ইমতিয়ার শামীম
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৩৭ পিএম
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ছাপা হয় ১৯২৯ সালে। রবীন্দ্রনাথের শেষের
কবিতা-ও ছাপা হয় একই বছর। তারপর ৯৫ বছর পেরিয়ে গেছে; অনেক আলোচনা হয়েছে পথের পাঁচালী
নিয়ে, অনেক আলোচনা হয়েছে শেষের কবিতা নিয়ে। শেষের কবিতা পরিপক্ব রবীন্দ্রনাথের লেখা,
তারুণ্য যে ক্ষয়ে যায়নি তা প্রমাণের জন্যই নাকি তার এ মহাযজ্ঞ। অন্যদিকে বিভূতিভূষণ
তখন নতুন লেখক, একেবারেই তরুণ, এতই তরুণ যে প্রশংসাপত্র নিতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাছ
থেকে। রবীন্দ্রনাথ তার দেওয়া সনদপত্রে লিখেছেন, ‘বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।’ বইটি থেকে
তার ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিও খুব স্পষ্ট সে সনদে, ‘এর থেকে শিক্ষা হয়নি কিছুই,
দেখা হয়েছে অনেক যা পূর্বে এমন করে দেখিনি।’ খানিকটা উপেক্ষার
সুরই কি ঝরে পড়ে না তার এ কথায়? আর সেই উপেক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয় একটু সমালোচনাও, ‘এই
গল্পে গাছ-পালা, পথ-ঘাট, মেয়ে-পুরুষ, সুখ-দুঃখ সমস্তকে আমাদের আধুনিক অভিজ্ঞতায় প্রাত্যহিক
পরিবেষ্টনের থেকে দূরে প্রক্ষিপ্তাকারে দেখানো হয়েছে!’
তবে রবীন্দ্রনাথের এ উপেক্ষা কিংবা সমালোচনাকে টেনেটুনে বাড়ানোও যায়
না, পথের পাঁচালী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের পরিমিতিবোধ এতই প্রবল। পথের পাঁচালীর নস্টালজিক
শক্তি, সামাজিক পরিবর্তনের স্রোত রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েনি কিংবা পড়লেও তা নিয়ে কোনো
মুগ্ধতা দেখা দেয়নি তার ভেতরে। খুব খোলাসা করে না বললেও স্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথের কাছে
বিভূতির পথের পাঁচালী সুন্দর আলোকচিত্র ছাড়া কিছু ছিল না। তবে নিজের ভেতর জেগে ওঠা
প্রকৃত অনুভবকে ধামাচাপাও দিতে পারেননি; স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন ‘বিভূতির এ বইটি
দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।’
বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে পথের পাঁচালী ভালো, শেষের কবিতা আরও ভালো।
পথের পাঁচালীতে রয়েছে তার নাড়িছেঁড়া নস্টালজিয়া আর শেষের কবিতায় তার নতুন, জাগতিক ও
আধুনিক এক বেদনার উত্থান। সে এসব বেদনার বহিরঙ্গটুকু নিয়েই মহাব্যস্ত, তাই পথের পাঁচালীর
আপন সত্য কিংবা শেষের কবিতার শেষ সত্য কোনোটাই তার কাঙ্ক্ষিত নয়, কোনোটাই তার পরম আরাধ্য
নয়। এসব তার চোখেও পড়ে না বলতে গেলে।
কী আসলে পথের পাঁচালীর আপন সত্য? শেষের কবিতার শেষ সত্য?
একটি কথা আমরা নিশ্চিত হই পথের পাঁচালী থেকেই, মধ্যবিত্ত আর গ্রামমুখী
নয়, গ্রামকেন্দ্রিক নয়; নিশ্চিন্দিপুর থেকে অপুর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত প্রতিটি
নিম্নমধ্যবিত্তের এমনকি নিম্নবিত্তের শহরমুখী ভাগ্যই দেখতে পাই আমরা। আর গ্রাম ছেড়ে
চলে যাওয়ার এই যে অনুভূতি তাও ঠিক দুঃখময় নয়, যে বিচিত্র অনুভূতিতে অপুর মন তখন ভরে
যায়, ‘তাহা দুঃখ নয়, শোক নয়, বিরহ নয়, তাহা কি সে জানে না।’ যে রেল অপু
আর দুর্গাকে আকৃষ্ট করে, যে রেলে না-চড়ার অতৃপ্তি নিয়ে মারা যায় দুর্গা, সে রেল তো
কেবল ‘বিস্ময় সৃষ্টির’ উপকরণ নয়, তা একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন,
দ্বীপের মতো ভারতবর্ষের গ্রামগুলোকে এক শ্রমশোষণে আবদ্ধ করার বাহন। রেল নিয়ে আসে গতিময়তা,
সেই গতিময়তা দুমড়েমুচড়ে দিতে থাকে পুরোনো ব্যবস্থা ও নৈতিকতা। পথের পাঁচালীর সমাজ মনস্তত্ত্ব
ও শ্রেণিসংস্কৃতি তাই বিভিন্ন ভাঙচুরের পরও তৈরি করে সম্ভাবনার এক অপার জগৎ।
অন্যদিকে শেষের কবিতার মানুষ থাকে শহরে, থাকে প্রাকৃতিক নিসর্গে,
থাকে মনস্তাত্ত্বিক দোলাচলে। তাদের উন্মূল হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই, স্থানচ্যুত হওয়ার
কোনো ঝুঁকি নেই, নেই ক্ষুধায়-দারিদ্র্যে মৃত্যুর কোনো শঙ্কা। কিন্তু মনের দিক থেকে
উন্মূল তারা প্রায় সবাই, তাদের মনের কোনো গন্তব্য নেই, কোনো নির্দেশনা নেই।
ত্রিশের দশকের সামাজিক স্তরবিন্যাসের ওলটপালট নিয়ে এগোতে এগোতে রবীন্দ্রনাথ
আর বিভূতিভূষণ দুজনই দেখেন নানা পরিবর্তমানতা, কিন্তু একজনের দৃষ্টি আটকে থাকে অগ্রসরমান
মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতর, যারা অদূর ভবিষ্যতে রবীন্দ্রযুগ পেরিয়ে আরও প্রকটিত করে তুলবে
মধ্যবিত্তের প্রেমের অতৃপ্তি এবং একসময় সেই অতৃপ্তি থেকে জন্ম নিতে শুরু করবে নানা
নষ্টামি, ভ্রষ্টামি এবং এ মধ্যবিত্ত আর আদৌ হয়ে উঠতে পারবে না সমাজ পরিবর্তনের বাহক
ও সাধক, এ মধ্যবিত্তের জীবন কাটবে বাখোয়াজি করে। আরেকজনের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেই শিক্ষিত
মধ্যবিত্তকে, যে অনেক দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও বিকশিত হচ্ছে, বিকশিত হওয়ার পথে উপনীত
হচ্ছে অচেনা ও প্রতিযোগিতাময় নগরে এবং মূলত তার মধ্য দিয়েই বিকশিত হচ্ছে নতুন বাঙালি
মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যে মধ্যবিত্তকে সমাজ নতুন পরিবর্তনের নেতা করে তুলবে এবং অনেক প্রেমের
অতৃপ্তি নিয়েও শেষ পর্যন্ত তৈরি করবে সামাজিক স্তরবিন্যাস ও মনস্তাত্ত্বিকতা পরিবর্তনের
বিবিধ ইঙ্গিত। নতুন এ মধ্যবিত্ত তার বিবিধ বন্ধনের মধ্য দিয়ে এমনকি রূপান্তর ঘটাবে
গ্রামীণ ক্ষমতার কাঠামোয়। একজনের দৃষ্টিতে প্রেমময়তার প্রতীক অমিত-লাবণ্য-কেতকী; আরেকজনের
দৃষ্টিতে প্রেমময়তার প্রতীক অপু-লীলা-অপর্ণা।
কিন্তু বলতেই হয়, বিভূতিভূষণের নির্মীয়মাণ মধ্যবিত্ত অপুর উজ্জ্বলতার
পাশে রবীন্দ্রনাথের মধ্যবিত্ত অমিত ভয়ানক ম্লান, ভয়ানক বৈচিত্র্যহীন। তার কোনো দারিদ্র্য
নেই, এ বিষয়টি মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলেই বলছি এটা। কেননা অমিতের সবচেয়ে বড় সংকট
তার কোনো দূরযাত্রা নেই। কামলালসা চরিতার্থ করার জন্য তার হাতের কাছে ঘড়া আছে, আর প্রেমবিলাসের
জন্য আছে দূরের সমুদ্র। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের এ মধ্যবিত্ত অমিতরাই বোধকরি কালক্রমে
আরও উচ্চবিত্ত হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রেমকাতরতা যৌনকাতরতায় পর্যবসিত করার প্রস্তুতি
নিয়ে থাকে। লাবণ্য আর অমিতের প্রেম তাই মহীয়ান হয়ে ওঠে না। লাবণ্য যতই চেষ্টা করুক
না কেন ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ শোনানোর, যতই চেষ্টা করুক ‘তোমারে
যা দিয়াছিনু, সে তোমারই দান’ বলে অমিতকে উজ্জ্বল করে তুলতে, অমিতও
পারে না তাতে কোনো মহীয়ানতা যোগ করতে। মানিকের কুবের কিংবা শশীর পাশে রাখলে অমিতকে
রীতিমতো অশ্লীল মনে হয়, অথচ তিনজনই তো এক অর্থে একই মানসিক যন্ত্রণা বহন করে। শশীর
প্রতি কুসুমের কিংবা কুবেরের প্রতি কপিলার আকাঙ্ক্ষায় কী এক মায়া জড়িয়ে থাকে, কুসুম
ও কপিলার যৌনাবেদনও তাই পায় চিরন্তন সৌন্দর্য, কিন্তু অমিত ওই মর্যাদা কখনওই পায় না,
লাবণ্যও পারে না সেই লাবণ্যময় যৌনাবেদন ছড়িয়ে দিতে। বুর্জোয়া হয়ে ওঠার জন্য মধ্যবিত্ত
যে শিল্পসাধনা করে, মধ্যবিত্ত যে নষ্টামির দিকে যেতে থাকে অমিত তারই প্রতিনিধি। অন্যদিকে
বুর্জোয়া নয়, বরং মানবিক এক মানুষ হওয়ার জন্য মধ্যবিত্ত যে জীবনসাধনা করে, প্রেমজবোধের
অন্বেষণ করে বিভূতিভূষণের অপু তারই প্রতিনিধি। অপুকে তাই দেখি লীলার সান্নিধ্যে প্রেমকে
আবিষ্কার, পুনরাবিষ্কার করে নিতে। সমাজের সঙ্গে পাল্লা দেয় না সে, কিন্তু মুহূর্তের
সিদ্ধান্তে সে যে অপর্ণাকে বিয়ে করে বসে, তা সমাজে না হোক; অন্তত তার নিজের জীবনে তো
বিপ্লব ঘটানোর মতো ঘটনাই। যে প্রেম সে খুঁজে পায় জীবনের পাত্র থেকে সে প্রেমের শক্তিতেই
তাকে দেখি অপর্ণার মৃত্যুর পর ঘরছাড়া জীবন বেছে নিতে। এমনকি সন্তানের মায়াও পারে না
তাকে আটকে রাখতে। আবার সন্তানের কাছে সে যখন ফিরে আসে, তা যেন অপর্ণার পরশ পেতেই।
শেষের কবিতার কিছু কিছু উক্তি এখনও কারও কারও মুখে মুখে ফেরে; সেসব
উক্তি যা ছিল ব্যারিস্টার অমিত রায়ের অন্তঃশক্তি; যে অন্তঃশক্তি দিয়ে সে শেষ পর্যন্ত
পলায়নপর হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সফলতা পায়। যেমন ‘ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী।’ কিন্তু এত
বড় একটি বাণী দেওয়ার পরও অমিত রায় ব্যর্থ হয় নিজের একটি মুখশ্রী দাঁড় করাতে। অপু কিংবা
শশীরা অবশ্য অনেক হাহাকার আর নিরুপায়তা থাকার পরও কোথাও আশার আলো জ্বালিয়ে রাখে।
প্রশ্ন উঠবে, এরকমভাবে পথের পাঁচালী আর শেষের কবিতাকে, অমিত আর অপুকে
পাশাপাশি রাখার কিংবা মুখোমুখি দাঁড় করানোর আদৌ কোনো দরকার আছে কি না। সাহিত্যে এ রকম
যৌক্তিকতা দিব্যি দিয়ে প্রমাণ করা যাবে না, কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞানে নিশ্চয়ই এর যৌক্তিকতা
আছে। মানুষকে যে যুগযন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার কত হতাশ্বাস যে আমাদের আঁকড়ে রাখে,
তার কত প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস যে আমাদের নির্বাক করে রাখে! আবার এত কিছুর পরও কোনো এক
আনন্দ কোনো এক পাওয়া আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। পথের পাঁচালী আর শেষের কবিতাও আমাদের সমাজের
দুই মধ্যবিত্তকে, তাদের পরস্পরবিরোধী গন্তব্যকে, তাদের প্রেমময়তার আস্বাদকে বাঁচিয়ে
রাখবে।