সোহরাব হোসেন
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৫ ১২:৩৯ পিএম
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিশেষ সরকারি অনুদানের টাকা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পকেটে ঢুকেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়নাধীন পারফরম্যান্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশন্স (পিবিজিএসআই) স্কিমের ‘স্কুল/মাদ্রাসা/কলেজ ব্যবস্থাপনা জবাবদিহি অনুদান’ হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৫০০ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রত্যেককে দেওয়া হয় ৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৭ হাজার ৫০০ প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয় মোট ৩৭৫ কোটি টাকা। তবে অভিযোগ উঠেছে, পুরো অঙ্কের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০০ কোটি আত্মসাৎ হয়েছে ভুয়া ব্যয় ভাউচারের মাধ্যমে।
ভোলার লালমোহন উপজেলার করিমগঞ্জ ইসলামিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় বরাদ্দের ৫ লাখ টাকার মধ্যে ৪ লাখই আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, বরাদ্দকৃত টাকা থেকে কেবল মাদ্রাসার টিনশেড ভবনের পুরোনো টিনের জায়গায় কিছু স্থানে নতুন করে লাগানো হয়েছে। পুরোনো টিন বিক্রি করেই নতুন করে লাগানো হয়। এতে ওই বরাদ্দ থেকে ব্যয় দেখানো হয় লাখখানেক টাকা। এ ছাড়া বরাদ্দে উল্লেখ করা অন্য কোনো খাতে ১ টাকাও ব্যয় করা হয়নি।
এদিকে বরাদ্দকৃত টাকা ব্যাংক থেকে তুলে মাসের পর মাস নিজের কাছে রাখার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মোহাম্মদিয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ফরিদ আহমদ এবং অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জানে আলমের বিরুদ্ধে।
একইভাবে সুস্থ ছয় শিক্ষার্থীকে প্রতিবন্ধী বানিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার পাঁচকাহুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসেম আলী এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কাজল বরন সরকারের বিরুদ্ধে।
শিক্ষার্থীরা জানেই না তারা প্রতিবন্ধী। এমনকি ওই শিক্ষার্থীদের টাকাও প্রদান করা হয়নি। প্রতিবন্ধীর তালিকায় স্থান পাওয়া নবম শ্রেণির লিমা খাতুন জানায়, ‘সে সম্পূর্ণ সুস্থ। শারীরিক কোনো সমস্যা নেই।’ স্কুল থেকে তাকে প্রতিবন্ধী বানানো ও ৮ হাজার টাকা পাওয়ার কথাও সে জানে না।
নীলফামারীর জলঢাকা বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। তিনি ২০ জন অসহায় মেধাবী শিক্ষার্থীকে বাছাই করেন এবং তাদের অভিভাবকদের মোবাইলে বিকাশ অথবা নগদ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে পুরোটাই আত্মসাৎ করেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন মহলে অভিযোগ করলে তাদের ৫ হাজার টাকা দেওয়ার পরিবর্তে প্রত্যেককে ১ হাজার করে দেবেন বলে জানান। তবে ওই জানানো পর্যন্তই। পরে কাউকেই তিনি টাকা দেননি।
ষষ্ঠ শ্রেণির নুসরাত বলে, ‘৫ হাজারের মধ্যে সে একটি টাকাও পায়নি।’ এমনকি তার মোবাইলের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট স্কুলের একজন শিক্ষকের নম্বর দেওয়া আছে। অনুদানের টাকা সেই অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।
অনুদানপ্রাপ্ত দেশের প্রায় বিদ্যালয়েই ঘটেছে আত্মসাতের এই মহোৎসব। রাজধানীর নামকরা কলেজ থেকে মফস্বলের চিত্র একই। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ বরগুনার চরগাছিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মোহাম্মদিয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার পাঁচকাহুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একই উপজেলার ভাতঘরা দয়াপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খুলনার হারিঢালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঝালকাঠিরে আমুয়া বালিকা বিদ্যালয়, নওগাঁর মাতাসাগর ইয়ার উদ্দীন ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা।
প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী, অনুদানের ৫ লাখ টাকার মধ্যে ২০ শতাংশ হিসাবে ১ লাখ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনা; ২৫ শতাংশ হিসাবে ১ লাখ ২৫ হাজার বইপত্র, শিক্ষা উপকরণ, গবেষণাগার সরঞ্জাম কেনা এবং লাইব্রেরি উন্নয়নের জন্য; ৩০ শতাংশ হিসাবে দেড় লাখ টাকা ছাত্র-ছাত্রী বিশেষ করে ছাত্রীদের ফ্যাসিলিটির (অবকাঠামো, বিশুদ্ধ পানি, শৌচাগার, কমনরুম, হাইজিন কর্নার) সংস্কার/উন্নয়ন; ২০ শতাংশ হিসাবে ১ লাখ সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের (ভূমিহীন, গৃহহীন, অতিদরিদ্র, দুস্থ, এতিম, নদী সিকন্তি পরিবারের শিক্ষার্থী) সহায়তা এবং ৫ শতাংশ হিসাবে ২৫ হাজার টাকা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ফ্যাসিলিটি (হুইলচেয়ার, ক্র্যাচ, সাদাছড়ি, হিয়ারিং এইড, ব্রেইল বই ইত্যাদি সরবরাহ করা) উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত রয়েছে।
