হামিদ কায়সার
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:২১ পিএম
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও রিজিয়া রহমান
ভাষাতত্ত্ববিদ হিসেবে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সুখ্যাতি বা সুনাম কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছেছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে উপাধি দিয়েছিলেন ভাষাচার্য। নিজের সফরসঙ্গীও করে নিয়েছিলেন বেশ কটি বিদেশ ভ্রমণে। বিলাতে উচ্চতর শিক্ষাপ্রাপ্ত এই ভাষাতাত্ত্বিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিকের পাণ্ডিত্য বাংলা ভাষার সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনকেও করেছিল আলোকিত। তাঁর সঙ্গে অপূর্ব এক সংযোগ গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের অন্যতম বরেণ্য কথাশিল্পী রিজিয়া রহমানের।
১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছেন এশিয়াটিক সোসাইটির আমন্ত্রণে। সাহিত্যে ভাষার ব্যবহার-সংক্রান্ত এক সেমিনারে বক্তব্য দিতে। সেই সেমিনারে অন্য অনেক কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন রিজিয়া রহমানও। অপেক্ষাকৃত তরুণ এই লেখিকা তখনই বাংলাদেশের সাহিত্য সমালোচক এবং সাহিত্যবিদগ্ধদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে প্রত্যাশামতোই অতি নিভৃতে একের পর এক উপন্যাস রচনা করেছেন। যেসব সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে বাঙালির জাতিসত্তার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, সমকালীন জীবনযাপনের অন্তর্গূঢ় ধারা। তিনি সেই প্রাচীন বাংলা থেকে শুরু করে ইংরেজ-পাকিস্তানি শাসনামলের ওপর ভিত্তি করে উপন্যাসে অন্বেষণ করেছেন বাঙালির উঠে আসা, হয়ে ওঠা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনজীবনের ক্রমবিকাশের ধারা সাজিয়েছেন অক্ষরের শিলায় শিলায়।
তো সেদিন সেই সেমিনারে রিজিয়া রহমান সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের অনেক মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। জড়িয়েছিলেন খানিকটা তর্কেও। সে প্রসঙ্গে আমার গৃহীত সাক্ষাৎকারে আলোকপাতও করেছেন খানিকটা।
‘এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর সম্মানে আয়োজিত সভায় তিনি শুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নিয়ে কথা বলেছিলেন। সম্ভবত বলেছিলেন লেখকরা অনেক সময় শুদ্ধ ও আঞ্চলিক গদ্যের ব্যবহারের যথাযোগ্য সীমানাটি রক্ষা করতে পারেন না। কিছু কিছু দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছিলেন। তাঁর ধারণাটি ঠিক মেনে নিতে পারিনি (সম্ভবত নিজের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অর্বাচীনতার কারণে)। সভা শেষে তাঁকে আমার একমাত্র উপন্যাসটি উপহার দিয়ে বললাম, এতে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ডায়ালেক্ট ব্যবহার করেছি, সংলাপের বাস্তবতার জন্যই। কিন্তু লেখকের নিজস্ব গদ্যটিকে আঞ্চলিকতামুক্ত রাখতে চেষ্টা করেছি। বইটি তিনি আগ্রহসহকারেই নিলেন।’
হামিদ কায়সার : তারপর?
রিজিয়া রহমান : সাত দিন পরই পেলাম তাঁর দীর্ঘ চিঠি। পড়ে তো আমি অভিভূত। তিনি শুধু উচ্ছ্বসিত প্রশংসাই করেননি, এর সত্যনিষ্ঠ আবেগঘন একটি বিশ্লেষণও দিয়েছেন। নিজের লেখার এমন অকল্পনীয় মূল্যায়ন, এ যেন কেবল স্বপ্নেই সম্ভব! তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। তবে নানাভাবেই খবর পেতাম তিনি কলকাতায় সবার কাছে আমার লেখার প্রশংসা করছেন, আমার লেখা আরও পড়তে চান। কিন্তু আমি আর বই পাঠাতে পারিনি।
হামিদ কায়সার : বই পাঠানোয় সমস্যা কী ছিল?
রিজিয়া রহমান : বাংলাদেশে প্রকাশনার ক্ষেত্রটি তখনও খুব একটা মজবুত নয়। প্রচণ্ড পরিশ্রমে লেখা ‘বং থেকে বাংলা’র প্রকাশক খুঁজতে বেগ পেতে হয়েছে। কারণ একটিই, এত মোটা বই পাঠক কেনে না। সুতরাং কী করে পাঠাব ড. চ্যাটার্জিকে আমার বই?
এই যে সাত দিন পরে পাওয়া সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি, যা পেয়ে রিজিয়া রহমান বিপুলানন্দে ভেসেছিলেন, শেষাবধি কিন্তু তা আর রিজিয়া রহমানের হাতে থাকেনি। কার হাতে গেল? সত্যিই ভাবতে আশ্চর্য লাগছে যে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সেই চিঠিটা এখন আমার কাছে। কীভাবে এলো? তাহলে যে রিজিয়া রহমানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ এবং সম্পর্কের ভেতর-বাইরটা বিস্তৃত করে বলা দরকার।
রিজিয়া রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়টা ঠিক লেখক হিসেবে হয়নি। আমি যখন তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা করি তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। থাকি সলিমুল্লাহ হলে। তখনও কোনো গল্প লিখিনি, কখনও যে লিখব তারও কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তবে পাঠক ছিলাম; সিরিয়াস পাঠক। আর লিখতাম কবিতা। আমার এ বইপ্রীতি আর কবিতা লেখার কথাটা জানতেন ইয়াসমিন মামি। ইয়াসমিন মামিদের বাসা মহাখালী ডিওএইচএসের ২৭ নম্বরের শেষ মাথায়। আমি প্রায়ই যেতাম সে বাড়িতে। ত্রিতল সেই বাড়িটার মনোরম খোলামেলা ছাদে বসে আড্ডা দিতাম।
একদিন এক পোড় খাওয়া বিকালে ছাদে বসে আড্ডা দেওয়ার সময়ই ইয়াসমিন মামি হঠাৎ গলার স্বরটা নামিয়ে পথের ওপাশের ত্রিতলার বারান্দার একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বলে উঠলেন, অপু দেখ দেখ। উনি একজন লেখক, অনেক বড় লেখকÑ রিজিয়া রহমান। নাম শুনেছ?
নাম শুনেছি মানে! আমি তো বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম! এভাবে রিজিয়া রহমানকে দেখার সুযোগ মিলে যাবে এত সহজে! আমার কাছে সত্যি অভাবনীয় ছিল! তখনও বোধহয় সত্যযুগ খানিকটা টিকে রয়েছে! কবি-লেখক-শিল্পীরা যেমন শুদ্ধতার সরোবরে নিয়তই স্নান করেন, সাধারণজনও তাদের সমীহের চোখে দেখতেই অভ্যস্ত! আমিও নিমীলিত ধ্যানে রিজিয়া রহমানকে অবাক চোখে দেখতে থাকি, বয়সের ভার দেহে নেমেছে ঠিকই, কিন্তু চলাফেরায় ঋজুতা এখনও আছে। তিনি প্রায় তিন-চার বার ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন, কী যেন রাখলেন নিচু হয়ে, তারপর শেষবার বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালেন কিছুক্ষণ। নিচে বাইরের দিকে খামোখাই শূন্যদৃষ্টি। নাকি তাঁর তৃতীয় সত্তা টের পাচ্ছিল যে এক কৌতূহলী যুবক তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখছে! তারপর ভেতর-ঘরে মিলিয়ে গেলেন তো গেলেনই, আর ফিরলেন না।
সত্যি কথা বলব? তখনই আমার খুব যেতে ইচ্ছা করছিল তাঁর কাছে। না, অটোগ্রাফের জন্য নয়। অটোগ্রাফের কাঙাল আমি কখনোই ছিলাম না। শুধু জানাতে যে তিনি আমার শৈশব থেকেই চেনা; চিরচেনা, খুব খুব চেনা, অতি গভীরভাবে চেনা! আমি তাঁকে আমার শৈশবের একটা অমূল্য পুরো বিকাল সমর্পণ করে দিয়েছিলাম, একটা কোনো দিন না-ফেরা রাত উৎসর্গ করে দিয়েছি, তারও পরের দিনটা বা রাতটাও ছিল তাঁরই সকাশে সম্পূর্ণ নিবেদিত; হাঁ, সে-এক ঘোর আচ্ছন্নতা। সে আমার অলিখিত উপাখ্যান উপন্যাস পাঠের দুর্লভ অভিজ্ঞতা।
