ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:২৩ পিএম
বঙ্গবন্ধুর রেণু, আমাদের বঙ্গমাতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আনন্দমঠ-এর প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালীর স্ত্রী অনেক অবস্থাতেই বাঙ্গালীর প্রধান সহায়। অনেক সময় নয়।’ সন্দেহ নেই, বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি জীবন অনুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধ সত্য উচ্চারণ করেছেন, যার সঙ্গে দ্বিমত করা বাল-চাপল্য হবে। একজন বঙ্গবন্ধু বাঙালি পুরুষ হিসেবে স্ত্রীর সাহচর্য পেয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী, তাঁর রেণু, আমাদের বঙ্গমাতা, তাঁর জীবনে সহায় হয়েছিলেন কি না, তা বঙ্গবন্ধুর স্বীকারোক্তিতেই আছে। ১৯৭২-এর ২৬ মার্চ আজিমপুর গার্লস স্কুলে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন,
‘আমি আমার জীবনে দেখেছি আমি বুলেটের সামনে এগিয়ে গেলেও
আমার স্ত্রী কোনোদিন বাধা দেননি। আমি দেখেছি ১০-১১ বছর জেলখানায় থাকলেও তিনি কোনোদিন
মুখ খুলে প্রতিবাদ করেননি। যদি তিনি তা করতেন তাহলে আমি জীবনে অনেক বাধার মুখোমুখি
হতাম। এমন অনেক সময় ছিল যখন আমি জেলে যাবার সময় আমার সন্তানদের জন্য একটি পয়সাও রেখে
যেতে পারিনি। আমার নিরন্তর সংগ্রামী জীবনে তার প্রচুর অবদান আছে।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে স্ত্রীকে শুধু সহধর্মিণী নয়, একজন সহযোদ্ধা-সহকর্মী
হিসেবে পেয়েছিলেন। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, একজন শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু-বিশ্ববন্ধু
হতে পেরেছিলেন তার স্ত্রীর প্রণোদনায়; অবশ্য স্বীকার্য যে, এতে তার নিজস্ব মেধা-মনন
ও উদ্যম-উদ্যোগও ক্রিয়াশীল ছিল। তবে দুজনের মধ্যে ব্যাপারটি ছিল যেন সোনায় সোহাগাÑ
একে অপরের সম্পূরক/পরিপূরক। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের মূল্যায়নে, ‘নিরহংকার দ্বীপ্তিময়ী
মুজিবপত্নী ...আমাদেরই মতো একেবারে সাধারণ। এই তো যোগ্য অগ্নিপুরুষের সহধর্মিণী।’
ব্যাপারটি শিষ্য তরুণ শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু হোসেন সোহরাওয়ার্দীর
নজরে পড়েছিল। ১৯৪৬-এ বিহারে দাঙ্গা উপদ্রুত অঞ্চলে তিনি শেখ মুজিবকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে
পাঠাতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তার আগে টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীর অনুমতি নিতে বলেছিলেন।
স্ত্রী রেণু চিঠি লিখেছিলেন, যাতে তার নির্দ্বিধ সম্মতি ছিল। চিঠির ভাষা প্রণিধানযোগ্য
: ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন।
দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা
করবেন না। আল্লার উপর আমার ভার ছেড়ে দেন।’৩ এ চিঠির
মর্মার্থ অবহিত হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘মুজিব, সে তোমার
জন্য স্রষ্টার দেয়া অতি অমূল্য দান। অনুগ্রহ করে তাকে অবহেলা করো না’ (Mujib,
she is a very precious gift to you from God. Don’t neglect her, please)|4 মুজিব
কোনোদিন রেণুকে অবহেলা/উপেক্ষা করেননি; এমন মানসিকতা তাঁর ছিল না, বা তার সুযোগও তিনি
পাননি।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে কিছুটা যেন বাস্তবধর্মী আবেগ নিয়ে আবদুল গাফ্ফার
চৌধুরী৫ দুজনের আন্তঃসম্পর্ক মূল্যায়ন করেছেন বস্তুনিষ্ঠভাবে,
অনেকেই জানেন শেখ মুজিব ছিলেন আপসহীন নেতা। বজ্রকঠিন ছিল তার ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু অনেকেই জানেন না, এই বজ্রের চৌদ্দআনা বারুদই ছিলেন বেগম মুজিব। তার সমর্থন,
সাহায্য ও ষোলআনা একাত্মতা ছাড়া শেখ মুজিব আপসহীন নেতা হতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু হতে
পারতেন না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এই নেতৃত্বকে সাহস,
শক্তি এবং সকল দুঃখ ও নির্যাতন বরণের ধৈর্য ও প্রেরণা জুগিয়েছেন এই নারী। এই নারী যদি
আত্মসর্বস্ব হতেন, সংসারসর্বস্ব হতেন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী নিয়ে সুখে ঘর সংসার করতে চাইতেন,
তাহলে শেখ মুজিবের সাধ্য হতো না বছরের পর বছর কারাগারে থাকা, স্বাধীনতার সংগ্রামের
দুঃসাহসী পথে যাত্রা করা, তাতে নেতৃত্ব দেয়া। বাংলার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নামে
কোনো নেতার অভ্যুদয় হতো না; বাংলার আকাশ এত শীঘ্রই স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের আভায় রঙিন
হয়ে উঠতো না।