বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৪২ পিএম
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৪৬ পিএম
শনিবার দুপুরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে ধর্ষণের বিচার চেয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়েছে। প্রবা ফটো
‘আমরা দেশের প্রতিটা মসজিদের ইমামদের কাছে ধর্ষকের বিচার নিয়ে যাব। আমি একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী, কিন্তু ইমামরা ধর্ষকের যে বিচার করবেন— আমরা তা মেনে নেব। আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইমামদের দেওয়া বিচার মেনে নেব।’
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে এমন মন্তব্য করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও ইবি পূজা উদযাপন কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুকান্ত দাস।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুর দেড়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ‘সারা দেশে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, নারী নির্যাতন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি’— ব্যানারে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
সুকান্ত বলেন, ‘আপনারা (বাংলাদেশ সরকার) ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রেখেছেন, কিন্তু কয়টি কার্যকর করেছেন? কয়টির বিচার সম্পন্ন হয়েছে? সেই তালিকা দিন। আমরা গত কয়েকদিন ধরে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের খবর দেখছি, কিন্তু তার প্রতিবাদ জানাইনি। এটি আমাদের ব্যর্থতার জায়গা।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ছয় মাস ধরে আপনারা পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন, সারা দেশে এত সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন— এগুলো দেখার জন্য কি আপনাদের বসানো হয়েছে? নাকি রক্তের ওপর পা রেখে চেয়ারে বসার পর সে রক্তের গন্ধ এখন আর আপনাদের নাকে আসে না?
‘দেশ গঠনের জন্য যদি আমাদের দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হয়, এক বেলা খেয়ে থাকতে হয়, তাতেও আমরা রাজি আছি। আমাদের খাবারের দরকার নেই, আমরা এক বেলা খেয়ে থাকব, কিন্তু যতক্ষণ আমাদের শরীরে এক বিন্দু রক্ত আছে, ততক্ষণ আমাদের মা-বোনদের ওপর নির্যাতন সহ্য করব না। এরপরও যদি আপনারা ব্যবস্থা না নেন, তাহলে পরবর্তী যেকোনো পরিস্থিতির দায়ভার আপনাদের।’— বলে সুকান্ত দাস যুক্ত করেন।
আল ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সায়েম আহমেদ বলেন, ‘স্বৈরাচারী সরকারের পতনের দিনকার একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে— গণভবন ও জাতীয় সংসদ থেকে যখন সবাই বের হয়, তখন এক নারী সহযোদ্ধা লিখেছিলেন— বিজয় মিছিলের মধ্যে কিছু যুবক ওই নারীকে বারবার উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করছিল। তিনি যখন এটি ফেসবুকে লিখলেন, সেখানে যেসব মন্তব্য এসেছিল, তা গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো। আমি দেখেছিলাম— কত সহস্র নারী সেখানে নিজেদের হেনস্তার গল্প শেয়ার করছিলেন! যুগ যুগ ধরে আমাদের নারী সহযোদ্ধা, নারী বন্ধু, মা-বোনেরা এমন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কতটা অপদার্থ, কতটা নির্লজ্জ! আমরা এখন পর্যন্ত দাঁড়িয়ে মাত্র কয়েকজন মিলে প্রতিবাদ করছি! অথচ হওয়া উচিত ছিল— একজন নারীর শ্লীলতাহানি হলে, তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিবাদ হওয়ার আগেই যথাযথ বিচার করা।’
সায়েম বলেন, ‘বছর খানেক আগে আমরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে একটি মানববন্ধন করেছিলাম। আমাদের দাবি ছিল— ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়ন করা। আইন সংশোধন হয়েছে, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন কোথায়?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা ২.০—এর জন্য ছাত্র-জনতার বিপ্লব দেখেছি, তাই বাংলাদেশের নতুন প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি— দ্রুত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ধর্ষকদের বিচার করতে হবে। ধর্ষকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। আরেকটি সামাজিক বার্তা আমরা দিতে চাই— আমরা নারীদের অধিকার নয়, মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলব। কারণ নারী মানে মানুষ। ‘নারী অধিকার’ শব্দটাই নারীকে মানুষের বাইরে আলাদা করে ফেলে। আমাদের ‘মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া মাহমুদ মিম বলেন, ‘আমি শুধু নারীদের জন্য বিচার চাই না, আমি শিশু ধর্ষণের বিচারও চাই। আমি এসব ঘৃণ্য অপরাধের সহায়কদেরও বিচার চাই। যারা নারী ও শিশুদের হেনস্তা করে, যারা পুরুষদের সাথেও এমন জঘন্য কাজ করে— তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। শিশুরা খেলাধুলা করবে, হাসবে-খেলবে। কিন্তু কেউ যদি কোনো শিশুকে ফুসলিয়ে এমন অমানবিক কাজে যুক্ত করে, তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। আমরা এর বাইরে কিছু দেখি না।’
অর্থনীতি বিভাগের ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাহিদ হাসান বলেন, ‘সমাজে নারীদের অধিকার থাকুক বা না থাকুক, ধর্ষকের কোনো জায়গা নেই। আমরা দেখছি— নির্মমভাবে নারীদের ওপর নির্যাতন চলছে। কিছুদিন আগে বাসে এক নারী যাত্রীর ওপর নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু উপস্থিত জনতা প্রতিবাদ করেনি। ২১ ফেব্রুয়ারি রংপুরে এক পথশিশু ফুল কুড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে নারীরা হেনস্তার শিকার হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ধর্ষণ ঠেকানোর সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো— অনেক নারী সামাজিকভাবে টিকে থাকার জন্য অভিযোগ করেন না। আর পুলিশও তাদের পরিচয় গোপন রেখে সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। আমরা বারবার দেখি— আইনের মাধ্যমে ধর্ষকদের রক্ষা করার চেষ্টা হয়। আমাদের একটাই দাবি— ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাই, চাই এর বাস্তবায়ন।’