচার্য জগদীশচন্দ্র একাডেমিক ভবন, কবি জীবনানন্দ দাশ একাডেমিক ভবন। এমনিভাবে প্রত্যেকটি আবাসিক হল ও অন্যান্য স্থাপনার প্রবেশপথেই শুধু দেখতে পাবেন নাম লেখা। এ যেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নিজস্বতা। বঙ্গমাতা হলে রয়েছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ম্যুরাল। রয়েছে কটকা স্মৃতিস্তম্ভ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহদাকার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটির স্থাপত্যশৈলী চমৎকার।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বুয়েটের পরই ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স ক্রেডিট পদ্ধতি চালু হয়। দেশের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিন, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিন এবং ঢাকার বাইরে স্থাপত্য ডিসিপ্লিন ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন প্রথম চালু হয়। দেশের মধ্যে ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় হিসেবে চালু হয়। সুন্দরবন ও উপকূল নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থাপিত হয়েছে ইনস্টিটিউট ফর ইন্টিগ্রেটেড স্টাডিজ অন দ্য সুন্দরবনস অ্যান্ড কোস্টাল ইকোসিস্টেম (আইআইএসএসসিই)। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত হয়েছে দেশের প্রথম সয়েল আর্কাইভ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের মাটির ২০ ফুট গভীর নিচে সুরম্যভাবে স্থাপিত এ আর্কাইভ। এখানে সংগৃহীত আছে দেশের ৫টি জোনের ১ হাজার ৮৫৮টি প্লটের ৫ হাজারের বেশি মাটির নমুনা, যা সংরক্ষণ করা হয়েছে গবেষণার জন্য।
এ বছর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনির্মিত দৃষ্টিনন্দন ক্যাফেটেরিয়ার উদ্বোধন করা হয়েছে। ইটপাথরের শহরের মধ্যে গোলপাতার ছাউনিতে গ্রাম-বাংলার ছোঁয়া পেয়েছে এই ক্যাফেটেরিয়া। ওভাল শেপ আকারে নির্মিত এ ক্যাফেটেরিয়ার আয়তন ৫ হাজার ৪০০ স্কয়ার ফুট। এটি সবাইকে আকৃষ্ট করছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন লেকওয়ে।
বর্তমান সরকার দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে এরই মধ্যে হেকেপ প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়াও শিক্ষার মান যাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেজন্য বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল স্থাপন করেছে। এই কাউন্সিল ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্কÑ বিএনকিউএফের গাইডলাইন অনুসরণ করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে বিশ্বমানের আউটকাম বেজড অ্যাডুকেশন (ওবিই) কারিকুলা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। গত জানুয়ারি থেকে প্রণীত ওবিই কারিকুলা এবং একই ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্সে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমবিকাশের ধারায় এখন শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনায় বিশ্বমান অর্জনে জোর দেওয়া হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়কে রিসার্চ ফোকাসড ইউনিভার্সিটি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গবেষণার গুণগত মানোন্নয়নে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর আন্তর্জাতিক র্যাংকিং, কিউএস র্যাংকিং, টাইমস হায়ার অ্যাডুকেশন র্যাংকিংয়ে স্থান করে নিয়েছে। এ ছাড়া এ বছর ইউজিসির এপিএ মূল্যায়নে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ৯৫.৪৭ নম্বর পেয়ে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি তথা নবীন-প্রবীণ গবেষকদের গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে গবেষণার অনুদান বাড়ানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা ও প্রকাশনা যাতে আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপ্তি ও পরিচিতি পায় সে জন্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজকে যুগোপযোগী করা হয়েছে।
উপাচার্য প্রফেসর মাহমুদ হোসেন বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে এতদাঞ্চলের মানুষের অপরিসীম অবদান ও ত্যাগ অনস্বীকার্য। আমরা সবসময়ই সে বিষয়টি ধারণ করি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ধারণ করেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অভিলক্ষ্য পূরণে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে ডিজিটালাইজেশনের পথে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে আস্থার জায়গা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এটা ধারণ করেই এ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমান অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে।