মোস্তফা তারিকুল আহসান
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:৩২ পিএম
বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসে আবুবকর সিদ্দিকের (১৯৩৪-২০২৩) প্রধান
পরিচয় হয়তো কবি হিসেবে, তবে তার কথাসাহিত্যিক পরিচয়টি ন্যূন করে দেখবার কোনো সুযোগ
নেই। শক্তিশালী কবির শক্তিমান কলম যে গদ্যের বিস্তৃত ভূমি সমূহ শক্তি-সাহস নিয়ে শাসন
করতে পারে আবুবকর সিদ্দিক তার অন্যতম উদাহরণ। কবির গহন-আত্ম-নিষিক্ত আনুভূতিক জগৎ কথাসাহিত্যিক
জগৎকে প্লাবিত করে। সেই কাব্যিক সরসতা সব সময় সদর্থক অর্থে ব্যবহৃত না-ও হতে পারে।
তবে কবিরা কথাসাহিত্যের জগতে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন সে নজিরও আমাদের
অভিজ্ঞানে রয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক ও আল মাহমুদের কথা এ প্রসঙ্গে বিবেচনা করা যায়। সেই
একই প্রসঙ্গে পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি আবুবকর সিদ্দিককে আমরা অন্যতম শক্তিমান কথাকার
হিসেবে স্বীকৃতি দেব।
আবুবকর সিদ্দিক শক্তিমান কথাসাহিত্যিক। বিশেষত ছোটগল্পে তার দক্ষতা
অসামান্য। ত্রিশের দশকের শক্তিমান ধারার প্রত্যক্ষ অনুসারী আবুবকর সিদ্দিক কবিতার বেলায়
যেমন শিল্পের উত্তীর্ণ-নান্দনিকতার ব্যাপারে আপসহীন, তেমন কথাসাহিত্যে তিনি কোনো সহজসরল
পথ বেছে নেননি। বরং গদ্যের কঠিন বাস্তব জগৎ নির্মাণে নিজেকে অভিজ্ঞ করে তুলেছেন বাংলার
নানা জনপদ ঘুরে, অজস্র ও নানা প্রকার মানুষের সঙ্গে মিশে। বাল্যকাল থেকে দুই বাংলার
জনপদে ঘুরে, পুস্তকের জ্ঞান-আনন্দ-বিস্ময়-মাখা চোখে নিজেকে শিল্পী করে তোলার প্রত্যয়
তিনি ধারণ করেন অন্বিষ্টভাবে। বলা যায়, লেখক হয়ে ওঠার মৌলিক অভিজ্ঞান তিনি সঞ্চয় করেছেন
বাল্য-শৈশব থেকে। এবং তা আজও অবিশ্রান্ত গতিতে চলছে। গল্প লিখতে গিয়ে পূর্বসূরিরা তাকে
প্রলোভন দেখিয়েছেন প্রথম পর্যায়ে, সামান্য সময় পরই তিনি তা বুঝে ফেলে সে পথ পরিত্যাগ
করেছেন স্বজ্ঞানে। নিজস্ব পথ, মৌলিক গল্পরেখা তৈরি করতে ‘অবিনাশী আয়োজন’ ও প্রস্তুতি
নিয়েছেন। অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম, মেধা, মনন ও পঠনপাঠনের ব্যাপক প্রতিফলনে তার গল্প হয়ে
উঠেছে শানিত, উজ্জ্বল। এবং তা একই সঙ্গে কাঠামো ও ভাষাবোধের অপূর্ব নিদর্শন।
কবি, গীতিকার (স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য অসাধারণ গানের রচয়িতা,
রুদ্রমঙ্গল তার গানের সংকলন) আবুবকর সিদ্দিক বেড়ে উঠেছেন দুই বাংলার জনপদ ও জনগণের
সঙ্গে আজন্ম নিবিড় সান্নিধ্যলাভের মধ্য দিয়ে। কবিমনের অতল জিজ্ঞাসা থেকে হয়তো প্রাথমিকভাবে
বাংলার রূপ দেখতে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার গভীর অনুধ্যানসহ সাহিত্য
ও সাহিত্যসংশ্লিষ্ট পাঠ। ত্রিশের বা চল্লিশের আধুনিকতার মর্মমূলে যে শেকড়সন্ধানী, মাটিঘেঁষা
জীবনবোধ যুক্ত ছিল, বামধারার জীবনবাদী শোষণমুক্ত সাম্যচিন্তার যে আহ্বান ছিল আবুবকর
সিদ্দিক তা দ্বারা স্নাত হন। রাজনীতি, সমাজনীতি, অত্যাচার, নিপীড়ন, দারিদ্র্য, ক্ষুধা,
মানবতার মৃত্য তাকে আলোড়িত করে। সে কারণে ব্যক্তিগত মানুষের জীবনের মানবিকতার ভাষা
লিখতে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেনÑতার সামনে নাঙা-ভুখা-নগ্ন অত্যাচারিত বাংলাদেশ। সমগ্র
সমাজের চিত্র আঁকতে গিয়ে তার নেপথ্যের কাহিনী বর্ণনা করতে তিনি অক্লান্তÑনিজেকে নতুন
নতুন পরীক্ষার সামনে হাজির করেন। কবিসত্তার ভেতরে যে আনুভূতিক অনুরণন, তাকে মোটা দাগে
ব্যবহার করে তিনি গল্প তীক্ষ্ণ-ক্ষুরধার করে ফেলেন। কবির শব্দবোধের জগৎ গল্পে নতুনভাবে
পাখা মেলে। ফলে তার শিল্পসত্তা বাংলার অসহায় মানুষ, নষ্ট রাষ্ট্রযন্ত্র, মানবিক জগৎ
মথিত করে নতুন নতুন গল্পের ভুবন তৈরি করে। অনেক দেরি করেই তিনি গল্প লিখতে শুরু করেন
কবিতার তুলনায়। তবে এ ধারণা করা ভুল হবে যে, তার ভেতরে কথাসাহিত্যের সত্তা প্রথমত ছিল
না। তিনি কবিতার জন্য তৈরি হয়েছেন, শৈশবে-যৌবনে খ্যাতি পেয়েছেন, একই সঙ্গে নিজেকে প্রস্তুত
করেছেন ধীরে ধীরে কথাসাহিত্যের জন্য। গল্পের প্লট, পরিবেশ, চরিত্র বর্ণনা, উপস্থাপনা
এবং সর্বোপরি নিজস্ব ভাষা তাকে তৈরি করতে হয়েছে। কবিতার ভাষা দিয়ে গল্পের শক্ত জমিনে
রেখাপাত করা যাবে না তিনি তা জানতেন ভালোভাবে। অর্থনৈতিক শোষণ, সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের
লোলুপ থাবা, সামন্তের ধারালো অস্ত্র অসহায় গরিব শ্রেণিকে কীভাবে নিঃস্ব করে ফেলেছে
এই স্বাধীন বাংলাদেশে, তারই মর্মন্তুদ ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি মার্কসবাদী তত্ত্ব ব্যবহার
করেছেন অনুঘটক হিসেবে। তবে সত্যিকারের গুণী শিল্পীর মতো তত্ত্বকে সরাসরি সাহিত্য হিসেবে
ব্যবহার করেননি এবং তার প্রয়োগে যে অসম্ভব কুশলী হতে হয় তা তিনি জানেন। সেজন্য বামধারার
সমাজ-অর্থনীতিতে বিশ্বাসী হয়েও তার গল্পে তা কখনও আরোপিত হয়নি। অর্থাৎ শিল্পী আবুবকর
সিদ্দিক শুধু শিল্পের কাছে নিবেদিত। এ ক্ষেত্রে তার আরাধ্য নিখুঁত উজ্জ্বল প্রকৃত শিল্প,
যার সঙ্গে কোনো আপসকামিতা থাকতে পারে না। সেই প্রকৃত শিল্পমানস তিনি পেয়েছেন পঠনপাঠন
ও পূর্বসূরিদের কাছ থেকে।
বাংলার বিভিন্ন জনপদ নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে আবুবকর সিদ্দিকের মানসে
যে দ্যোতনার জন্ম হয়েছে তা দিয়েই তার গল্পের ভুবন তৈরি। তার গল্পের ভুবন এত বিস্তৃত
যে তাকে কখনও পৌনঃপুনিকতার নির্বেদে ডুবে যেতে হয়নি কিংবা সস্তা রোমান্টিক দাম্পত্য
পরকীয়া অথবা অধুনা নাগরিকতার বমন নিয়ে গল্প লিখতে হয়নি। অর্থাৎ তার অভিজ্ঞান অফুরান,
সেই বিস্তৃত-বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞানের আলো তাকে পথ দেখায়; বাংলার মানুষের সীমাহীন মানবিক
সমস্যা তাকে আক্রান্ত করে। অভিজ্ঞতার সারাৎসার নদীর পলিমাটির মতো ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কের
কোষে কোষে সঞ্চারিত হতে থাকে। সেখান থেকে তিনি সুবিধামতো দৃশ্যকে আলাদা করেন, প্রয়োজনীয়
চরিত্র বেছে নেন, উপযুক্ত ভাষা সরবরাহ করেন। সব মিলিয়ে নিজস্ব এক প্রকরণগত মণ্ডনক্রিয়ার
মধ্য দিয়ে তার গল্প এগোতে থাকে। মানবিক বিপর্যস্ত বোধ বাণীবদ্ধ করতে গিয়ে অপূর্ব রস
সঞ্চারে কুণ্ঠা বোধ করেন না, শালীন-অশালীন সেখানে তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায়; জীবন হয়ে দাঁড়ায়
একমাত্র আরাধ্য। উত্তরবঙ্গে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার সময় এ অঞ্চলের জনপদ বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ
ও এখানকার জনমানুষের কাছাকাছি আসেন তিনি। তারও আগে তার অভিজ্ঞতা পোক্ত হয় দক্ষিণবঙ্গের
বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা নিয়ে।
সুন্দরবন ও সংলগ্ন বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলের সাধারণ ব্রাত্য
মানুষ, মধ্যবিত্ত, বামপন্থি-চরমপন্থি, মহাজন-মুৎসুদ্দি-দালাল, লুম্পেন, ভণ্ড-রাজনীতিক,
উঠতি ধনপতি এবং সুন্দরবনকে সঙ্গী করে বেড়ে ওঠা মানুষ এমনকি স্বয়ং বড়ে মিয়া (বাঘ) নিয়ে
স্বাচ্ছন্দ্যে গল্প লিখে চলেন তিনি। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে জন্মসুবাদে এ অঞ্চলের উপভাষা
তার নখদর্পণে; যা নতুন করে বলার নেই। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা রাজশাহীর ভাষায় তার দক্ষতা
ঈর্ষণীয়। আঞ্চলিক ভাষায় গল্প বুনতে গিয়ে তিনি আলাদা ডিকশন তৈরি করে ফেলেছেন। সে হিসেবে
ওই দুই অঞ্চলের ভাষা ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি তার গল্পের অন্যতম উপাদান। এ থেকে তার গল্প
আলাদা করা কঠিন। দুর্ভিক্ষ, মারি, অনটন, সামন্তবাদী অত্যাচার এসব তার গল্পের মুখ্য
প্রসঙ্গ যা আগেই বলেছি। তবে এর বাইরে তথাকথিত সভ্যভব্য ব্যক্তি ও তাদের ক্যারিকেচার
