সিরাজুদ্দৌলা আরাফাত, শেকৃবি
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:১৩ এএম
আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:১৯ এএম
শব্দ দূষণের প্রতিবাদ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। সোমবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল-সংলগ্ন রাস্তা প্রায় ২ ঘণ্টা অবরোধ করা হয়। প্রবা ফটো
প্যাঁ পোঁ-টি টি বিরতিহীন শব্দ। মনে হয় যেন কোনো হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতার মঞ্চে অবস্থান করছি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য অ্যালার্ম দিতে হয় না, পাশের রাস্তার গাড়ির হর্ন যেন সেই দায়িত্ব নিয়েছে। এভাবেই শব্দদূষণে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেছেন রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা হলের শিক্ষার্থী আফজাল শরীফ শুভ।
তিনি শব্দদূষণকে শব্দসন্ত্রাস উল্লেখ করে বলেন, সারাক্ষণ গাড়ি যাওয়া-আসার ফলে হলের বি-ব্লকের রুমগুলোতে ঘুম, পড়াশোনা তো দূরে থাক, অনেক সময় বসে থাকাই দায় হয়ে যায়। সারা দিন এ ‘শব্দসন্ত্রাস’ এবং ধুলাবালির জন্য জানালা খুলতে পারি না। পরীক্ষার দিন সকালে এবং আগের দিন পরিস্থিতি যে কী হয়, এটি আমরা বি-ব্লকে যারা থাকি, তারা ছাড়া কেউ বুঝবে না। এখন আমার কাছে মনে হয় এই হল থেকে চলে যেতে পারলেই বাঁচি।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, মূলত এসব যানবাহন আগারগাঁওয়ে মূল রাস্তা দিয়ে না গিয়ে হলের পাশের রাস্তাটি জ্যাম এড়াতে ব্যবহার করে। রাস্তার খুব কাছে হওয়ায় সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শিকার হলটির বি-ব্লকের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে অফিস টাইম সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এ রাস্তায় জ্যাম লেগেই থাকে। সকাল থেকে শুরু করে রাত ১২-১টা পর্যন্ত এ রাস্তায় যান চলাচল করে। এতে পড়ালেখায় ক্ষতিসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির এই হলে থাকা ১ হাজার ২৫০ শিক্ষার্থী। একই ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন শেরেবাংলা হলের ৭৫০ শিক্ষার্থীও।
এ নিয়ে সোমবার সকালে প্রায় ২ ঘণ্টা হল-সংলগ্ন রাস্তা অবরোধ করেন বেশকিছু শিক্ষার্থী। পরে প্রক্টর হারুনুর রশিদ দুদিন সময় চেয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেন। অবরোধকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘দুদিনের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আমরা আবার রাস্তা আটকে দেব।’
বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময় ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। কিন্তু সপ্তাহব্যাপী তীব্র শব্দদূষণ থেকে শিক্ষার্থীদের এই হল দুটিতে শব্দের তীব্রতা পরিমাপ করে গড়ে ৮৩ দশমিক ৩ ডেসিবেল পাওয়া যায়। এটি স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আর সকালে (অফিস টাইমে) এর মাত্রা পৌঁছে প্রায় ১০৮ দশমিক ৮ ডেসিবেলে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এমন নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা নিয়মিত চললেও যেন দেখার কেউ নেই।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবলের বেশি হলে, সেটি মানসিক এবং শারীরিকভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকর, যা শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি মানুষের নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা বলেন, ‘শব্দদূষণের কারণে প্রথমত মানুষের কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শোনার ক্ষমতা কমে যায় এবং ক্রমান্বয়ে বধিরতা তৈরি হয়। কানের ভেতরে ঝি ঝি শব্দ, মাথাব্যথা, অস্বস্তি এবং মেজাজ খিটখিটে ভাব হয়। এছাড়া ক্রমান্বয়ে শব্দ দূষণের মধ্যে থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়।’
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা হলের বি-ব্লকের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আতিকুল হক জিলানী বলেন, ‘সকালবেলা পড়াশোনা করার মুখ্য সময়, আর এ সময়ই পরিবেশটা বেশি খারাপ থাকে। সারা দিন ক্লাস-পরীক্ষা শেষে বিকালে যখন একটু বিশ্রাম নেব, তখন গাড়ির হর্নের কারণে সে উপায়ও নেই। ফলে নিয়মিত ঘুমে সমস্যা হওয়ায় আমি নিউরোসায়েন্সে (হাসপাতাল) ডাক্তারও দেখিয়েছি। ডাক্তার আমাকে নিরিবিলি পরিবেশে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রশাসন যদি রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড দিয়ে দেয় এবং বহিরাগত গাড়ি ক্যাম্পাসে প্রবেশ সংরক্ষিত করে, তাহলে হয়তো এ থেকে মুক্তি মিলবে।’
এ বিষয়ে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা হলের প্রাধ্যক্ষ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক আগেই পরিবেশ অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়ার কথা। আমি চেয়েছিলাম হলের পাশে অন্তত নীরব এলাকা চিহ্নিত করে হর্ন না বাজানোর একটি সাইনবোর্ড বসাতে। যদিও সেটি পরিবেশ অধিদপ্তরের বিষয় হওয়ায় জটিলতা রয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে আবার বসব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমরা নিজেরা চাইলেই তো ব্যবস্থা নিতে পারি না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। ৩ মাস আগেও আমরা বিভিন্ন জায়গায় চিঠি দিয়েছি। কোনো রেসপন্স পাইনি। আজকের অবরোধ থেকে শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে একটি লিখিত আবেদন দিয়েছে। সেটি সংযুক্ত করে আমরা আবার ডিমপি কমিশনার, শেরেবাংলা নগর থানা ওসি, ভোক্তা অধিকার এবং পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠাব। আশা করছি এবার তারা রেসপন্স করবেন। না হয় আমিসহ আবার আন্দোলনে নামব।’