আজাদুর রহমান
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:১৮ এএম
নজর ফেলতেই ফরিদুরের বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল। ইলিশ মাছের মতো
ঝিলিক দিয়ে উঠে ঠিক মুহূর্তেই হারিয়ে গেল না মোমের মতো সুন্দরী মেয়েটা, বরং ফরিদুরের
হাঁ হওয়া মুখের ওপর খানিক থামল। তারপর বিয়েবাড়ির হইচই চিৎকারে মিলেমিশে একাকার হয়ে
গেল। ফরিদুর এ কী দেখল! দৃশ্য এতটুকুই। আর এতেই ওর ভেতরটা তছনছ হয়ে গেল। হাজার বছর
ধরে ঘুমিয়ে থাকা রঙিন মাছগুলো বুঝি বুকের ভেতর একযোগে খলবল করে উঠল! এত আনন্দ লাগছে
কেন! নাঃ, যে করেই হোক মেয়েটার নাড়িনক্ষত্র উদ্ধার করতে হবে। সুযোগ জীবনে বারবার আসবে
না! স্বপ্নে দেখা রাজকন্যাকে মিস করার মানেই হয় না। সমস্ত আয়োজন ছাপিয়ে তাই খানিক দেখা
মুখটাই কেবল প্রকাণ্ড এক ছবি হয়ে ঝুলে পড়ল ফরিদুরের চোখের সামনে। দিনমান ঘুরে ঘুরে
মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে লাগল সে। একবার সুযোগও জুটে গেল কিন্তু কাজ হলো না। কাছে
গিয়েও মুখ খুলতে পারল না সে। কথাগুলো বুক থেকে উঠে গলা অবধি এসে আটকে গেল।... অগত্যা
ভাঙা মন নিয়েই বাড়ি ফিরল সে।
ভালোলাগার কথাটা জানাতেই হবে। এখনকার মতো খোলামেলা নেটওয়ার্ক ছিল
না তখন। একুশের প্রভাতফেরি কিংবা স্বাধীনতা দিবসের মতো দুয়েকটি ছুতো ছাড়া বছরের অন্য
সময়ে কোনো কিশোরীর সঙ্গে আবডালে কথা বলার তেমন সুযোগ হতো না। ডালে ডালে খুঁজে খুঁজে
তাই স্কুল, বাড়ি, কোন ক্লাসের ছাত্রী ইত্যাদি বের করে ফেলল ফরিদুর। মেয়েটার নামও উদ্ধার
করে আনল সে। নাম রুনা। এবার নিজকে যতটা ফিল্মি করা যায় আর কি! শার্ট-গেঞ্জিতে সেন্ট
মেখে বেশ একটা স্মার্টবেশে চলতিপথে রুনাকে ফলো করতে লাগল সে। রুনাদের লাগোয়া এক দর্জিবাড়ি
ছিল। হামেশাই প্যান্ট সেলাইয়ের অজুহাতে দর্জিবাড়ি চলে আসত ফরিদুর। এক পলক দেখতে প্রাইভেট
স্যারের বাসার কোনায় খামোখা দাঁড়িয়ে থাকত। চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। কিন্তু সাত
দিনেও রুনার খবর হলো না। ফরিদুরও হাল ছাড়বার পাত্র নয়। ডিউটি চালিয়ে গেল। সবুরে সব
হয়। লেগে থাকাটাই বড় কথা। মাস দুয়েক বাদে একদিন রুনা আচমকাই ফরিদুরকে দেখে মুচকি হাসি
দিল কিন্তু কথা বলল না। ব্যস। ফরিদুর যেন গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গেল। দর্জিবাড়িতে দাঁড়িয়েই
একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। বাংলা বইয়ের পাতার ভাঁজে চিঠি ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর
রুনার হাতে বইটা ধরিয়ে দিয়েই দৌড়। এরপর আর অসুবিধা হয়নি। পরপর তিনটি চিঠি চালানোর
পর একদিন ফরিদুরকে দেখিয়ে রুনা একটি দেশলাইয়ের বাক্স ফেলে দিল। কুড়িয়ে খুলতেই ফরিদুরের
এত দিনের স্বপ্ন সার্থক হয়ে গেল। ম্যাচের খোলের ভেতর লাভলেটার পাবে ভাবতেই পারেনি সে।
আহ্লাদ আর ধরে রাখে কে! আকাশে বাতাসে সে কি আনন্দ! হাওয়ায় হাওয়ায় দিন কাটছিল ভালোই,
তারপর কে যেন গোলাপি আকাশে কালো ছাই ছড়িয়ে দিল... শেষমেশ প্রেমটা কিস পর্যন্ত গড়িয়ে
গিয়ে একেবারে থেমে গিয়েছিল।
ক্লাস নাইনে থাকতেই রুনার বিয়ে হয়ে গেল। ফরিদুরের বুকে রীতিমতো একটা
ছিদ্র হয়ে গেল। পৃথিবীর কোনো কিছুই আর ভালো লাগত না তখন।... তিন মাস, ছয় মাস। সময়ে
সবকিছু আপনিতেই সামলে যায় বুঝি! বুকচাপা পাষাণ পাথরটাও আলগোছে কখন বোধ হয় নেমে গিয়েছিল।
সবই আসলে দৃশ্যবদলের খেলা। দৃশ্য বদলে গেলে যেমন মনের আয়নায় ইমেজটা দুর্বল হতে থাকে,
তেমন করেই রুনার মুখটা ধীরে ধীরে নিভেছিল ফরিদুরের বুকের মধ্যে।… রুনা এখন
দুই মেয়ের মা। বড় মেয়ে থ্রিতে পড়ে। অনেক বছর দুজনের কোনো দেখাসাক্ষাৎ নেই। ওর মুখের
ওপর ইতোমধ্যে এ কয় বছরে বেশ কয়েকটি ছাপ পড়ে গেছে। ফলে ওর ইমেজটা মরেই গিয়েছিল প্রায়।
কিন্তু গত রমজানে হঠাৎই ও ফোন করল। ফরিদুর যারপরনাই আশ্চর্য হয়েছে! যে মেয়ে জীবন থেকে
হারিয়ে গেছে সে আজ এত দিন পরে কী মনে করে তার সঙ্গে একটা দিনের জন্য ঘুরতে চায়! স্বামী-সন্তান
নিয়ে রুনা ভালোই আছে, এ রকম একটা খবরই কেবল জানত ফরিদুর। কিন্তু এত বছর পর কেন রুনা
একসঙ্গে ঘুরতে চাইছে? রুনা কি তবে পুরোপুরি সুখী হয়নি? তাই বা বলে কী করে। নয় বছরের
সংসারে ফুটফুটে দুটি মেয়ে। জাহাজ কোম্পানিতে স্বামীর মোটা বেতনের চাকুরে। সুখী হতে
আরও কী লাগে! ফরিদুর মানে পায় না।
মেয়েরা কি কিছু আড়াল করে? তুষের আগুনের মতো তারাও কি কোনো অপ্রাপ্তি
বুকের তলে জমা করে রাখে দীর্ঘকাল, যাতে কোনো দিন অগ্ন্যুৎপাত হয় না কিংবা গোপনে রাখা
কোনো বাসনা যা হয়তো মনের সিন্দুকে মেয়েরা বহুকাল আটকে রাখে। এলোমেলো ভাবতে গিয়ে খামোখাই
একটা দুর্ভাবনা জমতে থাকে ফরিদুরের মাথার ভেতর। ভালোবাসা বলে যা বোঝানো হয় তা কি একটা
আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র! নাকি ভালোলাগার আসলে কোনো শেষ নেই! ইনোসেন্ট বলতেও কি কিছু
নেই! ইনোসেন্ট মনে করলেই ইনোসেন্ট, না করলে কিছুই নয়। ফরিদুরের লাস্ট সম্পর্কটার কথাই
যেমন ধরা যাক। শুরুই হয়েছিল শরীর দিয়ে। সম্ভবত সে কারণেই ফরিদুরের জীবনে আজ একজন মেয়েমানুষের
খুব দরকার হয়ে পড়েছে। চাচাতো ভাইয়ের শ্যালিকা রোকসানার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বছর দুই
আগে। রোকসানা বিবাহিতা। বিয়ের বছরের মাথায় স্বামী সৌদি আরব চলে গেল। ভালো রোজগার। মাসে
মাসে হাত ভরে রিয়াল আর বছরান্তে গলা ভরে সোনার গহনা। সংসারে অভাব তো নেই-ই বরং কোনায়
কোনায় ছড়িয়ে পড়েছিল সুখের মুদ্রা। এক সন্তান আর ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ভালোই চলছিল
রোকসানা। কিন্তু ছয় মাসেই সে ঠিক টের পেয়ে গেল, এই একা জীবনের কোনো মানে নেই। নারীর
মন বলে কথা। কত দিন আর পুরুষমানুষ ছাড়া থাকা যায়! মনকে বুঝিয়েসুজিয়ে রাখা গেলেও শরীর
বুঝ মানে না, কথা বলে ওঠে। তা ছাড়া আশপাশের যুবকরাও সময়ে সময়ে গায়ে পড়ে মিশতে চায়।
হাসিমুখে এমন কথা বলে যে মনটা আপনিই দুর্বল হয়ে ওঠে। ওদের চোখের ইঙ্গিত যে রোকসানা
বোঝে না তা নয়। একটু ভালোবাসা, পুরুষমানুষের সাহচর্য তারও তো পেতে ইচ্ছে করে! আর কত
রাত এভাবে একা একা থাকা যায়! কিন্তু কী করা? লোকে কী বলবে, দুর্নাম হবে। তা ছাড়া স্বামীকেই
বা সে কীভাবে ঠকাবে! সব জানাজানি হয়ে গেলে সংসার ভেঙে যাবে। যে নারী একবার বাসরঘরে
ঢোকে, পরের বাসরে তার দাম কত কমে যায় তা সে ভালোই জানে। রোকসানা তাই একবুক তৃষ্ণা নিয়ে
অপেক্ষা করতে থাকে স্বামীর জন্য। বেগানা পুরুষের লোভনীয় হাতছানি সে ইচ্ছে করেই উপেক্ষা
করে চলে। কবে আসবে স্বামী? আশায় আশায় বয়ে চলে রোকসানা।
ফরিদুরের সঙ্গে প্রথম প্রথম এমনি হাবিজাবি কথা হতো। টুকিটাকি সাহায্য
করত সে। এই যেমন যেসব জিনিস গ্রামে মেলানো যায় না সেসব সে শহর থেকে রোকসানাকে এনে দিত।
দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে পাড়ার লোকেরাও এসবে তেমন গা করত না। কিন্তু এক দিন-দুই দিন
করে ক্রমেই ঘন হয়ে যাচ্ছিল ফরিদুর। ওদিকে হরদম মেশামিশিতে দিন দিন যেন নেশাও ধরে যাচ্ছিল
ওর। কোনো কোনো দিন এমনও হতো যে রাত হয়ে গেলেও রোকসানাকে ছাড়তে ইচ্ছে করত না। আঠার মতো
আটকে যেত তার মন। একসময় অবস্থা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকল যে, চোখের আড়াল হলেই ফরিদুরের
মন খারাপ হয়ে যেত।... একদিন বুঝি রোকসানার মনটা ভারী হয়ে ছিল। স্বামীর কথা বলতে বলতে
কেঁদে ফেলল সে। কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকাতে গিয়ে ফরিদুরের কী হয়েছিল কে জানে! হাতটা
অজান্তেই রোকসানার পিঠের ওপর চলে গিয়েছিল। আশ্চর্য, রোকসানা প্রতিবাদ করল না। এরপর
সবকিছু সহজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রেম তো গন্ধের মতো, চেপে রাখতে চাইলেও আটকানো যায়
না, আপনিই ছড়িয়ে পড়ে। পরস্পরের ভেতরে ডুবে যেতে যেতে ওরা একদিন টের পেল পাড়ার লোকজন
চোখে সন্দেহ ঢালতে শুরু করেছে। কী আর করা। প্রেম তো কোনো বাধা মানে না। বাধা এলে বাঁক
নেয় কিন্তু থামে না, সে চলতেই থাকে। ফরিদুর দিনের বেলা তাই তেমন করে আসতে পারত না।
গভীর রাতে শাশুড়ি ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি রোকসানার ঘরে ঢুকে পড়ত সে। তারপর ভোররাতে আলগোছে
গা ঢাকা দিয়ে চলে যেত। চোরের মতো প্রেম করতে গিয়ে ভয় লাগে, নিজকে অপরাধী মনে হয়। কিন্তু
যত বাধা প্রেম যেন ততই দুরন্ত হরিণ হয়ে ছুটতে থাকে। মন-শরীর একযোগে টানলে কি আর সহ্য
করা যায়? রোকসানাও যেন প্রতিশোধ নিচ্ছিলÑ‘বিয়ে করে ক্যান
ফালাইয়া গেলা, টাকাই কি সব? স্বামীর আদর-সোহাগের চেয়ে টাকার মূল্য তোমার কাছে বেশি।’ জালের সঙ্গে
জড়িয়ে যেতে যেতে ফরিদুরের বুঝি হুঁশ হয়েছিল একবারÑ এ কী করছে সে! পরের স্ত্রীকে ভালোবাসতে
গিয়ে একজন পুরুষকে ঠকাচ্ছে! ভাবনা এলেও মন-শরীরের যোগ-বিয়োগ মেলাতে পারেনি। সম্পর্কের
জটিল রসায়নে হাবুডুবু খেতে খেতে একদিন তাই বুঝি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললÑ রোকসানাকে
নিয়ে পালিয়ে যাবে, তারপর নিজেরা বিয়ে করবে। রোকসানাও প্রস্তুত ছিল। একটা মাস শুধু!
আঃ, কিন্তু সময় আর ফুরল না। তীরে এসে তরী ডুবে গেল। বলাকওয়া ছাড়া হঠাৎই রোকসানার স্বামী
এসে হাজির। আর কী আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে রোকসানাও স্বামীর ছায়াতলে নিজকে গুটিয়ে ফেলল।
এত দিন স্বামীকে পর করে রেখেছিল সে আর এখন পরপুরুষকে পর করে দিচ্ছে নাকি! এতো নতুন
এক অচেনা রোকসানা! ফরিদুরকে কাছে টানা দূরের কথা, ভাবগতি এমন যে, ওকে যেন চেনেই না
সে! হায়, এখন কী হবে? মনপ্রাণ সব তো এখন রোকসানার কাছে! কী করবে সে, রোকসানাহীন কোথায়
গিয়ে দাঁড়াবে?
...বিচ্ছেদ হলে যা হয়। দু-তিন মাস লাগাতার বুকে পাথর চেপে দম ধরে
রেখে ছিল ফরিদুর। তারপর ঘোলা জল থিতিয়ে পড়লে যেমন সব শান্ত হয়ে জল পরিষ্কার হয়ে আসে,
তেমন করে ফরিদুরের ভেতরটাও পরিষ্কার হয়ে গেল। রুনা-রোকসানা বলে অপরিহার্য কিছু নেই
আর। দেখেশুনে যেকোনো যুবতীকেই ফরিদুর বিয়ে করে নিতে পারবে এখন। আর যা-ই হোক, একটা বউ
তার দরকার খুব।