সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:০৬ পিএম
আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:০৮ পিএম
হযরত শাহ আলী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। ছবি : সংগৃহীত
রাজধানীর মিরপুরের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হযরত শাহ আলী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির পর্যাপ্ত জমি, অবকাঠামো এবং শিক্ষক থাকলেও নেই শিক্ষার্থী। এদিকে অবশ্য নজরও নেই শিক্ষকদের। খোদ প্রধান শিক্ষকই পাঠদান পর্যবেক্ষণে উদাসীন। বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা না থাকায় বাড়ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হারও। শুধু তাই নয়, বিদ্যালয়টির ১৫ শিক্ষকের মধ্যে নয়জনের নিয়োগই অবৈধ।
এদিকে পড়াশোনায় শিক্ষকদের নজর কম থাকলেও বিদ্যালয়ের জমিতে বাণিজ্যিক ভবন তৈরির মাধ্যমে আয় বাড়াতে বেশ মনোযোগ দেখা যায়। কোনো চুক্তি ছাড়াই দেওয়া হয়েছে ৭০টি দোকান ভাড়া। এ ছাড়া আরও ৩৫৭ দোকানের ভাড়া থেকে আয়ের উৎসে করও বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি সরকারকে। যার মাধ্যমে হাতছাড়াও হয়েছে বিদ্যালয়টির অধিকাংশ জমি।
১৯৭৪ সালের পহেলা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির নানা অনিয়ম উঠে এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক তদন্তে। সম্প্রতি তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। তদন্ত কর্মকর্তা এসব অনিয়ম খুঁজে বের করার পাশাপাশি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের সুপারিশও করেছেন।
নেই পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী, পড়াশোনায় খেয়াল নেই শিক্ষকদের
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী, কোনো ক্লাসে ১৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী হলে পাঠদানের সুবিধার জন্য একাধিক শিফট চালু করা হয়। বিগত চার বছরে এই বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী ছিল না। অথচ চালু করা হয়েছে প্রভাতি ও দিবা শিফট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বিদ্যালয়টির ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৩ জন আর সপ্তম শ্রেণিতে ৭৬, অষ্টম শ্রেণিতে ৯১, নবমে ১৩৩ আর দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১৯ জন। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হারও চোখে পড়ার মতো। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলও আশানুরূপ নয়।
কমিটির অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের পাঠদানে অনেকটা উদাসীন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা। খোদ প্রধান শিক্ষকই বিদ্যালয়ে কী পড়ানো হচ্ছে তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন না। নেই বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনাও। দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো উদ্যোগ। এমনকি এই উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের মাসিক কিংবা অভিভাবকদের বার্ষিক সভাও হয় না। তাই দ্রুত শিক্ষার্থী বাড়ানোর পাশাপাশি শিফট অনুযায়ী শিক্ষার্থী না দেওয়ার সুপারিশ তদন্ত কমিটির।
বিদ্যালয়ের জমি ভাগাভাগি, হয়েছে বেদখলও
প্রতিষ্ঠাকালে বিদ্যালয়টির নিজস্ব জমির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৬৮ একর। এর মধ্যে ২ দশমিক ৬৭ একর জমি প্রতিষ্ঠানের নামে খারিজ করা হয়েছে। অথচ বর্তমানে বিদ্যালয়ের দখলে রয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫ একর জমি।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, এই ২ দশমিক ৬৮ একর জমির মধ্যে দরগাহ সরকারি প্রাইমারি স্কুলকে শূন্যূ দশমিক ৫ একর এবং হযরত শাহ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজকে ১ দশমিক ৬৭ একর জমি প্রদান করে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি। পরিচালনা কমিটির মিটিংয়ে ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে জমি প্রদান করা হলেও কোনো দলিল করে দেওয়া হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলেজকে দান করা জমি রেজিস্ট্রি না হওয়ায় তা সীমানা নির্ধারণ করে বিদ্যালয়ের দখলে এনে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে বলেছে তদন্ত কমিটি।
৯ শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ, বেতনের টাকা ফেরত দেওয়ার সুপারিশ
তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিদ্যালয়টির ১৫ শিক্ষকের মধ্যে প্রধান শিক্ষকসহ ৯ জনের নিয়োগই অবৈধ। তাদের নিয়োগে অনিয়ম, নিয়োগের সময় সব শর্ত পূরণ না হওয়ায় বেতনের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কমিটি।
এর মধ্যে প্রধান শিক্ষক নার্গিস আক্তারকে ৪২ লাখ ৩ হাজার ৩৫১ টাকা, সহকারী শিক্ষক মাহফুজা আক্তার ও ডলি সাহাকে ৩৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৯ টাকা, শাহনাজ আক্তারকে ২১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩৭ টাকা, জেসমিন আহমদকে ২০ লাখ ৭৬ হাজার ৮০ টাকা, লক্ষ্মী রানীকে ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৩৮৫ টাকা, কহিনুর নেছাকে ১৬ লাখ ৭৯ হাজার ৩৭০ টাকা, হোসনে আরা হেপীকে ১০ লাখ ৪১ হাজার ৬০০ টাকা, ইকবাল আলীকে ৫ লাখ ১৮ হাজার ৭০০ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করেছে এই কমিটি।
ভবন বানিয়ে বাণিজ্য
বিদ্যালয়টি ১৯৭৪ সালে মাধ্যমিকের স্বীকৃতি লাভের পর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্বীকৃতিও লাভ করে। ২০০০ সালে কলেজ শাখাকে বিদ্যালয় শাখা থেকে আলাদা করে ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়। বিদ্যালয় ও কলেজ আলাদা হওয়ার পর ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠানটির তিনপাশে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করার জন্য টেকনোপোল কনস্ট্রাকশন নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেন কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ শিরিন আক্তার। অথচ চুক্তি করার কথা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। এই চুক্তিতে কোম্পানি কতটি আর বিদ্যালয় কতটি দোকান পাবে তার উল্লেখ নেই। ২০০৭ সালে ৩৫৫টি ও ২০১৯ সালে ৩৬টি দোকান নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে কোম্পানিটি।
তদন্ত কমিটি বলছে, কলেজের নামে বৈধ কোনো জমি না থাকায় ভবন নির্মাণের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের চুক্তিটি অবৈধ। এসব দোকান কোটায় কলেজের কোনো মালিকানা নেই। কোনো দোকান কলেজের নামে থাকলে ফেরত আনতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও নির্মিত এই ভবনের ৭০টি দোকান কোনো চুক্তি না করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। যা বিধিসম্মত হয়নি বলেও দাবি কমিটির। এ ছাড়াও এসব দোকান থেকে আদায়কৃত ভাড়ার ভ্যাট দেওয়া হয়নি সরকারকে।
বাণিজ্যিক এই ভবনটির আদায়কৃত ভাড়ার উৎসে কর ও ভ্যাট থেকেও বঞ্চিত সরকার। বাণিজ্যিক ভবনে ডেভেলপার কোম্পানাটির বিক্রি করা ৩৫৭ দোকান কোটার জমিদারি ভাড়া বাবদ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২ কোটি ১১ লাখ ২৯ হাজার টাকা আদায় করেছে। এসব টাকার ১৫ শতাংশ হারে ৩১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৫২ টাকা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে ৭০টি দোকান থেকে আদায়কৃত ২ কোটি ৫৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা ও ৩৫৭ দোকানের জমিদারি ভাড়া থেকে পাওয়া ২ কোটি ১১ লাখ ২৯ হাজার টাকার ৫ শতাংশ করে ২৩ লাখ ২৭ হাজার ২২৫ টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
তদন্তের বিষয়ে হযরত শাহ আলী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নার্গিস আক্তার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এ বিষয়ে কিছু জানতে হলে আমার কাছে নয়, ডিআইএর কাছ থেকে জানুন। আর মন্ত্রণালয় যদি এ বিষয়ে আমাদের কাছে জবাব চায় তাহলে মন্ত্রণালয়কে আমরা জবাব দেব।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক কাজী মো. আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আমরা তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় বাকি ব্যবস্থা নেবে।