সেদিন যেতে পারিনি ঠিকই, পরে একদিন ইয়াসমিন মামিদের বাসা থেকে বেরিয়ে রিজিয়া রহমানের বাসায় ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিলাম। কদমবুচি করে জানিয়েছিলাম আমার অলিখিত উপাখ্যানপাঠের মুগ্ধতার কথা।
তারপর কবে কবে যে নিজেই লেখালেখির জগতে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। জড়িয়ে পড়লাম নানাবিধ সাহিত্যকর্মে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত দায়িত্ব দিলেন প্রিয় লেখক, প্রিয় বই নিয়ে বাংলাদেশের খ্যাতনামা লেখকদের একটি সিরিজ ইন্টারভিউ নেওয়ার। চারজন লেখকের পরই দেখি রিজিয়া রহমানের নাম। একটি রোমাঞ্চকর উত্তেজনা টের পেলাম নিজের ভেতর।
মনে আছে নির্ধারিত তারিখের একটু আগেভাগেই চলে গিয়েছিলাম রিজিয়া আপার ডিওএইচএসের বাসায়। আপা বেশ পরম আদরেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন আমাকে। আমার দিকে তাকিয়ে সোৎসাহে জানতে চেয়েছিলেন, তোমাকে আগে কোথায় দেখেছি বলো তো? আমি জানিয়েছিলাম, আপা। আপনার এ বাসাতেই। আমি আরেকবার এসেছিলাম। আপার তখন মনে পড়েছিল আমাকে। আর আমাকেসহ যে আরও অনেক তরুণ লেখককে তিনি চেনেন, তা জেনে হয়েছিলাম রোমাঞ্চিত। সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষে চলে আসার সময় রিজিয়া আপা আমাকে পরম স্বজনের মতোই বলেছিলেন, তোমার মামার বাসায় এলে আমার সঙ্গেও দেখা করে যাবে হামিদ। সংকোচ করবে না।
এক-দুবার বোধহয় মহাখালীর সে বাসায় যাওয়া হয়েছে, তারপর রিজিয়া আপা যে সে বাসা ছেড়ে কোথায় চলে গেলেন, হদিসই পেলাম না। যখন আবার কয়েক বছর পর সাহিত্য মাসিক ‘কালি ও কলম’ প্রকাশ পেল, সম্পাদক আবুল হাসনাতের কাছ থেকেই মিলল ঠিকানা। কালি ও কলমের জন্য আপার সাক্ষাৎকার নিতে হবে।
আপার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য যথারীতি ছুটে গিয়েছিলাম উত্তরা। এন্তার অভিযোগ, হামিদ উত্তরা চলে আসার পর কেউ আর দেখা করতে আসে না। অনেক দূরে চলে এসেছি সবার কাছ থেকে। আপাকে কথা দিয়েছিলাম, মাঝেমধ্যেই যাব তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে এবং কথা রেখেওছিলাম।
ওই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার সময়ই আপা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের চিঠিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এ চিঠিটাও সাক্ষাৎকারের সঙ্গে ছাপাতে পারো।
কিন্তু হাসনাত ভাই সাক্ষাৎকারের সঙ্গে ছাপালেন না চিঠিটা। আসলে তিনি অন্য সাক্ষাৎকারগুলো যে বিন্যাসে ছাপাচ্ছিলেন, সে ধারাই বজায় রাখতে চেয়েছেন। হাসনাত ভাই চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা আপনার কাছেই রেখে দিন। রিজিয়া রহমানকে ফেরত দেবেন না। কোনো একটা সংখ্যায় ছেপে দেব। আমার কাছে রাখলে হারিয়ে যেতে পারে।
রিজিয়া রহমানের বাসায় আড্ডা দিতে গিয়ে জানিয়েছিলাম আবুল হাসনাতের অভিপ্রায়। আর এও জানিয়েছিলাম যে চিঠিটা আমার কাছেই রয়েছে। আপা তখন নিশ্চিন্ত ভঙ্গিমায় বলেছিলেন, তোমার কাছেই রাখ হামিদ। তোমার কাছেই ভালো থাকবে।
হ্যাঁ, আমি যত্ন করেই চিঠিটা রেখে দিয়েছিলাম। এত যত্নে যে রিজিয়া রহমান যখন চলে গেলেন এ ভুবন ছেড়ে, কিছুতেই খুঁজে পেলাম না সাধারণ কোনো জায়গায়। অনেক পরে ঠান্ডা মাথায় যখন খুঁজলাম, আবিষ্কার করেছি, যক্ষের ধন যেভাবে আগলে রাখে, সেভাবেই রেখেছিলাম চিঠিটাকে, সহসা পাব কেমন করে এমন অমূল্য সম্পদ!
শ্রীমতী
রিজিয়া রহমান
সমীপে
প/ড়
ওসমানিয়া লাইব্রেরি
৪৮
নর্থব্রুক হল
রোড
বাংলাবাজার,
ঢাকা-১,
বাংলাদেশ।।
৮
জানুয়ারী ১৯৭৫।।
পরম
কল্যাণীয়াসু,
বোধহয়
যেদিন ঢাকা
ছাড়িয়া আসি,
২২ শে
ডিসেম্বর ১৯৭৪,
সেইদিন আপনার
সঙ্গে মিনিট
৩/৪-এর
সাক্ষাৎ হয়,
আলাপে আপনার
‘ঘর ভাঙা
ঘর’ একখানি
আমাকে পড়িতে
দেন। ঢাকায়
বন্ধুদের নিকট
হইতে বহু
পুস্তক উপহার
পাই, বাংলাদেশ
ভ্রমণের মূল্যবান্
স্মৃতি হিসাবে
এই বইগুলি
সঙ্গে করিয়া
আনি। এগুলি
আমার গ্রন্থাগারে
সম্মানের সহিত স্থান
পাইবে। কিন্তু
এত বই-
কবে আর
পড়িতে পারিব?
বয়স হইল
৮৫, পরপারের
ডাকের জন্য
বসিয়া আছি-
সময় আর
নাই- সাহিত্যের
সাগরও অপার,
এই বয়সের
মানুষের পক্ষে
(বিশেষত: যাহার
ঘাড়ে নানা
কাজ অকাজের
বোঝা আসিয়া
বসিবার বিরাম
নাই) ইচ্ছা
থাকিলেও সবকিছু
পড়িয়া উঠা
কঠিন। কিন্তু
আপনার এই
ছোট উপন্যাসটি
প্রথম কয়েকখানি
পৃষ্ঠা উল্টাইয়া
দেখিবার সঙ্গে
সঙ্গেই আমাকে
যেন পাইয়া
বসিল। এক
নিঃশ্বাসে হইয়া
উঠিল নাÑ
পাঠে নানাবিধ
বাধা, কিন্তু
৩/৪
দিনে শেষ
করিলাম। অপূর্ব
সুন্দর হইয়াছে
আপনার এই
লেখা- আধুনিক
বাঙ্গালা সাহিত্যের
গৌরব বৃদ্ধি
করিয়াছে, এ
কথা মুক্তকণ্ঠে
বলিব। আপনি
অপরূপ অনবদ্য
একখানি জীবন-চিত্র
আঁকিয়াছেনÑ আপনার
সম্বন্ধে বলিতে
পারা যায়-
“কোন্ আলো
লাগ্লো চোখে!”Ñ
মানুষের বিশেষতঃ
ভাগ্যহত অবহেলিত
উপেক্ষিত মানুষের
প্রতি এরকম
অনুকম্পাময় সহৃদয়
দরদ তো
সাধারণ লেখকের
রচনায় দেখা
যায় না।
অজ্ঞেয়বাদী অথচ
শাশ্বত সত্যের
আকর্ষণ হইতে
জীবনে যে
কিছুতেই মুক্ত
হইতে পারিতেছে
না। এমন
মানুষের দৃষ্টিকোণ
হইতে আপনার
এই সত্য
দর্শন ও
সত্যবর্ণনা পাঠ
করিয়া অনপেক্ষিত
ভাবে প্রভূত
আনন্দ পাইলাম-
আধুনিক লেখা
হইবে মনে
হইল। হয়
তো বা
আমরা সমানধর্মা।
আমার বয়স
হইয়াছে- বয়সের
ধর্মে বোধ
হয় মানবজীবনের
সহনীয় বিকাশ,
যাহার উৎস
আমরা খুঁজিয়া
পাইনা অথচ
যাহা আমাদের
আকুল করিয়া
তুলে, যেরূপ
কিছু দেখিলে,
