× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

একজন চলচ্চিত্র পরিচালক

হোসেন আবদুল মান্নান

প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৪ ১৫:৩৫ পিএম

একজন চলচ্চিত্র পরিচালক

বুকের ভেতর দীর্ঘদিনের লালন করা স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, করপোরেট অফিসে ঘুরে বেড়াচ্ছে রকিব হোসেন। আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার আশায় সবাইকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে সে। তার বিশ্বাস একবার গল্পটা শোনাতে পারলে যেকোনো রক্তমাংসের মানুষ একটু সংবেদনশীল হয়ে নড়েচড়ে তার দিকে তাকাবে। এটা তার আত্মবিশ্বাস। এমন সুপ্ত বাসনা নিয়ে রকিব ঢাকা শহরের বিত্তবান, শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক, সিনেমা-বোদ্ধা, টিভি চ্যানেল মালিকসহ শিল্প বোঝে এমন লোকের দুয়ারে দুয়ারে হানা দিয়ে চলেছে। তার ধারণা একদিন না একদিন সে সফল হবেই। রকিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সনদপত্র আছে। চাকরিবাকরি তার স্বভাববিরুদ্ধ, এদিকে কখনও পা বাড়ায়নি। শিল্প-সংস্কৃতি তথা চলচ্চিত্র নির্মাণের কলাকৌশল নিয়ে তার নিরন্তর চিন্তাভাবনা।

এ বিষয়ে তার কিছুটা ব্যুৎপত্তি ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছাত্রজীবন শেষ করে নাটক, অভিনয়, আবৃত্তি, সংগীত শর্টফিল্ম ইত্যাদি নানা ঘাটে তার বিচরণ হয়। দু-একজন বোদ্ধা নির্মাতা, স্ক্রিপ্ট রাইটার বা পরিচালকের সঙ্গে জানাশোনা, সখ্য বা অন্তত প্রাথমিক পরিচয় হয়েছিল। এ ভরসা নিয়ে সেও একটা চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে হাত দিয়ে বসে। একই সঙ্গে এর প্রযোজনার ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বও নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়।

রকিবের দিন যায় রাত আসে, বন্ধুবান্ধব পরিচিতজনের সান্নিধ্যে সময় কাটায়। চলচ্চিত্র শিল্প যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। মাঝেমধ্যে রাতের শেষ প্রহরে নিদ্রাভঙ্গ হয়, অদ্ভুতর মধুর স্বপ্ন দেখে সে। এ দেশে একদিন তরুণ চিত্র পরিচালক হিসেবে তার বিশাল স্বীকৃতি আসবে এবং রাতারাতি দেশের মানুষ জেনে যাবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করে রকিব হোসেন নামক এক নতুন পরিচালক একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। তার চলচ্চিত্র দেশের সীমানা ছাড়িয়ে কান বা মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে যাবে, একাধিক ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। দেশি-বিদেশি পত্রিকা ও টেলিভিশনে তার সাক্ষাৎকার প্রচার করা হবে। তার নাম-যশ-খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আরও অনেক অনেক কল্পনাবিলাস সারাক্ষণ তাকে সাদা মেঘের ভেলায় চড়িয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আকাশের দশ দিগন্তে। সে ঢাকা শহরের ফুটপাত ধরে হাঁটে আর সিনেমাটা শেষ করার বিচিত্র চিন্তা মাথায় ভিড় করে থাকে। কোথায় যাবে, কে আর্থিক সাহায্য দেবে? চলচ্চিত্রজগতে যেখানে তার বিশেষ কোনো পরিচিতি নেই, দু-চারটা করারও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি তার নিজস্ব তেমন কোনো অর্থবিত্ত নেই। তার মূল সম্পদ আত্মবিশ্বাস আর একটা অসাধারণ স্ক্রিপ্ট। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ওপর একখানা হৃদয়স্পর্শী মৌলিক গল্প চিত্রনাট্য করে কাজ শুরু করেছে। যে কাহিনী ইতঃপূর্বে মানুষ দেখেনি বা শোনেনি, একেবারে অভিনব, নতুন এবং সত্য ঘটনা কেন্দ্র করে লেখা জীবনের জলছবি।

দুই.

গল্পের লেখক একজন আমলা। আমলা না বলে বলতে পারি সিভিল সার্ভেন্ট। এখানে আমলা শব্দটির সঙ্গে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক নেহাত কম। কাজেই বলা যায় তিনি একজন লেখক। গল্প, নিবন্ধ-প্রবন্ধ লেখালেখিতে তার হাত আছে। লেখাটা একবার এক অখ্যাত কোনো ছোট কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেটা রকিবের নজরে পড়েছিল। রকিব নিজে থেকে সেই লেখক-কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তার মনোবাসনার কথা বলে। লেখক এতে সম্মতি দিতে চাইলে সে-ই একটা পাকাপোক্ত কাগজপত্র করে নিতে বলল। শেষ পর্যন্ত তা-ই করা হলো এবং লেখকের লিখিত অনুমতি নিয়ে সে তার কাজে নেমে পড়ে। চিত্রনাট্য তৈরি, সংলাপ ও কাহিনীর অনিবার্য ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগে পিছে কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হলো।

লেখক বললেন, ‘না এতে সমস্যা নেই, আসলে পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ই কল্পনার রাজ্যে ভেসে বেড়ায়। শিল্পসাহিত্য, কাব্য মানে রূপক হিসেবেই পাঠকের সঙ্গে হেঁটে চলে। সাহিত্য মানে ইংরেজিতে যাকে বলে মেটাফরিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ।’

সিনেমার কাহিনী পেশাদার রাইটারের পরামর্শ নিয়েই প্রণয়ন করা হলো। রকিব হোসেন পুরো বিষয়টা লেখককে অবহিত রেখেই চলেছে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো বিতর্ক না হয় বা আদালত পর্যন্ত না গড়ায়।

এর মধ্যে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হলো। রকিবের কোনো হদিস পাচ্ছে না লেখক মফিজ চৌধুরী। তিনি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং সুপরিচিত মানুষ। ভাবছেন, লিখিত অনুমতি নিয়ে গেল ছেলেটা অথচ সিনেমার কোনো নামগন্ধ শোনা যাচ্ছে না ব্যাপারটা কী! কয়েক দিন যাবৎ তিনি নিজ থেকেই রকিবের সন্ধান করতে থাকেন।

আশ্চর্য বিষয়, একদিন যেন এক কাকতালীয় ঘটনা ঘটে গেল। এক দুপুরে অফিসে বসে মফিজ চৌধুরী রকিবের নম্বরে ফোন দিতে গেলেন। মোবাইল ফোনে দুটো রিং হতেই কেটে গেল বা কেটে দেওয়া হয়েছে এমন। মফিজ সাহেব মনে মনে একটু রাগান্বিত হলেন, কলটা কেটে দিল নাকি রকিব! তাহলে ঘটনা কী?

কিন্তু ঠিক এক মিনিট পর সিনেমার কাগজপত্রসহ একটা কোর্ট ফাইল হাতে মফিজ চৌধুরীর কক্ষে প্রবেশ করল হাস্যোজ্জ্বল তরুণ চলচ্চিত্রকার রকিব হোসেন।

-আরে, আমি যে তোমাকেই ফোন করছিলাম, কী ব্যাপার, এত দিন কোথায় ছিলে?

রকিব বলে,

ভাই, সিনেমাটা নিয়ে সাংঘাতিক দৌড়াদৌড়িতে ছিলাম। এগুলো খুবই ঝামেলার কাজ। তা ছাড়া আমার হাতে তো বেশি টাকাপয়সা নেই।

-যাক, কবে নাগাদ আমরা হলে গিয়ে তোমার সিনেমাটা দেখব?

-জি ভাই, তাড়াতাড়িই হবে ইনশা আল্লাহ। তবে আমি এ ছবির জন্য সরকারি অনুদান চাচ্ছি। তথ্য মন্ত্রণালয়ে সবকিছু জমা দিয়েছি। আপনাকে একটু বলে দিতে হবে।

-সরকার কত টাকা দেবে? সরাসরি প্রশ্ন করেন মফিজ চৌধুরী।

-৫০ লাখ দেবে।

-তা দিয়ে কি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি হবে?

-বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব ভাই। আপাতত তা হলেই চলবে।

একটা সিনেমা হবে, রুপালি পর্দায় ভেসে আসবেÑকাহিনী মফিজ চৌধুরী। এটা কোনো মামুলি হালকা বিষয় নয় বরং তার মধ্যে রীতিমতো উত্তেজনার এক অদৃশ্য প্রণোদনা কাজ করে চলেছে। একদিন অপরাহ্ণে সপরিবার সিনেকমপ্লেক্সে গিয়ে নিজের লেখা গল্প অবলম্বনে তৈরি সিনেমা দেখা হবে। এসব ভেবে আকুল বিহ্বল হন মফিজ সাহেব। তিনি নিজ আগ্রহেই তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন এমনকি মন্ত্রী মহোদয় পর্যন্ত ছোটাছুটি করে অবশেষে অনুদানের অর্থের ব্যবস্থা করে দেন। এবার রকিব মহাখুশি, তাকে আর ঠেকায় কে? তার পা এখন মাটিতে নেই, সে চলছে আকাশে। ইতোমধ্যে পছন্দমতো অভিনেতা-অভিনেত্রী কাস্ট করা হলো। যথাসময়ে শুটিংয়ের কাজ শুরু হলে শিল্পীদের নিয়ে আজ মানিকগঞ্জ তো কাল সাভারÑবিভিন্ন স্পটে যাতায়াত করছে সে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে দু-এক কিস্তি অর্থ ছাড় হয়েছে, সামনে আরও হবে এ আশায় রকিব হোসেন টাকাপয়সা জোগাড় করে শুটিংয়ের কাজটা দ্রুত শেষ করতে উদ্যোগ নেয়।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, তার হাতের টাকায় শতভাগ শুটিং পর্ব শেষ করা গেল না। ৮০% কাজ শেষ করেও সিনেমা নিয়ে রকিব আর এগোতে পারল না। এদিকে মন্ত্রণালয় থেকে একের পর এক তাগিদ আসছে ছবি জমা দিয়ে অবশিষ্ট বাকি টাকা তুলে নিতে। দিশাহারা অবস্থা রকিবের, কোথায় যাবে, কে টাকা দেবে? অগ্রিম চেক দিয়ে, ইন্টারেস্ট দিয়ে, ধারকর্জ কোনোটায় কাজ হচ্ছে না। সঙ্গের অন্যরা যথারীতি ছবি সম্পন্ন করে সব কিস্তির টাকা উত্তোলন করতে সক্ষম হলেও রকিব মাঝপথে আটকে গেল। তার দুই চোখে শর্ষেফুল, বিমর্ষ বিপন্ন সে, যেন হতাশা গ্রাস করছে তাকে। এরই মধ্যে মফিজ সাহেবের সুপারিশে দু-একবার সময় বাড়িয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তিনি টাকা দিতে পারছেন না, কারণ রকিব আত্মবিশ্বাসী ছিল টাকার ব্যবস্থা সে নিজেই করতে পারবে।

এখানে মফিজ চৌধুরীর কোনো দায়িত্ব নেই, তিনি সকল প্রকার দাপ্তরিক সহযোগিতা করে দিয়েছেন। রকিবের আর্থিক অবস্থার এমন করুণ চিত্র আর দৈন্যদশা সম্পর্কে মফিজ সাহেব কিছুই জানতেন না। তিনি তাকে একটা ব্রাইট মেধাবী তরুণ মনে করে লিখিত অনুমতি দিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন।

রকিব নর্থ বেঙ্গলের ছেলে। শান্তশিষ্ট, বিনয়ী, নম্রভদ্র স্বভাব, অতীব সতর্কতার সঙ্গে পথ চলে।

দেখলে যে-কেউ তাকে পছন্দ করবে। তার পারিবারিক অবস্থা মোটামুটি। বাবা অধস্তন সরকারি কর্মচারী ও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অবসরের পরে কিছুদিন হলো মৃত্যুবরণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ করা সৎ, ধার্মিক ও দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন বিধায় তেমন কিছু রেখে যেতে পারেননি।

সমাজে সৎমানুষের যা হয়। ঢাকায় সামান্য একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে। তা-ও আবার টঙ্গী শহর পার হয়ে গ্রামাঞ্চলে। রকিব সেখানেই তার দুটো শিশু কন্যাসন্তান নিয়ে কোনোরকমে বসবাস করে। তার পক্ষে ২০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে সিনেমার অবশিষ্টাংশ শেষ করা একেবারেই হয়ে উঠছে না। কেউ তাকে আস্থায় নিয়ে চেকসমেত ধার দিতেও সম্মত হলো না। গত এক বছরের নিরন্তর ছোটাছুটি পুরোটাই গেল জলে।

তিন.

চেনাজানা সব পথে হাঁটার পর ইদানীং রকিব হোসেনের হতাশার ছাপ যেন তার মুখমণ্ডল ছাড়িয়ে মাথা ভর্তি ঘন চুলের ওপর এসে পড়েছে। কপালের ওপরের দু-চারটা চুলে আকস্মিক পাক ধরেছে। চোখের কুঠরিতেও কালচে রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একদিকে মন্ত্রণালয়ের তাগিদপত্র, অন্যদিকে বাবার অবর্তমানে পরিবারের চাপ, ছোট্ট কন্যাসন্তানের আবদার রক্ষাÑসব মিলিয়ে ত্রাহি ত্রাহি সময়। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে সে মনে মনে ভাবছে আবার সেই মফিজ চৌধুরীর শরণাপন্ন হওয়া যায় কি না। এ বিষয়ে তার স্ত্রী নাজমুন্নাহারই প্রথম এমন পরামর্শ দেয়। স্ত্রীর কথাই তার মনঃপূত হয়েছে, তাই স্থির হলো অবিলম্বে গল্পের লেখক মফিজ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তিনি যদি একটা বিহিত করে দেন। এ মুহূর্তে তার সামনে আর কোনো দরজা খোলা নেই।

সেদিন ছিল রবিবার। সপ্তাহের প্রথম দিন বিবেচনা করে রকিব সকাল সকাল আবদুল গনি রোডের সচিবালয়ে গিয়ে হাজির হলো। তার ধারণা মফিজ চৌধুরী সাহেব পূর্ববর্তী কর্মস্থলেই আছেন। কাজেই সে সরাসরি সেই পুরোনো কক্ষের সামনে গিয়ে উপস্থিত। কিন্তু দরজায় নাম লেখা সুধীর চন্দ্র ঘোষ। ব্যাপার কী?

তার মাথা ঘুরপাকের মধ্যে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন নিম্ন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, মফিজ সাহেব দুই মাস আগে এখান থেকেই অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি এখন পিআরএল অবস্থায় আছেন। তবে কোথায় থাকেন সে তা জানে না। রকিবের কাছে থাকা তাঁর ফোন নম্বরটা অনেক পুরোনো, মফিজ সাহেব তখন দক্ষিণাঞ্চলের কোনো এক জেলার জেলাপ্রশাসক। রকিবের সন্দেহ হচ্ছে এ নম্বর এখনও তিনি ব্যবহার করেন কি না। তবু দোদুল্যমানতার মধ্যে একটা ফোন করে সে, কী আশ্চর্য, দু-তিনটা রিং হতেই মফিজ চৌধুরীর ভরাট কণ্ঠ ভেসে আসে।

-কি হে রকিব হোসেন, অবশেষে তোমার সিনেমাটা মুক্তি পেল বুঝি?

-না ভাই, আপনার সঙ্গে খুব জরুরি কথা বলার আছে। আমি কবে কোথায় দেখা করব?

-বলো কী? আমি তো অনেক দূরে থাকি। সেই মিরপুর স্টেডিয়াম পার হয়ে চিড়িয়াখানার কাছাকাছি।

-ভাই দয়া করে ঠিকানাটা দিন, আমি খুব শিগগিরই সাক্ষাৎ করতে চাই।

মফিজ সাহেব আমতা আমতা করে বাসার আশপাশের একটা লোকেশন দিয়ে বললেন, কাছাকাছি এসে কল কোরো। তোমাকে চিনিয়ে দেব। তবে রওনা করার আগে অবশ্যই ফোন করে নিয়ো। কোথায় থাকি বলা যায় না।

- জি ভাই, আমি নিশ্চয়ই কল দিয়ে আসব।

চার.

