× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আমার অজেয় জনগণ

লায়লা খালেদ

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৪৫ পিএম

আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:০৭ পিএম

আমার অজেয় জনগণ

কলঙ্কের তকমা- বঞ্চনা আর উপলব্ধি

সিঁড়ি

আমার জন্ম হাইফা শহরে, যদিও নিজের জন্মভিটা সম্পর্কে তেমন কিছু স্মরণে নেই। ছোটবেলায় যে জায়গায় খেলাধুলা করতাম, জায়গাটা রয়ে গেছে এখনও। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, বাড়িটারও কিছু মনে নেই। শুধু তার সিঁড়িটার কথা আমি ভুলিনি কখনও। আমার বয়স যখন চার বছর, তখনোই আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। তারপর অনেক বছর আসা হয়নি এদিকে। একুশ বছর পর, ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্টে হাইফার সঙ্গে আবারও দেখা হয় আমার। সেবার কমরেড সালিম ইসাবি আর আমি একটা সাম্রাজ্যবাদী বিমানের দখল নিয়ে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের মাটিতে এসে নামি। দখলকৃত মাতৃভূমির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানাতে। আর একই সঙ্গে শত্রুকে এটাও জানিয়ে দিতে যেÑ প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা কখনোই ছেড়ে যাইনি। অদৃষ্টের পরিহাস! জাঁতাকলে পড়ে যাওয়া দুশমন ইসরায়েলই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিল নিজের তেল পুড়িয়ে আমেরিকান আর ফরাসি বিমানগুলো আকাশে উড়িয়ে আমাদের বিমানটিকে সসম্মানে এখানে নামিয়ে দিতে।

বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে হাইফা সম্পর্কে এতকাল ধরে যা শুনেছি, আর বইপত্র পড়ে যা জেনেছি, সেগুলোর ভিত্তিতে শহরটার একটা কল্পিত ছবি অনেক আগে থেকেই আঁকা হয়ে ছিল আমার মনে। বিমানের জানালা দিয়ে আমি নিচের দিকে তাকালামÑ হাইফা শহর। আমাদের ছেড়ে যাওয়া বাড়িটার একটা কল্পিত ছবিও আঁকলাম মনে মনে। সমুদ্র তরঙ্গের আদরে লালিত, পর্বতমালার আলিঙ্গন বেষ্টিত, উন্মুক্ত প্রান্তরের গৌরব নিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে আছে হাইফা। নাবিকের নিরাপদ নোঙর, রৌদ্র বিধৌত এক সৈকত। যদিও জন্মসূত্রে হাইফার একজন নাগরিক হওয়ার পরও এই ঝলমলে রোদ্দুরে নিজের গা ডুবিয়ে দেওয়ার, এই বিশুদ্ধ হাওয়া বুক ভরে টেনে নেওয়ার কিংবা সেখানে গিয়ে আমার স্বজনদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার অধিকারটুকু আজ নেই আমার। বন্দুকের জোরে ফিলিস্তিনের দখল নিয়ে সেখানে ঘরবাড়ি করে সংসার পেতেছে ইউরোপ প্রত্যাগত ইহুদি আর তাদের অনুসারীরা। আমাদেরই মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে আমাদের। তারা যেখানে থাকছে, সেখানে থাকার কথা আমাদের। অথচ নির্বাসনের দণ্ড মাথায় বয়ে আমরাই আজ ঘুরে বেড়াচ্ছি এর-তার দুয়ারে। আমার শহর দখল করেছে তারা, কারণ তার গায়ের জোর বেশি। আমরা, ফিলিস্তিনি আরবরা হলাম দুর্বল, তাই আমাদের থাকতে হচ্ছে নগরের সীমানার বাইরে। কিন্তু এই আমরাই, এই রুদ্র মরুর সরাইখানার স্নাতকরা, আবারও শক্তি সঞ্চয় করব এবং আমরা ফিলিস্তিনের পুনর্দখল নেব। আরব, ইহুদি আর পৃথিবীর মুক্তিপ্রেমী প্রতিটি মানুষের জন্য তাকে একটি মানবিক স্বর্গ হিসেবে গড়ে তুলব।

