× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সমাজ ও রাজনৈতিক দলিল

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ০০:১৯ এএম

সমাজ ও রাজনৈতিক দলিল

সাধারণভাবে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ‘বরপুত্র বলা হয়। সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানকে বিশেষ অনুগ্রহ করেন। কিন্তু সময় বদলেছে। শুধু ঈশ্বরের অনুগ্রহে বুঝি এখন আর কাজ হয় না। তাই ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে চায় মানুষ। ক্ষমতার বরপুত্র হতে চায়। কিন্তু চাইলেই তো হয় না। বরপুত্র হওয়ার জন্য দরকার দালালি-দুর্নীতি-চাটুকারিতা করবার পরম ধৈর্য ও অশেষ সামর্থ্য। সবার সেই সামর্থ্য থাকে না। তাই শেষ পর্যন্ত দুয়েকজনই হয়ে উঠতে পারে ক্ষমতার বরপুত্র। মঞ্জু সরকার (জন্ম-১৯৫৩)-এর ‘বরপুত্র (২০১০) উপন্যাসটি বিন্যস্ত হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার আনুকূল্যে অঢেল বিত্তের মালিক হয়ে ওঠা এক সৌভাগ্যের বরপুত্রকে নিয়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মের পরের কয়েক দশকে এরকম বরপুত্রদের দেখা গিয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা পুঁজি করে এবং রাষ্ট্রক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে কিছু মানুষ ফুলেফেঁপে উঠেছিল। এ আখ্যানের কেন্দ্রে রয়েছে এরকমই একজন মানুষÑ আলহাজ শরাফত উল্লাহ মোহন। রাজাকার বাপের সন্তান মোহন একসময় রাস্তার মাস্তান-হাইজ্যাকার ছিল। ঢাকা নগরীর সন্ত্রাসী নেতা শরীফ বাচ্চুর ক্যাডার ছিল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে শরীফ বাচ্চু শহীদ প্রেসিডেন্টের দল ছেড়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের দলে যোগ দেয়। ঘটনাচক্রে মোহন নতুন প্রেসিডেন্টের নয়নের মণি হয়ে ওঠে। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি হয়ে ওঠে। আর ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে অনায়াসে।

আখ্যানে লেখক প্রেসিডেন্টের নাম বলেননি ঠিকই, কিন্তু লেখকের বর্ণনার গুণে চরিত্রটি চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। উপন্যাসের প্রথম পর্ব ‘উত্থানপর্ব-এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শুরু হয়েছে এভাবে : ‘কোনো রক্তপাত ছাড়াই সেনাবাহিনী শাসনক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক আইন জারি করেছিল সাময়িকভাবে। অতঃপর প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে সেনাবাহিনী প্রধান ভোটের প্রহসন করে বিশ্বকে জানিয়ে দেন, জনগণের রায় আমার পক্ষে। রায়ের জোরে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে ক্ষান্ত হননি, দেশে আবারও পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেও দলবল গড়তে শুরু করেছিলেন। লেখক গ্রন্থের ভূমিকায় ‘ঘটনা ও চরিত্রগুলি কাল্পনিক দাবি করলেও এ বর্ণনায় পাঠক সহজেই বুঝে নিতে পারেন বাস্তবের প্রেসিডেন্টটিকে। সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক সময়টিকেও নির্দিষ্ট করে চিনে নেওয়া যায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার মোহনের বাবাকে মহল্লা ছাড়া করেছিল। কিশোর মোহন সেদিন বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীকে ঠেকাতে পারেনি। পারিবারিক বিপর্যয়ের এ ঘটনাটি মোহনের পরবর্তী জীবন প্রভাবিত করেছে। স্বাধীনতার পরপরই ঢাকার রাস্তাঘাটে খুন-হাইজ্যাক-ছিনতাই ছিল প্রায় নিত্যদিনের। মোহন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভয় দেখিয়ে অন্যের পকেটের টাকা, ঘড়ি, সোনা লুট শুরু করেছিল। ছিনতাইকারী হিসেবে নিজের জীবন শুরু করেছিল। চমৎকার দক্ষতায় মঞ্জু সরকার মোহন চরিত্রটির বিকাশের প্রতিটি স্তর বাস্তবোচিতভাবে তুলে ধরেছেন। আপাত খলনায়ক মানুষটিও এক দিনে এরকম হয়নি। ধীরে ধীরে তাকে হয়ে উঠতে হয়েছে। দুয়েকটি রেখার আঁচড়ে লেখক মোহনের শৈশব-কৈশোরের ঘটনা চিত্রিত করেছেন, যা তার পরবর্তী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অনিবার্যভাবে লগ্ন হয়ে রয়েছে।

