মোহাম্মদ হোসেন
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:২৯ এএম
জাতীয় নির্বাচন সমাগতপ্রায়। এলাকার জনপ্রতিনিধি ফরিদ জামান বিভিন্নভাবে
তার জনপ্রিয়তা যাচাই করছেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো, তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে
একটা পোস্ট করেছেন এ রকমÑ আমার সংসদীয় এলাকার সম্মানিত ভোটারগণ, গত পাঁচ বছরে আমি উদয়াস্ত
পরিশ্রম করেছি আপনাদের সেবা করার জন্য, আপনাদের সুখদুখে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। এলাকার
অনেক উন্নয়ন সাধন করেছি, যা ইতঃপূর্বে কেউ কখনও করেনি। আপনি কি আমার সার্বিক কর্মকাণ্ডে
সন্তুষ্ট? কমেন্ট বক্সে কেউ বলেছে ‘হ্যাঁ’, আবার অনেক
যদুমধু বলেছে ‘না’। কিন্তু একজন সামাজিকভাবে জনপ্রিয়
ও প্রভাবশালী লোক মাহমুদ হাসানের না-এর ব্যাপারে প্রবল আপত্তি তার। কারণ এ লোক নেতিবাচক
মন্তব্য করার পর থেকে না-এরই প্রবল আধিক্য দেখা যাচ্ছে। তার নিশ্চিত ধারণা, জাতীয় নির্বাচনেও
বহু ভোটারকে প্রভাবিত করবে এ লোক। তিনি এটা বরদাশত করতে পারছেন না। একটু যেন উশখুশ
করছেন। এ নিয়ে আলাপ জুড়ে দিলেন স্ত্রী আনজুমান আরার সঙ্গে, যিনি একই সঙ্গে তার দলের
নেত্রীও।
Ñতো, কী করতে চাও তুমি এখন? আনজুমান জানতে চাইলেন।
Ñসেটাই ভাবছি।
Ñসামনে নির্বাচন। এখন এমন কিছু কোরো না, যাতে তোমার ভঙ্গুর ইমেজ আরও
ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। তাহলে দলও তোমাকে আর সাপোর্ট দেবে না।
সাবধানবাণী ছুড়ে দিয়ে আনজুমান চলে গেলেন অন্দরে। ড্রয়িংরুমের দামি তুলতুলে সোফায় আধশোয়া হয়ে চিন্তিত মনে সেলফোনটা হাতে তুলে নিলেন ফরিদ জামান। ফেসবুকে ঢুকে মাহমুদ হাসানের প্রোফাইলে চোখ বোলাতে লাগলেন। সাবধানি চোখে স্ক্রল করতে করতে একটা পোস্টে গিয়ে তার চোখ আটকে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর ইউরেকা বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি।
দুই.
পুলিশ যখন পৌঁছে, তখন মাহমুদ হাসান বাইরে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তার ঘন কালো চুলে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছিলেন। আর গুনগুন
করে গাইছিলেন। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দিতেই দেখেন জলজ্যান্ত পুলিশ দাঁড়িয়ে
সামনে। একটু যেন ভড়কে গেলেন তিনি। সেটা আড়াল করে ওসিকে ঘরে প্রবেশ করতে দিলেন।
Ñওসি সাহেব, আপনি হঠাৎ?
Ñস্যার, আপনার নামে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে।
Ñমামলা! আমার নামে!! মাহমুদ হাসান যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
Ñজি। মানহানি মামলা। আপনি এক ফেসবুক পোস্টে এ এলাকার জনপ্রতিনিধি
জনাব ফরিদ জামানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছেন। এতে তার মানসম্মানের হানি হয়েছে। সমাজে
তার স্বচ্ছ ইমেজ কলুষিত হয়েছে।
Ñমামলা কে করেছে? ফরিদ সাহেব নিজে?
Ñজি না স্যার। তার দলের ছাত্র সংগঠনের এক পদধারী নেতা আরিফ।
Ñআচ্ছা। কিন্তু ওসি সাহেব, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না কবে কখন কোন
পোস্টে এমপির অবমাননা করা হয়েছে।
Ñআপনি সব জানতে পারবেন স্যার। এখন...।
ওসির ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মাহমুদ হাসান সায় দিয়ে বললেন, চলুন।
ঘরে আর কেউ ছিল না। মাহমুদ হাসানের স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছেন বেড়াতে। তিনি অতিসংক্ষেপে স্ত্রীকে ঘটনা খুলে বললেন মোবাইলের মাধ্যমে। ফোন অফ করার আগে ও-প্রান্তে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন।
তিন.
ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাক্সপেটরা গুছিয়ে বেড়ানোর মাঝখানে
যতিচিহ্ন বসিয়ে দিলেন মাহমুদ হাসানের স্ত্রী মায়মুনা বেগম, মেয়ে আতিয়া আক্তার লিনা
ও ছেলে সরওয়ার টিপু। গন্তব্যের বাস ধরতেও বিলম্ব হলো না। তিনজনেরই মন খারাপ, মুখ গম্ভীর।
মায়মুনা বেগম তো কিছুক্ষণ পরপরই মুখ মুছছেন শাড়ির আঁচল দিয়ে। লিনা মাকে প্রবোধ দিচ্ছে
আর ভাবছে কী করা যায়। এ বিপদের দিনে এদিক-ওদিক যে দৌড়ঝাঁপ করবে সে বয়স এখনো হয়নি টিপুর।
যা করার তাকেই করতে হবে। কিন্তু কীভাবে কী করবে ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
ওরা যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। দিনের আলো দূর হয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চারপাশটা গ্রাস করার জন্য। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। উদ্দেশ্য জনপ্রতিনিধি ফরিদ জামানের সঙ্গে দেখা করা। সঙ্গে নিল টিপুকে। তার আগেই জনপ্রতিনিধির সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে এমন একজন বড় ভাইকে ফোনে অনুরোধ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে নিয়েছে সে।
চার.
লিনার কথা শুনে দামি গ্লাসে ঢাকা টেবিলের ওপাশ থেকে বুলেটের ঝাঁঝে
উপহাসের হাসি ছুড়ে দিলেন জনপ্রতিনিধি ফরিদ জামানÑ বহুদিন পর তোমার মতো রূপলাবণ্যে ভরপুর
একজন প্রকৃত সুন্দরীর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে পেরে আমার ভেতরে ভালোলাগার ফল্গুধারা
বয়ে যাচ্ছে। রোমাঞ্চ রোমাঞ্চ অনুভব করছি। তাই বলে ভেব না, তোমার যৌবনের মিষ্টি হাসিতে
আমার সৃষ্টি নাশ হবে। আর...।
Ñআক্রমণটা খুবই সস্তা ও গতানুগতিক হয়ে গেল না? রেগে গেলেও সেটা চেপে
রেখে ঠান্ডা মাথায় জবাব দেয় লিনা, আপনি হলেন নামিদামি মানুষ। আপনার আক্রমণের ধরনধারণও
হবে সেই লেভেলের।
Ñএকেবারে বাপের মতোই ঠোঁটকাটা হয়েছ দেখছি। তুমি কি জান, ঠোঁটকাটা
লোকদেরই কান কাটা যায় বেশি?
Ñজানি, আপনার উন্মত্ত ক্রোধের শিকার হয়ে আমার বাবা এখন জেলে।
Ñযাদের বাহাত্তুরে পায় তারাই গাল বাড়িয়ে চড় খায় এবং তোমাকে ও তোমার
যৌবনকেও দুর্দশাগ্রস্ত করে দিতে পারি এ মুহূর্তে ঠোঁটকাটামির জন্য। আর এ কলঙ্ক সারা
জীবন বয়ে বেড়াতে হবে তোমাকে।
একটু যেন আঁতকে ওঠে লিনা ভেতরে ভেতরে। ঠিকই তো, উনি যদি একটা অনাকাঙ্ক্ষিত
ঘটনা ঘটিয়ে দেন, ওর করার কিছুই থাকবে না। আলুর দোষের অল্পবিস্তর সুখ্যাতি তার আছে।
দেখা যাবে, সে নিজে দুশ্চরিত্রা গণিকা-বেশ্যা ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত হয়ে যেতে পারে
সমাজে। আর মানুষজন সেটা বিশ্বাসও করবে, সত্য মিথ্যা বিচার না করে লুফে নেবে কাজের ফাঁকে
কিংবা অবসর সময়ের গসিপের জন্য। কারণ মানুষের অবচেতন মন একটা তরুণী মেয়েকে কলঙ্কমাখা
দেখতেই ভালোবাসে।
লিনা হতাশ হয়ে পড়ে। ওর চোখমুখের অভিব্যক্তিতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
Ñআহা, এত নিরাশ হওয়ার কী আছে! কথায় বলে, বসতে জানলে উঠতে হয় না। জনপ্রতিনিধি
মহোদয় আসন থেকে উঠে এপাশে এসে এতক্ষণ ধরে চুপটি মেরে বসে থাকা টিপুকে বাইরে অপেক্ষা
করতে বলেন। তারপর অনেকটা ফিসফিসিয়ে লিনাকে বলতে থাকেন, সবকিছুরই তো একটা বিকল্প উপায়
থাকে, নাকি?
কথা বুঝতে পারার ধোঁয়াশা আর অস্পষ্টতায় জনপ্রতিনিধির মুখের দিকে চেয়ে
থাকে লিনা।
Ñমিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং বলে একটা কথা আছে না? তোমার অনেক সাধের
ওই অপরূপ দেহনিকুঞ্জে আমাকে জাস্ট ক্ষণিকের অতিথি হিসেবে দাওয়াত কর। আমি ধন্য ধন্য
হয়ে তোমার জন্য কী করি দেখ।
ফরিদ জামান এভাবে বেহদ্দ বেহায়ার মতো তার লালসার কথা প্রকাশ করবেন,
ভাবেনি লিনা। তার কুরুচিপূর্ণ কথা শুনে রাগে ক্ষোভে ক্রোধে বিস্ফোরিত হতে থাকে ওর চোখ
দুটো।
Ñওভাবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই, সোনা। রাজনীতি করলেও আমি মূলত ব্যবসায়ী মানুষ। লেনাদেনায় বিশ্বাসী। আমি চাইলে জোর করতে পারি। নয় মণ তেল না পুড়ুক, রাধা না নাচুক, তোমার বস্ত্রহরণে আমার কি কোনো সমস্যা হবে? কিন্তু জবরদস্তিমূলক কোনো কাজ আমার একদম পছন্দ নয়। আমি বিশ্বাস করি, পারস্পরিক আস্থাশীলতার শক্তিতে পর্বতও ঠেলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই তো তোমার মর্জির ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। তুমি সমঝোতা না চাইলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তোমার বাবার হবে জেলজরিমানা। তার আগে উকিল ধরা, আদালতপাড়ায় চোটাছুটি, টাকাপয়সা জোগাড় করা ইত্যাকার নানান ঝামেলা তো আছেই। সবচেয়ে বড় কথা, আমি দেখতে চাই তোমার কাছে তোমার ইজ্জত বড় নাকি বাবার প্রতি তোমার ভালোবাসা।
পাঁচ.
ভারাক্রান্ত মনে ঘুমানোর আয়োজন করছে লিনা। খাওয়ার টেবিলে মা প্লেটে
ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন শুধু, আর বারবার জানতে চেয়েছেন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায়
কত দূর কী হয়েছে। জবাবে যতটুকু বলা যায় বলেছে লিনা। কিন্তু শেষকথা কিছু বলতে পারেনি।
দাঁত ব্রাশ করে যখন শোবার আয়োজন করছে, এলো আশফাকের ফোন।
লিনা ফোনটা কানে ধরে বলল, হুঁ, বল।
Ñকী ব্যাপার, এ রকম বিরসবদন কেন? এ যেন অবাক কলির সৃষ্টি, গুড়ে নাই
মিষ্টি!
Ñমন ভালো নেই।
Ñআহা, কী হয়েছে আমার সোনামণির?
জনপ্রতিনিধির সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বাদ দিয়ে বাকিটুকুর বয়ান দিয়ে
লিনা বলল, কী করব বুঝতে পারছি না।
Ñহুঁ, ভাবনার বিষয় বটে।
Ñআচ্ছা, ক্ষমতাধর কারও সঙ্গে কি তোমার জানাশোনা আছে?
Ñতেমন কেউ নেই। আর আমি হলাম আদার ব্যাপারী, ওসব জাহাজের কারবারিদের
সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেও ভয় পাই। সে যাক গে, তোমার ভিসার খবর কী বল?
Ñভিসার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি আমি।
Ñমানে কী? খুব অবাক হয় আশফাক।
Ñমানে হলো, আপাতত কোথাও যাচ্ছি না আমি। বাবার মুক্তির জন্য চেষ্টা
চালিয়ে যাব।
Ñএ কী বলছ লিনা? স্কলারশিপের সুযোগটা তুমি হেলায়ফেলায় হারাচ্ছ, তা
কি বুঝতে পারছ?
Ñবাবার মুক্তির চেয়ে আমার কাছে স্কলারশিপের গুরুত্ব নিশ্চয় বেশি নয়।
Ñআমার কথা তুমি একবারও ভাবলে না লিনা? তোমাকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসি।
তোমার জন্য কেমন দিওয়ানা আমি, সে তুমি ভালো করেই জানো। তুমি আসবে বলেই আমি এসেছি। না
হলে আমি আসতাম না তোমাকে ছেড়ে এ দূর বৈদেশে।
Ñএ মুহূর্তে আমার কাছে বাবার মুক্তিই সবচেয়ে বড় কথা। এ ছাড়া আর কিছু
ভাবার সময় আমার নেই।
লিনার শেষের কথাগুলোয় একটু বেশিই রূঢ়তা ছিল, কাঠিন্য ছিল যা তীব্রভাবে
আঘাত করেছে আশফাককে। রাগে ক্ষোভে অভিমানে ফোন রেখে দেয় আশফাক। দুই চোখ ভরে ওঠে অশ্রুজলে।
ব্যাপক হতাশায় উথালপাথাল করে বুকের পিঞ্জিরা।
ছয়.
পরদিন আশফাকদের বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে হঠাৎ করেই যেন। মা-বোনেরা
কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলে ভাসিয়ে দেয় নিজেদের। বাবা হয়ে পড়েন বাকরুদ্ধ। সাত সাগর আর
তেরো নদী পাড়ি দিয়ে খবর আসে, গত রাতে পুলিশ নাইটক্লাব থেকে গ্রেপ্তার করেছে আশফাককে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, মদ খেয়ে মাতলামি করে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে সে। আর নাইটক্লাবে আগত
এক কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরীর সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ করেছে, এমনকি শারীরিকভাবে হেনস্থা করারও
চেষ্টা করেছে।