আমি হাইফা ভালোবাসি, যেমন ভালোবাসে আমার বাবা আর সকল ফিলিস্তিনি নাগরিক। শুরুতে হাইফার প্রতি আমার এই প্রেম ছিল প্রধানত আবেগতাড়িত। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখা কোনো রাজ্যে যাওয়ার জন্য একটা শিশুর আকুতির মতো। ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করলাম, বই পড়তে শিখলাম, নিজের মতো চিন্তা করার ক্ষমতা যখন আয়ত্ত হলো, তখন দেখলামÑ একটা ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে আমারও। দেখলামÑ সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে আমার জাতির, দেখলামÑ পৃথিবীর অন্য যেকোনো জাতির মতো সমান ঐতিহ্য আর মর্যাদা রয়েছে আমাদেরও। আর কারও চেয়ে বড় হই বা না হই, ছোট নই অন্তত। সর্বোপরি জানলামÑ বিশ্বের সর্বত্র আমার নিজের শ্রেণিভুক্ত যারা, এই যে শ্রমজীবী জনতা, কর্মহীন, বাস্তুচ্যুত, নিপীড়িত জনগণÑ কুসংস্কার আর পশ্চাৎপদতার শিকল গুঁড়িয়ে দিয়ে এরাই গোটা মানবজাতিকে মুক্তি দিতে পারে। আমাকে ভুলতে হলো গোঁজামিল দেওয়া ইতিহাস, স্কুলের ক্লাসরুমে যেগুলো আমার মাথার মধ্যে ঢোকানোর কসরত করেছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষাপদ্ধতি। যেখানে ওরা বলতÑ আমার পূর্বপুরুষের কোনো ইতিহাস নেই; পৃথিবীতে ফিলিস্তিনি জাতি কিংবা আরব জাতি বলে কোনো জাতিসত্তা ছিল না কোনো কালে। কিন্তু নিজের মুক্তির খোঁজে পথে নেমে আমি আবিষ্কার করলাম আরব ইতিহাসের স্বর্ণযুগের কথা, কিংবদন্তি বীরদের নিয়ে রচিত গাথা এবং উপলব্ধি করলামÑ আমাদের যা কিছু মহান গৌরবের, সুনিপুণ ধূর্ততায় তার সবই তুচ্ছজ্ঞানে পাশ কাটিয়ে গেছে পশ্চিমেরপণ্ডিতকুল; আমাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে শুধুই অন্ধকার।

আমি জানতাম নিজেকেই কিছু একটা করতে হবে, নিজের ভেতর থেকে উপলব্ধি করতে পারছিলাম পৃথিবীতে উৎপীড়ক আর উৎপীড়িত, প্রবঞ্চক আর প্রবঞ্চিতের মধ্যকার ঐতিহাসিক রণাঙ্গনে একজন বিপ্লবী যোদ্ধা হওয়াই আমার ভাগ্যলিপি। অতএব সিদ্ধান্ত নিলাম বিপ্লবী যোদ্ধা হবÑ নিজের মুক্তির মানসে আর স্বজাতির স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে।