রাজাকারের ছেলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বিয়ে। দুজনের মধ্যে মেরুবিন্দুর ব্যবধান। এ বিসদৃশ দাম্পত্য আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু। সাথীকে দিনের পর দিন ধর্ষিতা হতে হয়েছে স্বামীর কাছে। এ এক অবর্ণনীয় রোমহর্ষক অনুভূতি। সাথীর স্বামী-সাহচর্যের প্রতিটি দিন কেটেছে প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে রেখে। সাথী যে স্বৈরাচার প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সরকারি দলের বড় পান্ডা আলহাজ শরাফত উল্লাহ মোহনের বিবাহিত স্ত্রীÑ এ সামাজিক সত্যটা মোহনের বাড়িতে থেকেও ভুলে যেতে চেয়েছে। কিন্তু ভুলতে দেয়নি চারপাশের পরিবেশ। মোহনের প্রভাব-প্রতিপত্তির ছায়া থেকে মুক্ত হতে পারেনি সে। নানান পরিকল্পনা করেছে স্বামীকে শাস্তি দেওয়ার। মোহনের কালো টাকা এ কাজে লাগাতে চেয়েছে। মোহনকে হত্যা করবার কথাও ভেবেছে। বাগানবাড়িতে যাওয়ার সময় সাথী ভেবেছিল, গাজীপুরের সুবিশাল বাগানবাড়ির নির্জনতায় মোহন ভালোবাসার নামে ধর্ষণ করার সুযোগ যেমন পাবে, তেমন সাথীও প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পাবে। চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সে তা পারেনি। সাথী একসময় চেয়েছিল রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতার পাঁক থেকে মোহনকে উদ্ধার করতে। তাও পারেনি। দাম্পত্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের আগুনটুকুই জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছে শুধু।

স্বৈরাচার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে চারদিকে যে হরতাল-আন্দোলন হয়েছিল তার শরিক ছিল সাথীও। সাথী চাইত প্রেসিডেন্টের পতন এবং সেই সঙ্গে মোহনেরও পতন হোক। কিন্তু মোহনদের পতন হয় না। সাথীকে সে বলেছে বিরোধী জোটের ‘এ ও ‘বি দলের নেত্রী যদি ক্ষমতায় আসেন তখনও তাদের সঙ্গে মোহনের একই রকম ঘনিষ্ঠতা থাকবে। সে যেন ‘সৌভাগ্যের বরপুত্র হয়ে জন্মেছে। চিরকাল তার এ সৌভাগ্যকে রক্ষা করতে যতটা নিচে নামা সম্ভব নামবে। মোহনের মতো মানুষ ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনায়াসে নিজেকেও বদলে ফেলতে পারে।

প্রাকস্বাধীনতা পর্বে রাষ্ট্রশক্তি পূর্ব পাকিস্তানে সামাজিক ক্ষেত্রে যে দুর্বিষহ শোষণ-নিপীড়ন চালিয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও সেরকমটা ঘটেছে একাধিবার। আলোচ্য আখ্যানে তার পরিচয় রয়েছে। এই প্রেসিডেন্ট কিছু স্বার্থপর মানুষের লক্ষ্যপূরণের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এরকমটা চললে দেশ যে অন্তঃসারশূন্যতার দিকে চলে যাবে তার আভাস আখ্যানের পরতে পরতে অনুভূত হয়েছে। এ অবস্থায় প্রতি-আক্রমণ, বিদ্রোহ, অসন্তোষ দানা বাঁধবে স্বাভাবিকভাবেই।

সমাজ ও রাজনীতি সচেতন শিল্পী মঞ্জু সরকার। পারিপার্শ্বের সমাজ-রাজনৈতিক মানসের নিখুঁত চিত্রায়ণ তাঁর সাহিত্য। রাজনীতির কেন্দ্র, রাজধানী ঢাকা শহরের প্রতিটি স্তরের সমাজবিন্যাসকে শিল্পিতরূপে চিত্রিত করেছেন বরপুত্রে। তিনি ভাষ্যকারের মতো নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠাতার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন আখ্যানের। বাংলাদেশের রাজনীতির একটা সংকটময় সময় পর্ব এখানে তথ্যসমৃদ্ধভাবে তুলে ধরেছেন মঞ্জু সরকার। এ আখ্যানের সবচেয়ে বড় জোরের জায়গা এটাই। লেখকের অভিজ্ঞতার জোর উপন্যাসটিকে অন্য মাত্রা দান করেছে। বরপুত্রের সাহিত্যমূল্যের পাশাপাশি একটা তথ্যমূল্যও (documentary value) রয়েছে। সমসময়, রাজনৈতিক ইতিহাস আখ্যানের জমি তৈরি করেছে। শেষ পর্যন্ত বরপুত্র সাহিত্য হয়েও বাংলাদেশের সমাজ-রাজনৈতিক দলিল হয়ে উঠেছে। এখানে মোহন শুধু একটি মাত্র চরিত্র নয়, সে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দুর্বৃত্তদের প্রতিনিধি। এরকম মোহন বাংলাদেশে একজন নয়, অনেক ছিল। আজও রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত বলেই বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে। আসলে এ মোহনরা সব দেশেই আছে। সব দেশেই থাকে। সেদিক থেকে মঞ্জু সরকারের বরপুত্রকে সর্বকালীন সাম্প্রতিকের আখ্যান বলা যায়।   

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা