কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা
মনির হোসেন রনি
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪ ১৬:৪৯ পিএম
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৪ ১২:৪৩ পিএম
সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। ছবি : আলী হোসেন মিন্টু
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে তাদের এ আন্দোলনে সোমবার (১৫ জুলাই) হামলা হলে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এমন পরিস্থিতিতে সোমবার (১৫ জুলাই) রাতেই কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সংগঠন থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত দুই শতাধিকের বেশি নেতাকর্মী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সংগঠন ছেড়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন।
পদত্যাগকারী নেতাকর্মীদের দাবি, যেই ছাত্র সংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়, নারী শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা করে, তারা সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ নয়। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা অনুচিত।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক নেতাকর্মীরা। বিজয় একাত্তর হলের সহসভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করা শিপন মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন, আমি চলমান ছাত্র-আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান করছি। ন্যায়ের পক্ষে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শোকজ খাওয়া এবং মুচলেকার মুখে পড়া ছাত্র আমি। আমি আজীবন নজরুল। প্রতিবাদ আমার রক্তে। আমি আজন্ম প্রতিবাদী পুরুষ। আমি মো. শিপন মিয়া, সহসভাপতি, বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। চলমান যৌক্তিক ছাত্র আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বিজয় একাত্তর হল-এর সহসভাপতির পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলাম। অন্যায় আর শিপন এক লাইনে থাকে না।
কুয়েত মৈত্রী হল থেকে পদত্যাগ করা জুয়েনা আলম মুন লিখেছেন, আমি জুয়েনা আলম মুন, অর্থ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রলীগকে ন্যায়ের কান্ডারি ভেবে ছাত্রলীগ করতাম। কিন্তু এখন এই সংগঠনের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা ছিল এটা মনে করলেও আমার রক্তাক্ত বন্ধু-বান্ধবী, সিনিয়র, জুনিয়রদের চেহারা মনে পড়বে। তাই স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে পদত্যাগ করছি।
মো. নুরুল ইসলাম হৃদয় লিখেছেন, আমি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বজ্ঞানে অব্যাহতি নিচ্ছি। যেই সংগঠনের নামে আমার বোনের মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে; বোনের গায়ে হাত দেয়, আমার ভাইকে রডের বাড়ি মেরে মেরে আধমরা করে ফেলে দেয় রাস্তায়, তারাই নাকি আমার ভাই-বন্ধু! আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করার অঙ্গীকার করেছিলাম। এটা কখনও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হতে পারে না। আমি লজ্জিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর শাখা ছাত্রলীগের হামলার পর ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ফলে ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ হামলার ঘটনার প্রতিবাদে খোদ শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের প্রায় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ‘ন্যক্কারজনক’ হামলার প্রতিবাদে তারা পদত্যাগ করছেন।
পদত্যাগকারীদের মধ্যে রয়েছেন, শেখ রাসেল হল শাখা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ সামি (দপ্তর সম্পাদক শেখ রাসেল হল), শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ইমরান আহমেদ (বাংলা ৪৮), শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আফরিন আলম রিমি, নিয়ামুল আরফে (বিএমবি ৪৭), খাদিজা জুই ( গণিত ৪৯), সিদরাতুল মুনতাহা ( নবাব ফয়জুন্নেছা হল সেক্রেটারি ), রিপনুল ইসলাম রবিন প্রমুখসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীরা।
ইমরান আহমেদ তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘একটি আদর্শ বুকে নিয়ে কোনোপ্রকার স্বার্থের বাইরে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম। কিন্তু গতকাল রাতের ঘটনার পরেও যদি চুপ থাকি তাহলে নিজের বিবেক আর আদর্শের কাছে সারা জীবন অপরাধী থাকব। আমি ইমরান বশর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য। আজকের পর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সব রকম কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিলাম।’
আফরিন আলম রিমি ফেসবুকে পোস্টে বলেন, ‘বিবেকের কাছে পদ-পদবি, ক্ষমতার জন্য হেরে যেতে পারব না। আমি আফরিন আলম রিমি, আজ থেকে সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে নিষ্কৃতি দিলাম।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
কোটা আন্দোলন কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গণহারে পদত্যাগ করছেন। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্রলীগ কর্মী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার কারণে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। এরই মধ্যে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলের ১৬তম ব্যাচের সব মেয়ে ছাত্রলীগ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, একজন ছাত্র হয়ে আরেকজন ছাত্রের শরীরে এমন নির্মমভাবে যারা আঘাত করতে পারে সেই দল থেকে তারা ইস্তফা নিয়েছেন।
ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রথম পদত্যাগকারী নুসরাত জাহান সুরভী বলেন, ‘আপনিও মানুষ আমিও মানুষ, আপনিও জানেন দেশে কী হচ্ছে! সেই মানবিক দিক বিবেচনা করে আমি শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছি।’
পদত্যাগকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দুনিয়াই সবকিছু না, আখেরাত বলেও কিছু আছে। যে সংগঠনের কেউ মারা গেলে সবাই আলহামদুলিল্লাহ পড়ে এমন সংগঠনে আমার নাম না থাকুক।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ছয়জন নেতা।
পদত্যাগ করা ছাত্রলীগ নেতারা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ শাখার সহসভাপতি মাহমুদুল হাসান সামি ও রসায়ন বিভাগ শাখার সহসভাপতি তাওসিফ কবির, মনোবিজ্ঞান বিভাগ শাখার সহসভাপতি রনি সরকার ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আশিকুর রহমান, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ শাখার সহসভাপতি মাহমুদুল হাসান নোমান এবং শিঞ্জন বসাক।
ছাত্রলীগের এ নেতারা নিজেদের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
মাহমুদুল হাসান নোমান ফেসবুকে লেখেন, আমি নিজ ইচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ শাখা ছাত্রলীগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহসভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে ট্যাগ লাইনে বাকি দিন কাটাতে চাই। একই কথা লেখেন শিঞ্জন বসাকও।