১৯৩০ সালের ফিলিস্তিনি বিপ্লব ছিল আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা; ইজ্জ এদিন কাসাম ছিলেন সেই প্রতিরোধযুদ্ধের অধিনায়ক। আরব ভূখণ্ডে তিনিই প্রথম শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করেন এবং কৃষক বিপ্লবের সূচনা ঘটান। অনেক বছর ধরেই তিনি আত্মগোপনে থেকে নিজের গুপ্ত সংগঠন গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু দলের অভ্যন্তরে নিজের লোকদেরই উপর্যুপরি বিশ্বাসঘাতকতার প্রেক্ষাপটে ১৯৩৫ সালেই তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়ে দেন। ভেবেছিলেনÑ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ইহুদিবাদ আরব পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এক সর্বাত্মক জনযুদ্ধের সূচনা ঘটবে এর মধ্য দিয়ে। তার বিপ্লবী সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত ছিল শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র আর প্রগতিশীল দলগুলো। বিদ্রোহটি ছিল মূলত নিপীড়িত জনতার বিদ্রোহ। ইহুদিবাদী আর প্রতিক্রিয়াশীল আরব গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। ফিলিস্তিন কিন্তু বেদখল হয়ে যায় ১৯৩৬-৩৯ পর্বেই, চলে যায় ইহুদিবাদের কবজায়। সেটি ১৯৪৬-৪৮ পর্বের ঘটনা নয়, যে রকমটি আমাদের বিশ্বাস করাতে চান পণ্ডিতকুল। ১৯৩৬ সালের কৃষক অভ্যুত্থান চলাকালে ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের ফলশ্রুতিতে অচল হয়ে যায় গোটা দেশ। ধর্মঘট চলে এপ্রিল থেকে টানা অক্টোবর পর্যন্ত। এর দাবি ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি আরব জাতিসত্তার স্বীকৃতি, ব্রিটিশের বহিষ্কার এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি অভিবাসন বন্ধ করা। একটিমাত্র প্রাপ্তি যা মিলল এই আন্দোলন থেকেÑ ব্রিটিশরা তাদের একটা কালোত্তীর্ণ সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার সামনে তুলে আনল; একটা রাজকীয় কমিশন গঠন করল, যে কমিশন ১৯৩৭ সালে সুপারিশ করল যে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ভাগ করতে হবে। ভাগাভাগির প্রস্তাব সাদরে লুফে নিল ফিলিস্তিনেরডিফেন্স পার্টি অব প্যালেস্টাইন’- এর বাদশা আবদুল্লার অনুগামী প্রকাশ্য রাজনৈতিক ফ্রন্ট ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। এসবের মধ্যেই আরও তীব্র রূপ ধারণ করল বিপ্লবী সংগ্রাম, কিন্তু ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব তারশান্তিবাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতা; আরব সরকার আর তারমধ্যস্থতাকারীদের মুরুব্বিগিরি; সর্বোপরি, ব্রিটিশ-ইহুদি সামরিক যোগসাজশে শেষ পর্যন্ত গুটিয়ে যেতে বাধ্য হলো প্রতিরোধযুদ্ধ। শহীদ হলেন কাসাম, বিক্ষোভে ফেটে পড়ল তার অনুসারীরা। চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে গেল সারা দেশে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হলো দুশমন। সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ, নথিপত্র থেকে সযত্নে মুছে ফেলা হলো কাসামের স্মৃতি। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের শুরুটাও হয়েছিল ঠিক সেখানেই, যেখানে নিজের কাজের সমাপ্তি টেনে গিয়েছিলেন কাসাম। তার প্রজন্মের হাত ধরে শুরু হয়েছিল যে বিপ্লব, তা সম্পন্ন করার দায় এবার চেপেছে আমার প্রজন্মের কাঁধে।

১৯৩৬ সালের বিপ্লবী অভ্যুত্থানের ইতিহাসের বেশিরভাগটাই আমি জেনেছি বইপত্র পড়ে, কিন্তু ১৯৪৮ সালের পর থেকে যে ইতিহাস আমার জানা, সেটা তো জেনেছি আমার নিজেরই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে। আমার চতুর্থ জন্মদিন পালনের চার দিনের মাথায়, ১৯৪৮ সালের ১৩ এপ্রিল, হাইফা ছাড়তে হয় আমাদের। জন্মদিন উপলক্ষে কোনো কেট কাটা হয়নি, যেহেতু এপ্রিল তারিখটি ছিল ফিলিস্তিনের জাতীয় শোক দিবস। আমার বয়স আজ ২৯। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত নিজের একটি জন্মদিনও উদযাপন করিনি এবং তত দিন পর্যন্ত তা করবও না, যত দিন পর্যন্ত না আমি ফিরে যেতে পারছি হাইফার কোলে। নিজের ইচ্ছায় হাইফা ছাড়িনি আমি। আমার পরিবারও আমাকে তা ছাড়তে বলেনি, বরঞ্চ তা বলেছে এমন একদল মানুষ, যাদের নিজেদেরই চিরকাল থাকতে হয়েছে নির্যাতিত আর বিতাড়িত জাতি হিসেবে। অথচ সেই তারাই কিনা আজ অবতীর্ণ হয়েছে নির্যাতক আর বিতাড়কের ভূমিকায়!

আমরা থাকতাম স্ট্যান্টন স্ট্রিটে, হাইফার ফ্যাশন-দুরস্ত ফিফ্থ অ্যাভিনিউর অভিজাত ইহুদি আবাসিক এলাকা, আডারের কাছাকাছি। মহল্লার ইহুদি পড়শিদের সঙ্গে ভালোই হৃদ্যতা ছিল আমাদের। ইহুদি ছেলেমেয়েদের সাথেও জানাশোনা ছিল। একজন ছিল তামারা, আমার প্রাণের বন্ধু, ওরা যদিও ছিল ইহুদি। কারণে অবশ্য ওর আর আমার মধ্যে কোনো তফাত চোখে পড়ত না আমার। তবে আমি নিজে এমন ভাব নিয়ে থাকতাম যেন আমি আরব কিংবা ইহুদির কোনোটাই নই। আমার আর তামারার বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায় রচিত হলো যে দিন, সেটি ছিল ২৯ নভেম্বর, ১৯৪৭ সাল। জাতিসংঘ এদিন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে আমার আর তামারার মধ্যে ভাগাভাগি করে দিল। দেশটা আমার, অথচ তার ৫৬ ভাগই নিয়ে গেল তামারা। (অথচমাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে সমগ্র ফিলিস্তিনের মাত্র আট শতাংশ জায়গা চেয়েছিল তার নিজের লোকেরাই) সবাই আশা করছিল, আমি এটা মেনে নেব এবং তামারাদের অভিনন্দন জানাব। সবাই আশা করছিল আমি আমার নিজের মানবতাকে অস্বীকার করব, ইহুদিবাদী দাবির নৈতিক বৈধতার স্বীকৃতি দেব এবং আমার নিজের ঘরেই থাকব একজন গৃহহীনের মর্যাদায়, আমার নিজের দেশেই বাস করব একজন উদ্বাস্তুর মর্যাদায়। শুধু একজন আরব হওয়ার অপরাধে আমাকে নির্বাসনের দণ্ড দিয়ে দিল আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর তার মিত্ররা। আর তারপরও তারা আমাদের কাছ থেকে আশা করছে যে- আমরা তাদের এসবসিদ্ধান্ত সম্মান করব এবং সে অনুযায়ী চলব। কারণ আমরা যদি সেগুলো স্বীকার করি, তাতেই নাকি ইহুদি দাবিগুলো পূরণ করা হবে, ইহুদি বসতির সম্প্রসারণ থামবে এবং ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে নতুন ইহুদি অভিবাসনের (আলিয়াহ) স্রোত বন্ধ হবে।

ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ভাগ করা জাতিসংঘেরসিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিন দিনের টানা হরতাল পালন হলো। তবে অচিরেই নিতান্ত অকার্যকর প্রমাণ হলো হরতাল। আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অপমৃত্যু ঘটে গিয়েছিল অনেক আগেই, অবশিষ্ট যা ছিল তার প্রেতাত্মা মাত্র। ছত্রভঙ্গ, আবেগী, ক্রুদ্ধ একদল মানুষ। জীর্ণদশাগ্রস্ত প্রাচীন সংগঠনগুলো ভেঙে পড়েছিল। শ্রমিক-কৃষক নতুন কনফেডারশনের তখনও অতটা বিকাশ ঘটেনি যে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের নেতৃত্ব তারা নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারে। অনিবার্য বিনাশ ঘনিয়ে এলো যথারীতি। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে শুরু করল এখানে-ওখানে। আরব হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠল ইহুদিরা, পাল্টা ইহুদিদেরও লাশ ফেলতে আরম্ভ করল আরবরা। তবে ইহুদিরা হামলা চালাত সুসংগঠিত হয়ে, সামরিক কায়দায়। সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বুঝিয়ে দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হলো এসব খুনিকে এবং লড়াইয়ের লক্ষ্য সম্পর্কেও বুনিয়াদি ধারণা ছিল তাদের। পক্ষান্তরে, আরবদের আক্রমণগুলো হতো কাঁচা পরিকল্পনাপ্রসূত, অধিকাংশই একক উদ্যোগে সংঘটিত। গোলাবারুদে সমৃদ্ধ থাকত ইহুদি বাহিনীগুলো। সুসংহত ভ্রাতৃত্ববোধও ছিল পরস্পরের মধ্যে। সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী ছিল তাদের, মন্তস্তাত্বিক যুদ্ধেও উৎকর্ষতা ছিল বেশি। ইহুদি যোদ্ধা সারির সামনের কাতারে দেখা যেত তাদের নেতাদের; অন্যদিকে আমাদের নেতারা নিবাস গেড়েছিল লেবাননের পর্বতকন্দরে কিংবা কায়রোর বিলাসবহুল বাংলোয়। ফলে আমাদের পায়ের তলা থেকে অনায়াসে হাইফাকে ছিনিয়ে নিতে পারল ইহুদিরা। যদিও আরব লিজিয়ন অব জর্ডানের সর্বাধিনায়ক স্যার জন গ্লুব পাশা ব্রিটিশ কুচক্রীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের রেজিমেন্টকে হাইফা ছেড়ে সরে যাওয়ার আদেশ প্রদানের পরই একমাত্র পূর্ণ বিজয় নিশ্চিত হলো তাদের। 


ফিলিস্তিনি এই যোদ্ধা তাঁর মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে দেশ ত্যাগ করেন এবং নিজেকে নিয়োজিত করেন স্বাধীনতার সংগ্রামে। তাঁর যুদ্ধ-কাহিনী, মাতৃভূমিকে নিয়ে ভাবনা মর্মস্পর্শী, আবগেমথিত। তাঁর সে কাহিনী পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়, সে পুস্তকের কিছু অংশ অনুবাদ আকারে কয়েক পর্বে ধানসিড়ির পাঠকের উদ্দেশে নিবেদিত হলো-

পূর্বকথা

লায়লা খালেদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭০ সালে। একঝলক। তাকে শুধু ‘কী করছেন এখন?’ - এটুকুই প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। ‘আমি একজন ফিলিস্তিনি আরব মুক্তিযোদ্ধা,’ সগর্বে উত্তর ছিল লায়লার। উত্তর আমেরিকা মহাদেশে আমার নিজের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও পড়াশোনা ছিল তার। আমি কী করছি, তা জানতে চাইলেন। ‘শিকলের গায়ে আমি মুক্তির ডানা এঁকে দিচ্ছি।’ পরবর্তী সাক্ষাতের দিনকয়েক পরই, ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি, তাকে বললাম, ‘দুজন একসঙ্গে বসে আপনার আত্মজীবনী রচনার কথা ছিল। তার কিছু ভাবলেন?’ ‘আলবৎ, চিন্তাটা মাথায় আছে আমার,’ আশ্বস্ত করলেন আমাকে। একই বছর ২৩ জুলাই থেকে একটানা পাঁচ দিন লায়লার সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ হলো এবং ত্রিশ ঘণ্টার বেশি সময়জুড়ে কথাবার্তা হলো আমাদের মধ্যে। তার নিজের লেখা নোটপত্র, দিনলিপি, খুঁটিনাটি জোগাড় করলাম। দেশে-বিদেশে পত্র-পত্রিকায় তার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত অজস্র প্রতিবেদন-ফিচার পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। এসব লেখালেখি এবং লায়লার সঙ্গে সেবার আমার যে কথোপকথন হয়, তার ভিত্তিতে পরের বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর দুই মাস কলম চালিয়ে আমি এই গ্রন্থ রচনা করি। 


অক্টোবর ৩০, ১৯৭১, জর্জ হাজ্জার, ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু, ওয়াটারলু, অন্টারিও।


অনুবাদ : মিলটন মোললা


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা