এম এ হান্নান, বাউফল
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:৪৬ পিএম
আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৪৪ এএম
মা-বাবার সঙ্গে আল-আমিন। প্রবা ফটো
দরিদ্র পরিবারে জন্ম হলেও পড়ালেখায় শতভাগ সফল হয়েছেন মো. আল-আমিন। এবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ১১৭তম হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন তিনি। ছেলের এমন সাফল্যে আনন্দে আবেগাপ্লুত আল-আমিনের পরিবার।
আল-আমিনের বাবা নিজাম উদ্দিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ছেলেকে মানুষ করতে খাবার হোটেলে কাজ করেছি, রিকশা চালিয়েছি। রাতের বেলাও শ্রমিকের কাজ করেছি। ছেলের এমন সাফল্যে সব দুঃখ ভুলে গেছি। আজ গর্ব করে বলতে পারি আমার ছেলে ডাক্তার হবে।’
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন। তার বসতভিটা ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ নেই। বাড়ির পাশে ভাড়া করা ছোট একটি কক্ষে খাবার হোটেলের ব্যবসা করেন। পাশাপাশি অন্যের জমিতে কৃষিকাজও করেন তিনি। তার স্ত্রী নাজমা বেগম একজন গৃহিণী। এই দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আল-আমিন দ্বিতীয়।
বরিশাল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন আল-আমিন। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর টাকার অভাবে বরিশালে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি। তাকে থাকতে হয়েছিল বাউফলে। যার ফলে নিয়মিত ক্লাসও করতে পারেননি। সহপাঠিরা যখন কলেজে ক্লাস করছিল আল-আমিন তখন বাড়িতে বাবার সঙ্গে হোটেলে কাজ করছিল। তবুও তার পড়াশুনা থেমে থাকেনি। আল-আমিন সব সময় চিন্তা করত তাকে বড় হতে হবে। তার সেই চিন্তা আর কঠোর পরিশ্রমেই পেয়েছেন সাফল্য।
দ্বাদশ শ্রেণির এক বছর বাড়িতে বাবার সঙ্গে নিয়মিত হোটেলে কাজ করেন আল-আমিন। বাউফল থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে করেছেন অনলাইন ক্লাস। দরিদ্রতাকে জয় করে এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পান আল-আমিন। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের মধ্যে আল-আমিনের স্কোর ১৮৬ দশমিক ২৫। মেধাতালিকায় ১১৭তম হয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির জন্য মনোনীত হন।
আল- আমিন বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণিতে আমার রোল নম্বর ছিল ১৮। বৃত্তি দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত ১৫ জনের বেশি ছাত্রকে বৃত্তির জন্য আলাদাভাবে পড়াবেন না। আর সেকারণে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারিনি। বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করেছিল তখন। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে পড়াশোনা করে বড় হতে হবে। সেই স্বপ্ন পূরণে আজ এক ধাপ এগিয়েছে। আমার বিশ্বাস, সবার দোয়ায় ভালো কিছু করতে পারব ইনশাআল্লাহ।’
আল-আমিন পড়তে চান মেডিসিন নিয়ে। অসহায় ও দুস্থ মানুষের জন্য কিছু করতে চান। তিনি বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা না করে পড়াশোনা করতাম। পড়াশোনার পাশাপাশি তখন থেকেই হোটেলের কাজে বাবাকে সহযোগিতা করতাম। এতে আমার খারাপ লাগত না, ভাল লাগত। আমার ইচ্ছে মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করব। অসহায় ও দুস্থ মানুষের জন্য কিছু একটা করতে চাই।’
আল-আমিনের মেডিকেলে ভর্তির খবরে স্থানীয় লোকজন, শিক্ষক, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা অনেকেই ফুল নিয়ে বাড়িতে এসে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
মাধবপুর বাজারের ব্যবসায়ী মো. নিজাম উল্লাহ বলেন, ‘এ রকম ভদ্র ও বিনয়ী ছেলে বর্তমানে পাওয়া মুশকিল। ওর মধ্যে হিংসার লেশমাত্র নাই। তার এমন ভালো ফলে শুধু তার বাবা-মা নয়, গোটা এলাকার মানুষ আনন্দিত ও গর্বিত।’
আল-আমিনের বাবা নিজাম উদ্দিন হাওলাদার বলেন, ‘ছোট টিনের ঘর ও ভিটা ছাড়া কিছুই নেই আমার। অভাবের সংসার। জীবনে কোনোদিন কোনো কিছুর জন্য বায়না করেনি আল-আমিন। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা খুবই ভালো, পড়তে বলা লাগেনি তাকে। হোটেলে কাজ করেছে আবার পড়াশোনাও করেছে। গত রবিবারও দোকানে বসে পুরি ও সমুচা বানিয়েছে, ভাত বিক্রি করেছে।’
আল-আমিন ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ায় তিনি ও তার পরিবারের সবাই গর্বিত। তিনি ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।
আল-আমিনের মা নাজমা বেগম বলেন, ‘বাবা আমার বড় ডাক্তার হউক। আমি খুবই আনন্দিত।’
মাধবপুর নিশি কান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়দেব চন্দ্র শিকারী বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছু নেওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকত আল-আমিন। আমার বিশ্বাস সে অনেক বড় মাপের চিকিৎসক হবে এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে অনেক বড় অবদান রাখবে।’