তবে অনুদানের ২০ শতাংশ হিসেবে যে ১ লাখ টাকা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রণোদনার জন্য বরাদ্দ ছিল, তা বৈধ খরচ হলেও বাকি ৮০ শতাংশ ভুয়া ব্যয় ভাউচার দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সভাপতি। এর আগে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক প্রফেসর শাহানাজ পারভীন কাজল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ভাউচার চাওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘চারবার পত্র দেওয়া হলেও অনেক প্রতিষ্ঠান অনুদানের ব্যয় ভাউচার প্রেরণ করেনি।’
প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদারকি হচ্ছে কি না জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও জেলা শিক্ষা অফিসার বলেন, ‘পিবিজিএসআই প্রকল্পের টাকা কোন প্রতিষ্ঠান কোন খাতে ব্যয় করল, কারা ভুয়া ভাউচার দিল তা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দেখেন। তিনিই এই বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।’
স্কিমের প্রোগ্রাম অফিসার তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে অনেক স্কুল এমপিওভুক্ত হলেও এসব স্কুল ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও কয়েকবার বলেছে, এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। তখন সরকার এসব বিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণের জন্য জবাবদিহিমূলক অনুদান দেওয়া শুরু করে।’
স্কিমের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘প্রকল্প অনুদান সম্পর্কে আমাদের কাছেও অভিযোগ আসে। আমরা তখন তদন্তে গিয়ে পাঁচটা খাতে মূল্যায়ন করি। যদি মূল্যায়ন সঠিক না পাই তখন তা মাউশির কাছে লিখিত জানিয়ে দিই। মূলত প্রকল্পের ক্ষমতা নেই কোনো প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেওয়ার। তাই আমরা চাইলেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি না।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের কাজ করে। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক, প্রশাসনিক বিষয় দেখভাল করে সংস্থাটি। সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতিবছর ডিআইএর কর্মকর্তারা ২-৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। এর মধ্যে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যে, তারা অনিয়ম-দুর্নীতি খুঁজে পাননি। দীর্ঘদিন এসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতি কমার পরিবর্তে বাড়ছে। অনিয়ম প্রমাণের পর ব্যবস্থা না নেওয়া এর অন্যতম কারণ।
এ বিষয়ে ডিআইএর এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির পর তা নিষ্পত্তি হতে বেশ সময় লাগে। কিছু ক্ষেত্রে পাঁচ বছরও লেগে যায়। ফলে সহজে অভিযোগের নিষ্পত্তি হয় না। আবার এই সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠানপ্রধান অবসরে চলে যায় অথবা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পরিবর্তন হয়। যে কারণে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাছাড়া আমাদের দপ্তরের জনবল সংকট রয়েছে।’
স্কিমের একটি সূত্রে জানা যায়, স্কিম থেকে প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও প্রতি উপজেলায় এসএসসি ও এইচএসসিতে ফলাফলের ভিত্তিতে সেরা ২০ জন শিক্ষার্থীকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। এর আগে এসএসসিতে ৮১৮৩ জন ও এইচএসসিতে ৭৩০২ জন শিক্ষার্থীকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে স্কিম থেকে ২০ হাজার প্রতিষ্ঠানকে ‘প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা জবাবদিহি অনুদান’ প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে।
স্কিম পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, ‘প্রতি অর্থবছরে সেরা শিক্ষার্থীদের অনুদান দেওয়ার পাশাপাশি এবার আমরা প্রতি উপজেলায় শ্রেষ্ঠ একজন শিক্ষককেও সম্মানীত করে অনুদান দেব। স্কিমের টাকা ব্যয়ে ত্রুটি থাকলেও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান সুফলও ভোগ করেছে। তারা বরং স্কিমের টাকার সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে আরও টাকা উত্তোলন করে বিদ্যালয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে।’