চোখের জল
আমি থামাইতে
পারিনা- এমন
কি লোকসমাজেও,
এবং তাহাতে
লোকে আশ্চর্য্য
হইয়া যায়।
আপনার বই
পড়িবার সময়েও
বহুবার এই
অবস্থায় পড়িয়াছি।
আপনি যে
কয়টি অদ্ভুত
সুন্দর চরিত্র
আমাদের কাছে
ধরিয়া দিয়াছেন,
সেগুলো ভুলিবার
নহেÑ হাসেম
পাগলা, ফুলজান
(ফুলজান এবং
আকবর শেখের
স্বগ্রামে তাহাদের
যৌবন-কালের
দাম্পত্য-জীবনের
চিত্র আপনার
হাতে বাঙ্গালা
সাহিত্যের অন্যতম
সুন্দর `Love Idol'
হইয়া ফুটিয়া
উঠিয়াছেÑ তেমনি
হাবুর মার
প্রথম সন্তানের
প্রতি টানÑ
যশোদা-গোপাল
বা মা-মেরী
ও শিশু-যীশুর
ছবিরও প্রতিসার্ধীÑ
অল্প দুই
একটা রেখাপাতে
সকলের মনোহারী
চিত্র আপনি
আঁকিয়াছেন), বৃদ্ধা
ওমরাতুন, আরও
এক দুর্ভাগা
বৃদ্ধা জোলেখার
নানী, বস্তীবাড়ীর
প্রত্যেকটি মেয়ে
পুরুষ সকলেই
জীবন্ত মানুষ,
ভালো-মন্দে
গড়া সত্যিকার
মানুষ, ছাঁচে-ঢালা
পুতুল কেহই
নহে। সার্থক
আপনার দর্শন,
ততোধিক সার্থক
এবং সুন্দর
এবং শক্তিশালী
আপনার সর্র্জনা
শক্তি।
পৃথক্
ভাবে আপনার
কাছে আমার
ভেট স্বরূপ
কতকগুলি ক্ষুদ্র
পুস্তক পাঠাইলামÑ
আমার কারয়িত্রী
শক্তি বা
creative power নাই,
আমি ভাষাসৌধের
স্রষ্টাÑমি’মারÑনই।
ভাষার ক্ষেত্রে
মাটি-কাটা-মজুর
মাত্র। তবুও
বড় জিনিসে
চোখ ভিজে।
মনকেও বিমনা
করিয়া তুলে।
আমার
প্রিয় ছাত্র,
অনুবাকল্প অধ্যাপক
গোপাল হালদার
এবং তাহার
পত্নী, এই
বই পড়িয়া
উভয়েই অত্যন্ত
আনন্দ লাভ
করিয়াছেন, এবং
আমারও পাঠ
করিয়া ভাল
লাগিয়াছে শুনিয়া
তাঁহারা আরও
খুঁশি হইয়াছেন।
বয়সের
অধিকারে আপনাকে
সস্নেহ হার্দিক
আশীর্বাদ জানাইতেছি,
আপনার লেখনী-ধারণ
বঙ্গভাষাকে বঙ্গসাহিত্যকে
বিশ্বসাহিত্যকে গৌরবান্বিত
করুক, এবং
আপনার এই
মানুষের প্রতি
ভালবাসাÑ আমাদের
দেশে আল্লার
বান্দা সমস্ত
ধর্মের ও
সমাজের মানুষ,
কেবল মানবিকতার
গৌরবে ভ্রাতৃত্বের
বন্ধনে এক
করিয়া দিতে
সাহায্য করুক।
ইতি
শুভানুধ্যায়ী
শ্রী
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়