নিয়ে শিষ্ট বাংলায়ও তিনি যে গল্প লিখেছেন; তা-ও নেহাত কম নয় (কুয়ো থেকে বেরিয়ে, আমি
কমিউনিস্ট)। দাম্পত্য তার গল্পে এসেছে, তবে তার ঝোঁক সেদিকে বেশি নয়। বাদা বা সুন্দরবন
প্রসঙ্গে তিনিই সম্ভবত একমাত্র পরিপক্ব গল্পকার। নিজে বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং ওই
দলীয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে বামপন্থি রাজনীতির খোলনলচে বের করে এনেছেন গল্পে।
দারিদ্র্যকে গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছেন অনেকবার এবং কখনও মনে
হবে দারিদ্র্য নিয়ে তিনি আলাদা দর্শন আমাদের সামনে বয়ান করতে চান। ‘মঙ্গাকালের প্রণয়মঙ্গল’, ‘ভোগবৈরাগ্য’, ‘মরে বাঁচার
স্বাধীনতা’ এসব গল্পে দারিদ্র্যকে আলাদা মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা
রয়েছে। যে বাস্তব পটভূমি থেকে তিনি দরিদ্র সমাজের ছবি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন তাকে
আপাতভাবে অবাস্তব মনে হবে। মনে হবে তিনি বাড়াবাড়ি করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই
যে সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে এ দেশের মানুষ নিপতিত হয়েছিল তার বর্ণনা অবাস্তব নয়।
অনিয়মতান্ত্রিক শাসনের ফল হিসেবে এই ভয়াবহ দারিদ্র্য বা দুর্ভিক্ষ আমাদের স্বপ্নভঙ্গের
অতিশয় বাস্তব উদাহরণ।
ষাট বা পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের ছোটগল্পের যে ধ্রুপদি রচনাকৌশল তা
আবুবকর সিদ্দিকে উপস্থিত; তবে তিনি আলাদা হয়ে গেছেন নিজস্বতা দিয়ে। গল্প তৈরির ক্ষেত্রে
তার নিজস্ব কিছু মণ্ডনক্রিয়া রয়েছে। শব্দ, বাক্য, আবহ, রস, শ্লেষ এবং নাটকীয় এক ভাষিক
গতি মিলিয়ে গল্পের কাহিনী আমাদের সামনে নতুন মাত্রায় পরিস্ফুট হয়। বলা যায়, বাবুই পাখি
যেমন বাসা বাঁধে তেমন নিশ্ছিদ্র, পরিপাটি ও চমৎকার একটি অবয়ব তিনি তৈরি করে ফেলেন,
গেঁথে ফেলেন। এ গাঁথুনির ইট, সুরকি, বালু, সিমেন্ট কিংবা অন্যান্য যন্ত্রপাতি তার নিজস্ব
মেকানিজমে তৈরি। সে কারণে যদি কোনো বড় দুর্বলতাও কোনো ত্রিকালদর্শী সমালোচক খুঁজে পান
তবু তা আবুবকরীয়। অর্থাৎ তার গল্পের ভেতরে, প্রতিটি গল্পের ভেতরে আবুবকর সিদ্দিক স্বয়ং
উপস্থিত তীব্রভাবে। ১১টি গল্পগ্রন্থের শতাধিক গল্পের মধ্যে তাকে হঠাৎ বা কদাচিৎ খানিকটা
শ্লথ মনে হতে পারে; তা হয়তো সব বড় লেখকের বেলায়ই হয়ে থাকে। সব আপাত-অসফল গল্পের ভেতরেও
তিনি তার সৃজনবীজ চালিয়ে দেন নিভৃতে। গল্পের চরিত্র, ভাষা, সংলাপ, আবহ এবং ব্যক্তির
অন্তর্গত তার স্বতন্ত্র শিল্পীসত্তা দ্বারা উজ্জ্বল।