বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:১১ পিএম
আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:১৪ পিএম
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) হলগুলোতে চালু রয়েছে প্রাধ্যক্ষের স্বাক্ষর ফি। হলের সকল আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফরম পূরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষের স্বাক্ষর নিলেই ফি হিসেবে দিতে হয় ৫০ টাকা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কোনো যুক্তিসংগত কারণ না দেখিয়ে রসিদের মাধ্যমে এই টাকা নেওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগেই সেমিস্টার ব্যবস্থা চালু থাকায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বছরে দুবার পরীক্ষায় বসতে হয়। পরীক্ষায় বসার পূর্বশর্ত হিসেবে ফরম পূরণ করতে হয়। প্রতিবার ফরম পূরণে হল প্রাধ্যক্ষের স্বাক্ষরের জন্য দিতে হয় অতিরিক্ত ৫০ টাকা। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীকে বছরে দুবার শুধু ফরম পূরণ বাবদ গুনতে হয় ১০০ টাকা। সে হিসাবে ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিবছর গুনতে হচ্ছে ৩০ লক্ষাধিক টাকা। আড়াই বছর ধরে সচল থাকায় এই খাতে আদায় করা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় কোটি টাকা।
হল প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সালের ৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষ পরিষদের সভায় অনার্স ও মাস্টার্সের সকল বর্ষের ফরম পূরণ ও মান উন্নয়ন পরীক্ষার জন্য ৫০ টাকা ফি আদায়ের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফি আদায়ের এই সিদ্ধান্তের পর শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক জয়ন্তী রানী বসাক এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেন। এতে বলা হয়, ২০২২ সাল থেকে পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় থেকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হলের উন্নয়ন ও বিবিধ ফান্ডের মাধ্যমে এই অর্থ নেওয়া হচ্ছে। এই টাকা হলের শিক্ষার্থীদের কল্যাণমূলক বিভিন্ন কার্যক্রমে যেমন, বার্ষিক অনুষ্ঠান, ডাইনিং কর্মচারীদের বেতনে ভর্তুকি, তৈজসপত্র কেনাসহ বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে ব্যয় করা হয়। শিক্ষার্থীদের অনেকেই এসব বিষয় সম্পর্কে জানেন না বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
প্রাধ্যক্ষ পরিষদের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছেন শিক্ষার্থীরা
এ ব্যাখ্যায় শিক্ষার্থীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন। এখনও তাদের মধ্যে সেই ক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। উপরন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষোভ আবারও দানা বাধতে শুরু করেছে। তারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রশাসন এলেও সিস্টেমের পরিবর্তন আসেনি। তার একটি বড় উদাহরণ হলোÑ হলগুলোতে প্রাধ্যক্ষের এই নিয়মবহির্ভূত স্বাক্ষর ফি আদায়। বিগত প্রশাসনের আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রাধ্যক্ষরা স্বাক্ষর বিক্রির এই নিয়ম চালু করেছিলেন। কিন্তু সেই অবৈধ ব্যবস্থা এখনও বাতিল করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইচ্ছা হলেই নিয়ম বানিয়ে ফি আদায় করতে পারে না। আদায়কৃত এই টাকা ব্যয়ের নির্দিষ্ট কোনো খাতও দেখানো হয়নি। তাই এই টাকা অপব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে।
শিক্ষকরাও বলছেন, এ নিয়ম গ্রহণযোগ্য নয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বলছেন, শিক্ষার্থীদের থেকে স্বাক্ষর ফির নামে টাকা নেওয়ার এই নিয়ম সঠিক নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়। বিবিধ তহবিলের নামে এই টাকা নেওয়া হচ্ছে। এগুলোর কোনো অডিটও হচ্ছে না। অথচ যেকোনো খাতেরই ব্যয়ের অডিট হয়। আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রাধ্যক্ষরা নিজেরাই এ নিয়ম অনুমোদন করেছেন এবং তারপর উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় প্রশাসনও আগে থেকে অবহিত ছিল না।
বিভিন্ন শিক্ষার্থী সংগঠনের ভাষ্য
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের নেতারা বলছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশটিই আসেন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের খরচের বড় একটি অংশই চলে যায় আবাসনে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও আবাসনজনিত সেবা-সহযোগিতা দেওয়াই হল প্রাধ্যক্ষের মূল দায়িত্ব। তাই শুধু স্বাক্ষরের জন্য আলাদা করে ফি আদায়ের কোনো যৌক্তিকতা নেই। একদিকে ফি আদায়ের নতুন নতুন খাত তৈরি করা হচ্ছে এবং পুরোনো খাতগুলোর ফি বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের পকেট কাটা হচ্ছে, অথচ খাবারের ভর্তুকি, চিকিৎসাসেবা, বাসের ট্রিপ ও অবকাঠামো ব্যবহারের সুযোগসহ প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাগুলো সংকুচিত করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের সেবার মানের ক্ষেত্রে অভ্যুত্থানের পরও প্রশাসনে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতানুল ইসলাম রাহী বলেন, ‘স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রাষ্ট্রের একটা বড় বরাদ্দ থাকে। যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তারপরও যদি হলগুলোতে নিয়মবহির্ভূতভাবে স্বাক্ষর ফির নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়, তাহলে সেটি শিক্ষার্থীদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। এসব নামে-বেনামে অযৌক্তিক ফি আদায় দ্রুত বাতিল করে শিক্ষার্থীবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।’
স্বাক্ষর ফি আদায় ‘অযৌক্তিক’ উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আব্দুল মোহাইমিন বলেন, ‘শুধু স্বাক্ষরের জন্য আলাদা করে ফি আদায়ের কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে শিগগিরই ফি আদায়ের নিয়ম বাতিলসহ ক্যাম্পাসের সার্বিক বিষয়ে স্মারকলিপি দেব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘এই স্বাক্ষর ফি নেওয়া সঠিক হচ্ছে না। বিগত প্রাধ্যক্ষরা নিজেদের আয় বাড়ানোর জন্য বিবিধ ফান্ডের নামে নিয়মবহির্ভূতভাবে ফি আদায় চালু করেছেন। এই টাকার কোনো অডিটও হয় না। শিক্ষা খরচ এমনিতেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এভাবে যদি শিক্ষার্থীদের ওপর নানা ফি যুক্ত কিংবা বাড়ানো হয়, তাহলে অবস্থা হবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।’
স্বাক্ষর ফি আদায়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান শোভন বলেন, ‘হলের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকে। প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বের জন্যও শিক্ষক হিসেবে নির্ধারিত বেতনের পাশাপাশি আলাদা ভাতা দেওয়া হয়। তাহলে এই ফি নেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়? বিগত প্রশাসনের নিয়োগ পাওয়া প্রাধ্যক্ষরা স্বাক্ষর বিক্রির এই নিয়ম চালু করেছিলেন। কিন্তু সেই অন্যায্য ব্যবস্থা এখনও বন্ধ হয়নি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও রাবি শিক্ষার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘শুধু স্বাক্ষরের বিনিময়ে ৫০ টাকা ফি আদায় অযৌক্তিক। এটি আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অবৈধ উপায়। একইভাবে প্রায় তিন যুগ ধরে রাকসু না থাকার পরও ফি আদায় করা হচ্ছে। এ ধরনের ফি আদায়ের যৌক্তিকতা দেখাতে পারলে প্রশাসন তা চালু রাখুক, নাহয় এ ধরনের ফি আদায় করা বন্ধ করতে হবে। এই কাজগুলো না করা পর্যন্ত মনে হয় না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখাতে পারবে।’
এই নামে কোনো ফি থাকতে পারে না : উপাচার্য
আদায়কৃত স্বাক্ষর ফি ব্যয়ের নির্দিষ্ট কোনো খাত আছে কি-নাÑ জানতে চাইলে প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক সামিউল ইসলাম সরকার বলেন, ‘প্রতি সেমিস্টারে ফরম পূরণের সময় বিবিধ ফান্ডে এই টাকা নেওয়া হয়। এটা আগের প্রশাসনের সময় থেকেই চলে আসছে।’ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও অসন্তোষের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সম্প্রতি আমাদের নজরে এসেছে। শিগগিরই প্রভোস্ট কাউন্সিল মিটিংয়ে আমরা এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব।’
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘দায়িত্বে আসার পর থেকেই বিষয়টি আমাকে বিব্রত করছে। এই নামে কোনো ফি থাকতে পারে না। এটাকে আমরা তুলে দেব, নাহয় এটা যে স্বাক্ষর ফি না সেটা সুনির্দিষ্টভাবে পরিষ্কার করব। বিষয়টা পরিষ্কার করতে না পারলে এটা রাখাই যাবে না।’