বগুড়া ব্যুরো
প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:৪৫ পিএম
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:৫৮ পিএম
তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীদের তালিকায় সন্তানদের নাম খুঁজছেন অভিভাবকরা। মঙ্গলবার বগুড়া জিলা স্কুল থেকে তোলা ছবি।
লটারির মাধ্যমে সরকারি বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করানোর জন্য বগুড়ার অভিভাবকরা তাদের সন্তানের নামে একাধিক জন্মনিবন্ধন সনদ গ্রহণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি বাবা-মায়ের নাম ঠিক রেখে শুধু সন্তানের নাম পরিবর্তন করেও জন্মনিবন্ধন সনদ গ্রহণ করা হয়েছে।
বগুড়া জিলা স্কুল এবং সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রকাশের পর এক শিক্ষার্থীর নামে একাধিক জন্মনিবন্ধন সনদ গ্রহণের অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সোমবার (১২ ডিসেম্বর) রাত পৌনে ৮টায় সারা দেশে এক যোগে ওই তালিকা প্রকাশ হয়।
বগুড়া জিলা স্কুল এবং সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তির জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) সকালে ওয়েবসাইট থেকে প্রিন্ট করার পর জন্মনিববন্ধন সনদ নিয়ে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।
বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত তালিকার প্রথম, দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ক্রমিকে একই শিক্ষার্থীর নাম ও ছবি রয়েছে। এমনকি বাবা-মার নাম ও মোবাইল ফোন নম্বরও অভিন্ন। শুধু জন্মনিবন্ধন সনদের নম্বর ও ইউজার আইডি আলাদা। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে জিলা স্কুলেও।
মঙ্গলবার দুপুর ২টা পর্যন্ত বিদ্যালয় দুটিতে এ ধরনের ১৯টি ঘটনার প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১টি ঘটনা ঘটেছে বগুড়া জিলা স্কুলে। স্থানীয়রা এধরনের ঘটনাকে জালিয়াতি উল্লেখ করে এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
সরকারি বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য গত ১৬ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করা হয়। ওই সময়ের মধ্যে বগুড়া জিলা স্কুল ও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪১১টি আসনের বিপরীতে ২০ হাজারেরও বেশি আবেদন জমা পড়ে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় অনলাইনে লটারির মাধ্যমে ভর্তির জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়।
বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তৃতীয় শ্রেণির দিবা শাখায় ভর্তির জন্য মনোনীত সাধারণ কোটায় মোছা. শর্মিলা আকতার নামে এক শিক্ষার্থীর নাম ও ছবি চূড়ান্ত তালিকার প্রথম, দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ক্রমিকে রয়েছে। তালিকার তিনটি স্থানেই তার বাবা ও মায়ের নাম এবং মোবাইল ফোন নম্বর অভিন্ন। শুধু জন্মসনদ নম্বর এবং ইউজার আইডি আলাদা। আবার ছবি এবং বাবা-মায়ের নাম অভিন্ন কিন্তু শিক্ষার্থীর নাম আলাদা (রিয়া সরকার, তৃধা সরকার এবং নবরূপা সরকার) এমন এক শিক্ষার্থীর নাম ওই তালিকায় ৬৫, ৬৯ এবং ৭৯ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে। বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তারা এ ধরনের আটটি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছেন।
অন্যদিকে বগুড়া জিলা স্কুলে তৌফিক ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীর নাম ও ছবি ভর্তির জন্য মনোনীত চূড়ান্ত তালিকার ৪৪, ৪৬ ও ৮১ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে। তালিকায় তার নামের ক্রমিক আলাদা হলেও বাবা-মায়ের নামের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আবার শিক্ষার্থীদের নামের শেষের অংশ পরিবর্তন করেও একাধিক জন্মনিবন্ধন সনদ গ্রহণ করা হয়েছে। ওই স্কুলের শিক্ষকরা জানান, মঙ্গলবার দুপুর ২টা পর্যন্ত অনুসন্ধান করে তারা এধরনের ১১টি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছেন।
ওই দুই স্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, লটারিতে নাম উঠলেই যেহেতু ভর্তি নিশ্চিত তাই একটি চক্র জন্মনিববন্ধন সনদ জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েছে। তারা বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে অভিভাবকদের কাছে এসব সনদ সরবরাহ করছে।
তারা জানান, ২০২০ সালে লটারির ভিত্তিতে ভর্তি শুরু হওয়ার আগে বগুড়া জিলা স্কুল ও সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার শিক্ষার্থীর আবেদন জমা পড়ত। কিন্তু লটারি পদ্ধতি চালু হওয়ার পর আবেদনের পরিমাণ পাঁচগুণ বেড়ে গেছে।
সিনিয়র এক শিক্ষক বলেন, ‘অনেক অভিভাবক এক শিক্ষার্থীর জন্য ৩০টি পর্যন্ত জন্মসনদ সংগ্রহ করে দাখিল করেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে প্রথম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বয়স বাড়িয়েও জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে লটারির জন্য আবেদন করা হচ্ছে।’
বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে ভর্তির জন্য চূড়ান্ত যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাতে বেশ কিছু শিক্ষার্থীর নাম একাধিকবার এসেছে বলে তিনি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
চূড়ান্ত তালিকায় একাধিকবার নাম আসা শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থীর নাম একাধিবার এলেও সে একবারই ভর্তির সুযোগ পাবে। এতে শূন্য হয়ে পড়া অন্য আসনগুলো অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে পূরণ করা হবে।’
বগুড়া জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামপদ মুস্তফীও একই কথা বলেন।
বগুড়া জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীদের তালিকায় ৪৪, ৩৬ ও ৮১ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে তৌফিক ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী। তার তিনটি জন্মসনদের বিষয়ে জানতে চাইলে বাবা আতিকুর রহমান মোবাইল ফোনে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
তিনি সামনাসামনি কথা বলার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘আপনি সাতমাথায় (শহরের জিরো পয়েন্ট) আসেন। সামনাসামনি আলাপ করব।’
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, ‘বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিশুদের একাধিক জন্মসনদ গ্রহণের অভিযোগটি বেশ পুরোনো। অথচ আমরা শুনেছিলাম যে, পুরো পদ্ধতিটি ডিজিটালাইজড করা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে একজনের নামে একাধিক জন্মসনদ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরেও এটা ঘটছে।’
তিনি বলেন, ‘এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
তবে এক নামে একাধিক জন্মনিবন্ধন সনদের বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ আমিও শুনেছি। এটা অসম্ভব। কিন্তু কীভাবে কারা করছে সেটা আমরা জানি না। তাছাড়া বর্ণিত জন্মনিবন্ধন সদনগুলো যে বগুড়া পৌরসভা থেকেই নেওয়া হয়েছে সেটিও আমরা নিশ্চিত নই। যদি কেউ অভিযোগ করেন তাহলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’