হাসনাত আবদুল হাই
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৫৪ পিএম
‘একদা, সোভিয়েত ইউনিয়নে’, ধারাবাহিকের
এ নাম দুই অর্থে। প্রথমত, আমি একদা সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলাম, এ লেখা সেই সফরের অভিজ্ঞতার
ওপর। দ্বিতীয় অর্থ হলো, একদা সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে একটি দেশ ছিল, সে দেশের কাহিনী বলার
চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। বর্ণনা করা হয়েছে দুই ভাবে : (ক) ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হিসেবে এবং
(খ) বই পড়ে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ের তথ্য পরিবেশনার মাধ্যমে।
একদা, সোভিয়েত ইউনিয়নে আধুনিক যুগের রূপকথা। পার্থক্য এই, যে দেশ
নিয়ে এ কাহিনী সেটি কল্পিত নয়, একদিন বাস্তব ছিল। খুব খোলামেলা ছিল না সেই রূপকথার
দেশ, বেশ রহস্যঘেরা। অনেক কিছু ছিল ধূসর অথবা ছায়াচ্ছন্ন। এমন যে দেশ তাকে নিয়ে গল্পগাথা
লেখা হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, লেখা হয়েছেও বিস্তর। এখন যে দেশটি আগের চেহারায়
খুঁজে পাওয়া যায় না, সেটাও এক ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি করে, সেই সঙ্গে নস্টালজিয়া। সেই
মিশ্র অনুভব থেকেই এ কাহিনী বলার সূত্রপাত।
লেখার কথা ছিল অনেক আগে, ১৯৭৮ সালে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ দিনের
সফরে যাই আমি। যে দেশ সম্পর্কে এত শুনেছি, এত বই পড়েছি, তাকে স্বচক্ষে দেখা এক পরম
সৌভাগ্য বলেই মনে করেছি। দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল প্রথম থেকেই, যেজন্য
যা দেখেছি, যা শুনেছি তার ওপর নোট নিয়েছি প্রচুর। কিছু সংলাপও তার মধ্যে ছিল। কিন্তু
মাত্র ১০ দিনে এত বিশাল এবং জটিল দেশ সফর ছিল পাখির চোখে দেখার মতো। তার ওপর ভিত্তি
করে সে দেশকে জানা গেছে মনে করা অর্বাচীনের মতো শোনাবে। কিন্তু পাখির চোখে দেখে ভাসাভাসা
ভাবে লেখা, সেটাও হয়ে ওঠেনি দেশে ফিরেই ক্যামব্রিজে একটা কোর্স করতে যাওয়ার জন্য। তারপর
ঢাকা থেকে অন্য জায়গায় বদলি। কাজ উপলক্ষে আবার বিদেশ যাওয়া। আবার কর্মস্থল পরিবর্তন।
আধুনিক যাযাবরের এ জীবন যাপন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর লেখার বাসনা একসময় উবেই গিয়েছিল।
এত যে ঠিকানা পরিবর্তন, সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নেওয়া নোট কিন্তু হারায়নি,
আমার অজান্তেই সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে। তারপর দীর্ঘ ৪৫ বছর পর, কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার
২৩ বছর অতিক্রম করে এলে সামনে এসে বলল, এবার?
দেখলাম নোটের বয়স হয়েছে, আমার মতোই জীর্ণশীর্ণ ভঙ্গুর। মুখের বলিরেখার
মতো তারও পৃষ্ঠায় দাগ, অস্পষ্ট পড়া যায় কি যায় না। কিন্তু আমারই তো হাতের লেখা, তাই
পড়ে বোঝা গেল তিন-চতুর্থাংশ। দেখলাম কি নিবিষ্ট হয়ে নিয়েছিলাম নোট, কত তথ্য, কত উপাত্ত।
মনে হলো, এদের প্রতি সুবিচার করতে হয়। কত দেশ নিয়ে লিখলাম, এর ওপর না লিখলে অন্যায়
হবে।
সঙ্গে সঙ্গে এ-ও মনে পড়ল, দেশটা এখন নেই। এরপর যেন নোটই বলে উঠল,
তাতে কী? একদিন তো ছিল। সে সময়ের কথাই না হয় তুমি লেখ, সেই একদা, সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে
দেশটার কথা, যে দেশের জন্য নিযুত কোটি মানুষ ঝরিয়েছে ঘাম, ফেলেছে অশ্রু, করেছে রক্তপাত।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দেশ কখনও ছিল না, হতে পারে এ কথা বিশ্বাস করেনি কেউ। কিছু ঘোরগ্রস্ত
(obsessed) মানুষ জীবনযাপনের রীতিনীতি বদলে দেওয়ার জন্য মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে নিয়ে এসেছিল
নতুন জীবনের মন্ত্র, উপকথার প্রমিথিউস যেমন নিয়ে এসেছিল মানুষের মুক্তির জন্য আগুন।
অনেক অশ্রু, স্বেদ আর রক্তের বিনিময়ে সেই দেশটা গড়ে উঠেছিল। একের পর এক কঠিন পরীক্ষার
পর দেখাতে পেরেছিল শোষণহীন সমাজ গড়া সম্ভব, যেখানে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো যায়
উৎপাদন-সম্পদের ওপর ব্যক্তিমালিকানা ছাড়াই।
সেখানে ন্যায়ের সঙ্গে বেশ কিছু অন্যায় ছিল, বিচারের হাত ধরেছিল কখনও
কখনও অবিচার। ভালোমন্দ মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত এসে ভালোর দিকটাই ছিল বেশি, আমার তাই মনে
হয়েছে। আরও ভালো হতে পারত যদি না এত বৈরিতার মুখোমুখি হতে হতো প্রথম থেকেই।