শোয়াইব আহমেদ, ঢাবি
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:৫৮ পিএম
আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২১:৫৮ পিএম
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে টানাপোড়েনের জের ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত রাজধানীর সাত কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগ। কয়েক মাস ধরে এ ব্যাপারে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। বিষয়টি নিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাত কলেজ নিয়ে ঢাবির সঙ্গে তাদের বিরোধের বিষয়টি আর গোপন থাকেনি।
এর মধ্যে গত মঙ্গলবার সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈকত বলেছেন, অধিভুক্ত সাত কলেজের ছাত্রলীগের কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গিয়ে হওয়ার সুযোগ নেই।
তার এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে মঙ্গলবার রাতেই তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ করেছে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের একাংশ। গতকাল বুধবার সৈকতের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের একটি অংশও বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছে কবি নজরুল সরকারি কলেজ ছাত্রলীগও। বিক্ষোভকারীরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
অধিভুক্ত সাত কলেজের অন্য চারটি হলোÑ ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত নেতাকর্মীরাও ঢাবি ছাত্রলীগের দাবির সঙ্গে একমত নন। অন্তত এক ডজন নেতাকর্মী এ প্রসঙ্গে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলছেন, তাদের অধিভুক্ত করার মতো সক্ষমতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেই। অধিভুক্ত সাত কলেজের নিজস্ব রাজনৈতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। তারা কেন্দ্রের অধীনেই ভালো আছেন, তাদের নেতৃত্বেই রাজনীতি করতে চান। কেন্দ্রের অধীনে কলেজগুলো জেলা ইউনিটের মর্যাদা পাচ্ছে, ঢাবি ছাত্রলীগের অধীনে নিয়ে গেলে তারা উপজেলা পর্যায়ে নেমে আসবেন জানিয়ে সাত কলেজের নেতারা ঢাবি ছাত্রলীগের দাবিকে অযৌক্তিক বলেই অভিহিত করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত ২০ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয় ঢাবি এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার কমিটিও। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই নিজেদের প্রভাববলয় বিস্তারে মনোযোগী হয়ে ওঠেন নেতারা। এ নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে শুরুতে মনকষাকষি এবং পরবর্তী সময়ে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয় ঢাবি ছাত্রলীগের। গত ১ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছাত্রসমাবেশে প্রধানমনন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে মঞ্চে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। এর ভিত্তিতে সাত কলেজ নিয়ে তোড়জোড় বাড়িয়েছেন তারা।
অবশ্য সাত কলেজ নিয়ে টানাটানির বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে গত ১৭ জুলাই ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঢাবির দুই শীর্ষ নেতার সৌজন্য সাক্ষাতের পর। সাক্ষাৎকালে ঢাবির শয়ন ও সৈকত ঘোষণা দেন, অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নানান সংকট সমাধানে তারা একসঙ্গে কাজ করবেন। এরপরই সংগঠনের সাত কলেজ শাখার নিয়ন্ত্রণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের হাতে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন শুরু হয়। এর পরদিন কলেজ ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করে সেই গুঞ্জনে পানি ঢেলে দেয়। যদিও ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দাবি, সাত কলেজকে তাদের অধীনে আনার প্রস্তাব আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছেছে। এ বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।
তবে সেই সিদ্ধান্ত জানার আগেই মঙ্গলবার টিএসসিতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাডেমিক সংকট নিরসনের আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈকত বলেন, ‘অধিভুক্ত সাত কলেজের ছাত্রলীগের কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গিয়ে হওয়ার সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কমিটি দেবে। উপজেলায় উপজেলায় কর্মীদের সুসংগঠিত করবে। আমরা ঢাবি ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুসংগঠিত করব। অধিভুক্ত সাত কলেজকে সুসংগঠিত করব।’
তার এ বক্তব্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সাত কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বলেন, ‘একাডেমিক সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে সভাটি ডাকা হয়েছিল। আমরা সেটিকে ভালো হিসেবেই নিয়েছি কিন্তু ঢাবি ছাত্রলীগের নেতারা তারা সেখানে রাজনৈতিক যে বিষয়টি নিয়ে এসেছেন তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযৌক্তিক। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাত কলেজ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের আওতাধীন থাকবে।’
এ প্রসঙ্গে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি শিরিন সুলতানা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা একটি জেলা ইউনিটের পদমর্যাদার আর ঢাবি আমাদের উপজেলা ইউনিট হওয়ার জন্য বলছে। আমরা কেন্দ্রের সাথেই ভালো আছি, কেন্দ্রের সাথেই থাকতে চাই। ঢাবি নিজেই কেন্দ্রের একটি ইউনিট, সেখানে আমরা কেন্দ্র ছেড়ে কেন ইউনিটে যাব!’
ঢাকা কলেজে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসা নিজামুল ইসলাম নিপু বলেন, ‘আমরা ছাত্রলীগের একটি সুপার ইউনিট। আমরা কেন্দ্রের সাথেই থাকব, কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করব।’
বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘একাডেমিক সমস্যা নিরসনের কথা বলে পরে রাজনৈতিক বিষয় আনাতে আমরা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছি। ঢাবি ছাত্রলীগের বক্তব্য ভিত্তিহীন। তিনি কোন সেন্সে বলেছেন তা আমার জানা নাই।’
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সৈকতকে উদ্দেশ করে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একটা জেলা ইউনিটকে কোন সাহসে আপনি উপজেলা ইউনিট বানাতে চান? আপনি যত শিক্ষার্থীর নেতৃত্ব দেন আমি তার থেকে বেশি শিক্ষার্থীর নেতৃত্ব দিই।’
তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরাদ হোসাইন জন বলেন, তিতুমীর কলেজ একটি বড় ইউনিট। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কখনও নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা রাখে না।
এ বিষয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাত কলেজের একাডেমিক কার্যক্রমে উন্নয়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে সরকার। একাডেমিক ডেভেলপমেন্টের জন্য রাজনৈতিক শৃঙ্খলাও জরুরি। আমরা সেই শৃঙ্খলা তৈরি করতে আমাদের দাবি জানিয়েছি। আমরা যৌক্তিক বিষয়েরই দাবি করেছি।’
সাত কলেজের নেতাকর্মীরা এতে রাজি নন, বিক্ষোভ করছেনÑ এ বিষয়ে জানতে চাইলে সৈকত বলেন, ‘যারা বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছে তারা বাধ্য হয়ে দিচ্ছে, তাদেরকে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করা হচ্ছে। যারা ছাত্ররাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তিক করতে চাচ্ছেন তারা এভাবে কাজ করাচ্ছেন।’
তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কাউকে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করা হয়নি। সাত কলেজের বিষয়টি একটি মীমাংসিত বিষয়। গঠনতন্ত্রে এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গঠনতন্ত্রের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঢাবি শাখার দাবি নিয়ে সাত কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিচলিত হওয়ার কারণ নেই বলেও আশ্বস্ত করেন ইনান।