বেশি বিলম্ব না করে চলতি সপ্তাহের মধ্যেই দুশ্চিন্তায় ক্লিষ্ট মলিন চেহারার রকিব হোসেন মিরপুরের আঁকাবাঁকা গলি ঘুরে মফিজ চৌধুরীর বাসার সন্ধান পেয়ে যায়। তৃতীয় তলার দক্ষিণমুখী একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে সপরিবার বসবাস করেন তিনি। সরু অপরিসর এক চিলতে বারান্দায় প্লাস্টিকের চেয়ারে মুখোমুখি বসেছেন সিনেমার গল্পকার এবং পরিচালক। রকিব বিরতিহীনভাবে তার সিনেমা তৈরির আদ্যোপান্ত কাহিনীর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। গল্পের শেষ পরিচ্ছদে এসে তার সেই পুরোনো আকুতিÑভাই, আমাকে ঢাকার একজন শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, টাকাওয়ালা মানুষের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিন। দেখবেন, আমি ঠিকই তাকে আমার কাহিনীটা শুনিয়ে টাকা ধার করে নিয়ে আসতে সক্ষম হব। সরকারি টাকা পেয়ে গেলেই তা পরিশোধ করে দেব।

-এটা কীভাবে সম্ভব বলো, এখন আমার কথা কে শুনবে? অবসরপ্রাপ্ত মানুষের এ সমাজে কোনো মূল্য নেই। মানুষ অকৃতজ্ঞ ও বিস্মৃতিপ্রবণ, তারা অতীতকে গুরুত্ব দেয় না। আর তুমি যে এতটা অসহায়ত্ব দেখাবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

-রকিব নাছোড়বান্দা। না, আমার জন্য শেষ একবার কিছু করুন ভাই। প্রয়োজনে আমাকে একজন কালো টাকার মালিকের কাছেই পাঠান। তাকে আমি রাজি করাতে পারব।

এখানে মফিজ সাহেবের কোনো দায় নেই। তিনি তাকে সিনেমা বানাতে বলেননি বরং রকিব হোসেনই এমন প্রস্তাব নিয়ে তাঁর কাছে আসে।

তবু বললেন,

-দেখো, আমি তো আগে চেষ্টা করেছি, সরকারি অনুদান পাইয়ে দিয়েছি, মধ্যে সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন সিনেমার কাজে ২০ লাখ টাকা ধার হিসেবে কে দেবে? এ দেশে যাদের টাকা আছে তারা সহজে কিছু দিতে জানে না। আর দিতে জানা লোকের বেশি টাকা হয় না। তা ছাড়া টাকাওয়ালারা সিনেমা নিয়ে থাকে না। তারা দরকার হলে সিনেমার নায়িকা নিয়ে থাকে।

তবু দেখা যাক চিন্তা করি।

-ভাই আমাকে শুধু আপনিই উদ্ধার করতে পারেন। দয়া করে বিষয়টি দেখবেন। আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখব।

-মফিজ চৌধুরী এবার ভীষণ চিন্তিত হয়ে বললেন, আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত তোমার ছবিটা আলোর মুখ দেখবে না। মনে রেখো, চলচ্চিত্র, শর্টফিল্ম, টিভিনাটক, ডকুফিল্ম ইত্যাদিতে আজকাল কেউ ইনভেস্ট করতে চান না। দেশে এগুলো এখন মুখচেনা কিছু মানুষের ব্যবসাবাণিজ্যের নিরাপদ সেক্টরে পরিণত হয়েছে।

-তবু আমি আপনার মাধ্যমে শেষ একটা ড্রাইভ দিতে চাই ভাইজান।

আমার মন বলছে আপনি পাঠালে কাজ হবে, আমাকে কেউ ফিরিয়ে দেবে না।

-রকিব তুমি যাও। আমাকে ভাবতে দাও। আমি তোমাকে জানাব। এ কথা বলে সেদিন তাকে বিদায় করলেন মফিজ সাহেব।

পাঁচ.

অনেক দিন গত হয়ে গেল। মফিজ চৌধুরী কারও সঙ্গে কথা বলেননি বা রকিবকে কোনো ব্যবসায়ী-শিল্পপতির কাছে পাঠাতে মনেপ্রাণে চেষ্টাও করেননি। তাঁর ধারণা এত দিনে রকিব কিছু একটা উপায় বের করে ফেলেছে। তা ছাড়া তিনি অবসরে আছেন, এ সময় কেউ কথা না রাখলে কষ্ট পাবেন, শুধু শুধু নিজের ব্যক্তিত্ব জলাঞ্জলি দিতে চান না। তিনি জানেন, এ দেশের মানুষের সাধারণ চরিত্র হলো সুবিধাবাদী, ক্ষমতার পূজারি এবং অকৃতজ্ঞ স্বভাবের। কাজেই কার কাছে রকিবকে পাঠাবেন? গেলেই বা কতটা কাজ হবে? এসব দোটানায় পড়ে মফিজ সাহেব সময় ক্ষেপণ করে চলেছেন। তবে রকিব ফোন করলে তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবেন। এরই মধ্যে একদিন আচমকা রকিব ফোন দিয়ে বলল,

-ভাই, একটা বিশেষ কারণে আমি আজই আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। কোথায় আসব? আপনি যেখানে বলবেন আমি আসতে পারব।

মফিজ চৌধুরী অবাক হলেন, তিনি মনে মনে তাকেই চিন্তা করছিলেন।

-তুমি এখন কোথায় আছো? জানতে চাইলেন তিনি।

-আমি সচিবালয় থেকে বের হয়েছি মাত্র, উত্তরায় যাব। আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই আসব।

-ঠিক আছে, তুমি শাহবাগের আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানে আসো। আমি পাঠক সমাবেশের স্টলে আছি।

-ধন্যবাদ ভাই, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসব।

কুশল বিনিময় শেষে দুজন গিয়ে প্রবেশ করলেন একটা ফাস্টফুডের দোকানে। রকিবের বিষণ্ন বদন, উদ্বিগ্ন চোখ দেখে তিনি বললেন,

-তুমি তো মনে হয় সারা দিন কিছু খাওনি। মুখটা শুকিয়ে আছে।

-জি ভাই। মন্ত্রণালয় বলছে এক মাসের ভেতর ছবি জমা না দিলে তারা দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেবে এবং প্রাপ্ত টাকা ফেরত দিতে হবে।

-ঠিক আছে, আগে কিছু খাও। পরে না হয় শুনি।

একটা ক্ষুদ্র পরিসর রেস্টুরেন্টের মিনি সাইজের লাল চেয়ারে দুজন মুখোমুখি বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। রকিবের আসন্ন বিপদের কথা শুনে মফিজ চৌধুরী কিছুটা বিচলিত বোধ করলেও তাকে তেমন বুঝতে দেননি।

-এখন কী করবে ভাবছো?

-ভাই, আমাকে বাঁচানোর একটা ব্যবস্থা করুন। আমি ঘরে-বাইরে কোথাও দাঁড়াতে পারছি না। উভয়সংকটে পড়ে গেছি।

রকিবের করুণ কণ্ঠস্বর যেন খানিকটা জড়িয়ে আসছিল। তার চোখের কোণে কিঞ্চিৎ জলের অস্পষ্ট ছায়া জমে উঠেছে।

মফিজ সাহেব নির্বাক চোখে বাইরে তাকিয়ে। কোনো কথা বলছেন না। ভাবছেন, আমি তো আমার সরকারের পেনশন গ্র্যাচুইটির টাকা থেকে রকিবের সিনেমায় খাটাতে পারি না। এটা হয় না, কখনও সম্ভব নয়। এতে পরিবারের সদস্যদের প্রতি অবিচার হবে। আসলে মানুষ সিনেমা, নাটক, রিসোর্ট ইত্যাদি তৈরি করে উদ্বৃত্ত টাকায়। যার আরেক নাম ‘আইডল মানি’।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা