× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অন্ধকারের মৃত্যু

এমরান কবির

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:২৫ পিএম

অন্ধকারের মৃত্যু

কায়েস কায়সার সাহেবের প্রিয় অনুষঙ্গ এখন অন্ধকার।

কী গল্প, কী উপন্যাস, কী কবিতা, কী আত্মসংশ্লেষণমূলক রচনাÑ সব ধরনের লেখাতেই অন্ধকারের অনুষঙ্গ এসে যাচ্ছে। তিনি সাধারণত স্বয়ংক্রিয় ভাবের প্রতি আস্থাশীল। হৃদয় থেকে কোনো কিছুর চাহিদা উৎপন্ন না হলে সচরাচর কোনো কাজে প্রবৃত্ত হন না। কী লেখালেখি, কী অন্য কিছু। অবশ্য জগৎসংসারে সব সময় হৃদয়ের চাওয়া পূরণ হয় না। হৃদয়-মন না চাইলেও কত কিছু করতে হয়! কিন্তু লেখালেখিতে তিনি এ বিষয়ে একটুও ছাড় দেন না। হৃদয় না চাইলে, হৃদয়ের ভেতর থেকে চাহিদা উত্থিত না হলে তাকে দিয়ে সাহিত্যের কোনো কাজই করানো যায় না। এমনও হয়েছে কোনো একটা লেখা শুরু করেছেন তিনি, পাগলের মতো লিখছেন, হঠাৎ ক্ষান্ত দিলেন। লেখাটি সম্পন্ন করলেন না। কারণ হৃদয় টানছে না। তিনি শুরু করে দিলেন অন্য আকেটি নতুন লেখা, কিংবা শুরু করলেন হঠাৎ থেমে যাওয়া অন্য লেখা সম্পন্ন করতে। তিনি কখনও এ হৃদয়ের টান থেকে বের হতে চান না। মনে করেন হৃদয় না চাইলে কোনো কিছু করা উচিত না। সে কাজে আর যা-ই থাকুক, দেহ থাকুক, কাঠামো থাকুক, রক্তমাংস থাকুক, রক্তপ্রবাহ থাকুক কিন্তু প্রাণ থাকবে না। আর প্রাণ না থাকলে সে শিল্প অর্থহীন।

হৃদয়ের এ সম্মতিই কায়েস কায়সার সাহেবের কাল হয়ে যাচ্ছে কি না ভাবছেন তিনি। কারণ তার হৃদয় অন্ধকারের অনুষঙ্গ ছাড়া কোনো কিছুতেই এখন সায় দিচ্ছে না। গল্প লিখতে লিখতে, অসম্পূর্ণ উপন্যাস সম্পূর্ণ করতে বা আরেকটু এগিয়ে নিতে যখনই প্রবৃত্ত হচ্ছেন, তখনই অন্ধকারের বিষয়টি এসে যাচ্ছে। এবং কী অপূর্ব কাকতাল, তা গল্প বা উপন্যাসের বিষয়ের সঙ্গে মিলেও যাচ্ছে, অনুষঙ্গের সঙ্গে খাপ খেয়ে যাচ্ছে। অথচ যেখানে তিনি আধা সম্পূর্ণ হওয়া গল্প বা উপন্যাস লিখে রেখেছিলেন তখন অন্য অনুষঙ্গ ছিল। কিংবা এরপর কী হবে তা না ভবেই রেখে দিয়েছিলেন। এখন ওইসব লেখা সম্পূর্ণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে কী অভূতপূর্বভাবেই না অন্ধকারের অনুষঙ্গে মিলমিশ খেয়ে যাচ্ছে।

লেখকজীবনে তিনি যে এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি তা নয়। এমনও হয়েছে একটি লেখা শেষ করার পর অতৃপ্তি নিয়ে রেখে দিয়েছেন। দশ-বারো বছর পর সেই লেখার একটা যথার্থ সমাপ্তি টানতে পেরেছেন। অর্থাৎ লেখার সন্তুষ্টজনক সমাপ্তি টানতে তাকে দশ-পনেরো বছরও অপেক্ষা করতে হয়েছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক লেখাগুলোর অনুষঙ্গ হিসেবে যখন অন্ধকার এসে যাচ্ছে তখন নতুন লেখাই হোক, অসম্পূর্ণ লেখাই হোক সব ধরনের লেখাতেই অপূর্বভাবে মিথস্ক্রিয়া করছে অন্ধকার। মিলে মিশে যাচ্ছে।

যেমন কিছুদিন আগে একটা কবিতায় তিনি লিখেছেন দীর্ঘ দীর্ঘ অন্ধকার। কবিতার এ লাইনে এসে তিনি ভাবলেন অন্ধকারের আগে একটি শব্দ যোগ করবেন কি না। ভাবলেন শব্দটা সুদীপ্ত হলে কেমন হয়! অর্থাৎ লাইনটি হবে দীর্ঘ দীর্ঘ সুদীপ্ত অন্ধকার। শুধুই অন্ধকার দিলে সুনির্দিষ্ট নেতিবাচকতা চলে আসে। কবিতায় এ ধরনের ভাবনার প্রয়োগে কবি হিসেবে আশার আলো না দেখানোর একটা ব্যাপার থাকে। কিন্তু কবি কি শুধু অন্ধকারের কথাই বলে যাবেন? কোনো আশার আলোর কথা বলবেন না? এদিকে সুদীপ্ত শব্দটা যোগ করলে অন্ধকার শব্দটাও তার টোটাল নেতিবাচকতা থেকে একটু মুক্তি পায়। এটা আবার স্ববিরোধী চিত্রকল্পের জন্ম দেবে কি না ভাবতে থাকেন। একসময় সিদ্ধান্ত নেন সুদীপ্ত শব্দটা তিনি রাখবেন।

কবিতাটি লেখার পর একটি দৈনিকে পাঠালেন। পরের সপ্তায় খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ পেল।

অন্ধকারের আবহ নিয়ে সুদীপ্ত শব্দসহযোগে যে চিত্রকল্পের সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললেন। সবই প্রশংসাসূচক। তিনি লেখার সময় যে অনুষঙ্গ নিয়ে ভাবেননি পাঠক-লেখকরা বিশ্লেষণ করার সময় সেসবও উল্লেখ করলেন। লেখালেখির এ বিষয়টা লেখক কায়েস কায়সার খুব এনজয় করেন। মনটা আনন্দে ভরে উঠল। অন্ধকার আর অন্ধকারের আবহ নিয়ে তার ভেতরে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল তা কেটে গেল।

রাতের বেলা একজন মিষ্টি কণ্ঠের রমণী ফোন করে কবিতাটির খুব প্রশংসা করলেন। সুদীপ্ত অন্ধকার নিয়ে কবির মুখে বিশ্লেষণ শুনতে চাইলেন। কবি কায়েস কায়সার বলতে থাকলেন এ কবিতার জন্মপ্রক্রিয়ার কথা। বলেলেন এ শব্দবন্ধ নিয়ে তার দ্বিধাদ্বন্দ্বের কথা। অকপটে বললেন। কোনো রাখঢাক ছাড়াই। অনেক কথার শেষে বললেন, বর্তমান সময়ের অন্ধকার দিকটাকে সুদীপ্ত শব্দের মাধ্যমে একটু আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে, যাতে শাসকগোষ্ঠী কবিতাটির প্রকৃত মর্মার্থ উপলব্ধি করতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। জানেনই তো, এ সময় এক ধরনের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এ কথা বলার পর মিষ্টি রমণীকণ্ঠ আর মিষ্টি থাকল না। হঠাৎ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিস্টার কায়েস সাহেব, সময়টা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এরকম একটা ভাবনা আপনার মাথায় এলো কীভবে? আপনি কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন?’

অকস্মাৎ এ ধরনের বাক্যবাণে কবি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। মিষ্টি কণ্ঠের এই রমণীকে তখন আর ভক্ত পাঠক বা লেখক মনে হলো না। মনে হলো রুক্ষ তিরন্দাজ; যা তার কবিতার চিত্রকল্প ভেদ করে এসে বুকে আঘাত করছে। কবি নিশ্চুপ রইলেন।

এরপর রুক্ষ রমণীকণ্ঠ বললেন কোনো ভূমিকা না দিয়েই, ‘কায়েস সাহেব, আমি বেশি কথা বলব না। শুধু বলব এত অন্ধকারের ভেতরে না যাওয়াই ভালো। এত অন্ধকারের ভেতরে গেলে দিনে অন্ধকার দেখবেন আর রাতে দেখবেন তীব্র আলো। এত আলো দেখবেন যে কিছুই দেখতে পাবেন না।

কায়েস কায়সার সাহেব চুপ করে রইলেন। কিছু বললেন না। রুক্ষ রমণীকণ্ঠ বলতে থাকলেন, ‘আপনি কবিতাটি পুনরায় লিখবেন। এমনভাবে লিখবেন যেন কোনো অন্ধকার না থাকে। বুঝলেন?’ শেষের কথাগুলো বললেন ধমকের সুরে।

কায়েস সাহেব খুব কষ্টে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’

একটা জিজ্ঞেস করতে পারবেন। দুইটা না। বলেন কী জানতে চান?’

আপনি কে?’

রুক্ষ রমণীকণ্ঠ বললেন, ‘আমি কেউ না। আই অ্যাম নো বডি।

দুই.

কায়েস কায়সার গল্প লিখছেন এখন। কয়েক মাস আগে শুরু করেছিলেন। আধাআধি লিখে ফেলে রেখেছিলেন। কবিতা লেখার জন্য হুমকি পেয়ে যে কষ্ট পেয়েছিলেন তা ভুলে থাকার জন্য গল্পে মনোনিবেশ করলেন।

কিন্তু এখানেও অন্ধকারের প্রসঙ্গ চলে আসছে।

গল্পে এক ভদ্রলোক নদীর পাড় থেকে ফিরছিলেন। সকালবেলা। দিনের আলো ঝলমল করছে। নদীর ঢেউ কুলকুল ধ্বনি তুলে পানিতে মিশে যাচ্ছে। আবার ঢেউ শুরু হচ্ছে। পাড় থেকে নামতে গিয়ে একটা খোঁড়লের ভেতরে তার পা আটকে গেল। অনেক চেষ্টা করছেন পা টেনে বের করতে। কিন্তু পারছেন না। লক্ষ করলেন তার পুরো পা নয়, শুধু গোড়ালি আটকে আছে। তিনি কিছুতেই পায়ের গোড়ালি খোঁড়ল থেকে মুক্ত করতে পারছেন না। ফলে হাঁটতেও পারছেন না। যেতেও পারছেন না।

গল্প লেখা ছিল এটুকু। আজ যখন এখান থেকে শুরু করে গল্পটা টেনে নিতে লাগলেন তখন দেখলেন এখানেও অন্ধকারের প্রসঙ্গটি চলে এসেছে। লোকটি দিনের আলোর মধ্যে থেকেও দেখতে পেলেন উদিত সূর্য হঠাৎ ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকার হচ্ছে। আন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। কিন্তু তিনি খোঁড়ল থেকে পায়ের গোড়ালি মুক্ত করতে পারছেন না।

তিন.

গল্প লেখার পর একটি দৈনিকের সাহিত্যপাতায় পাঠালেন। যথারীতি পরের সপ্তায় প্রকাশ পেল এবং সচেতনভাবে মিষ্টি-রুক্ষ কণ্ঠের রমণীর আদেশ অনুযায়ী আগে প্রকাশিত কবিতাটি পুনর্লিখন করলেন না। উল্টো তার গল্পে অন্ধকারের প্রসঙ্গ চলে আসায় তিনি তা গল্পে সন্নিবেশিত করলেন।

চার.

অন্ধকারের প্রসঙ্গ এভাবে ক্রমাগত চলে আসায় তিনি অনেক দিন পর চাক্ষুষ অন্ধকার দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। কবি-সাহিত্যিকের মন তো! একদিন রাতে অন্ধকার দেখার জন্য বাইরে এলেন।

এবং সত্যি অভিভূত হয়ে গেলেন। অন্ধকারেরও এমন রূপ হয়! কী নিকষ! নিজেকেও চেনা যায় না। কোনো কিছু দেখা যায় না। যা দেখা যায় তা অন্য রূপে, অন্য রঙে। এমন এক জিনিস তা সবকিছুর আকার আকৃতি অভিব্যক্তি পরিবর্তন করে দেয়।

এমন সময় তার চোখে তীব্র আলো এসে পড়ে। তিনি হকচকিত হয়ে যান। ওই আলো ক্রমেই বাড়তে থাকে। কায়েস কায়সার দেখলেন বেশ কয়েক জোড়া হাত। সেসব হাতে আলো নিক্ষেপণের যন্ত্র। সেখান থেকে তার চোখে তাক করে আলো নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এসব হাত ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আলোর তীব্রতাও বেড়ে চলেছে। তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। চিৎকার দিতে গিয়ে দেখেন চিৎকার দিতে পারছেন না।

আলো বাড়তে থাকে। কায়েস কায়সারের অন্ধকারও বাড়তে থাকে। একসময় তিনি কিছু বলতে পারেন না।

পাঁচ

কায়েস কায়সারের মৃত্যু সারা দেশ নাড়িয়ে দেয়। এমন মানুষ এভাবে মারা যাবে কেউ ভাবতেই পারেন না। কায়েস কায়সারের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়। তদন্তের রিপোর্টে পাওয়া যায় তিনি তীব্র আলোর আঘাতে হার্ট ফেল করে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করার মতো কিছু নেই।  

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা