× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রফিকুন নবীর ছবি : আবহমান ও বহমানকালের সঙ্গে

মইনুদ্দীন খালেদ

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:৪৩ পিএম

রফিকুন নবীর ছবি : আবহমান ও বহমানকালের সঙ্গে

শিল্পী রফিকুন নবী শিল্পচর্চা করছেন গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে। দীর্ঘ জীবনে তার শিল্পচর্চার নানানরকম পালাবদল ঘটেছে। এর মধ্যে আমরা যদি কিছু কিছু বিভাজন টানি, তাহলে শিল্পীর কাজ দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে পারব। একটি হচ্ছে, একজন শিল্পীর মধ্যে নিরন্তর কাল বা আবহমানকালের সংবেদনা কাজ করে। অন্যদিকে একজন শিল্পী তার সময়ের মধ্যে ঘটমান যাবতীয় ঘটনা এবং সেসব ঘটনার সঙ্গে শিল্পীমনের বিক্রিয়ায় যে নতুন বোধ উৎপন্ন হয়, সেগুলো তিনি শিল্পিত রূপ দিতে চান। আমরা সবাই জেনে গেছি, শিল্পী রফিকুন নবী একই সঙ্গে বাংলার মানুষ, প্রকৃতি এসব আঁকেন। এসবের মধ্যে আমরা দেখি চিরন্তন বাংলার আবহমানতা রয়েছে। অন্যদিকে আমরা দেখি, বহমানকাল বোঝানোর জন্য কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’ এঁকেছেন। টোকাইয়ের মধ্য দিয়ে রফিকুন নবী হয়ে উঠছেন তার কালের সচেতন অর্থাৎ সমাজসচেতন, রাজনীতিসচেতন একজন শিল্পী-পর্যবেক্ষক এবং শিল্পিত ভাষায় তিনি তার অবলোকন প্রকাশ করেছেন।

রফিকুন নবী 

অন্যদিকে শাশ্বত বাংলার ছবির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, রফিকুন নবী প্রকৃতি, গাছপালা, পশুপাখি ও মানুষের জীবনপ্রণালি এঁকেছেন। এর ফলে আমরা দেখতে পাই, রফিকুন নবী শুরুতে প্রকৃতির সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রকৃতি ছিল তার ছবির প্রধান বিষয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশ তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে এবং নদীদৃশ্য বিশেষ করে জলরঙ এঁকে তিনি ষাটের দশকে পরিচিতি লাভ করেন। তার সেই নৌকা ও প্রশস্ত নদী, আকাশ, তার মধ্যে তিনি রঙে-রেখায় নানা ধরনের অনুরণন সৃষ্টি করেন, অনুরণন আমাদের দেখাতে চেষ্টা করেন। এই যে রফিকুন নবীর ছবির মধ্যে নদীর ভেতর ভারী নৌযান, অন্যদিকে আকাশে এবং দূর নদীতে ভাসমান নানান রেখা ও বিন্দুর বুনটÑ এর মধ্যে আমরা শাশ্বতকাল অনির্ণেয় বা অনুভব করা যায় না, সে সময়কে অনুধাবন করি। অর্থাৎ পুরোভূমি থেকে পশ্চাদ্ভূমিতে গেলে আমরা একই সঙ্গে এই বর্তমান, চোখের সামনে দৃম্যমান বাস্তবতা এবং দৃশ্যাতীত দেখতে পাই। কিন্তু রফিকুন নবীর মনোভঙ্গির ভেতর একটি বৈশিষ্ট্য আছে, তা হলো তিনি কখনোই দুঃখ তার ছবিতে আঁকেননি। যদিও তার কোনো কোনো ছবিতে প্রতিবাদ আছে, কিন্তু দুঃখ নেই। দুঃখকে তিনি তার মননে বা বোধের জগতে প্রশ্রয় দেননি। বরং তিনি সহসা খুশি হওয়া, আনন্দিত হওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এই ব্যক্তিবিষয়কে আমার কাছে মনে হয়েছে এখানে তিনি ভীষণভাবে স্বতন্ত্র। যত ধরনের প্রতিকূলতাই থাকুক, হঠাৎ আনন্দিত হওয়া এবং প্রতিকূলতার নানা বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করে একটু শ্বাস নেওয়ার মতো ব্যাপার থাকে। রফিকুন নবী যা করেন, তার মধ্যে আমরা দেখতে পাই তিনি হঠাৎ একটি শিশুর উল্লাসকে আঁকেন। প্রকৃতি আঁকার সময়ও আমরা দেখতে পাই, একটি দোয়েল পাখি হঠাৎ নেচে গেল, কিংবা একটা গরু দড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে অথবা বিশেষভাবে তার ছবিতে যেটা আঁকেন, আমরা যাকে বলি রফিকুন নবীর ছাগল, ছাগল তিনি আঁকেন।

রফিকুন নবীর ছাগল ও মহিষ আঁকার পেছনে কতগুলো বিষয় আমাদের মনে উঠে আসে। তিনি কেন বারবার ছাগল নির্বাচন করেন, মহিষ নির্বাচন করেন। রফিকুন নবীর চেতনা থেকে কখনোই মহিষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। একপাল মহিষ রফিকুন নবীর চেতনায় চলে আসে, ধাবমান থেকেই যায়। অন্যদিকে ছাগল, ছাগলের উৎক্ষিপ্ত অবস্থা, আমরা যাকে বলি ছাগলের এক ধরনের স্বভাববৃত্তি, যা পাখির মধ্যেও আছে। ছাগল ও মহিষ, এ দুটি প্রাণী আঁকার মধ্যেই রফিকুন নবীর জন্মবৃত্তান্ত আমাদের জানানো দরকার। রফিকুন নবী হচ্ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোক। চাঁপাই হচ্ছে রুক্ষ প্রকৃতির, তার মধ্যে মহিষ ও ছাগলের সঙ্গে সেখানকার মানবজীবনের সম্পর্ক নিবিড়। সেই শৈশব থেকেই তিনি তা আজ পর্যন্ত বহন করে চলেছেন। মহিষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তিনি দেখাতে চেয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ, যারা কালিধূলিমাখা জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যারা মাটি-ময়লার সঙ্গে সম্পর্কিত, যারা ফসল ফলায়, নৌকা বায়, মাছ ধরেÑ এ বিষয়গুলো তিনি বিজড়িত রেখেছেন। অর্থাৎ কায়িক শ্রমে ক্লিষ্ট মানুষ নয়, কায়িকশ্রমে আনন্দিত মানুষ রফিকু নবী আঁকেন। এর কারণ হলো, তার মনোভঙ্গি কখনোই নেতিবাচক প্রান্তরের দিকে ধাবমান হতে দেখা যায়নি। তিনি নেতিকে প্রশ্রয় দেননি বলেই কর্মক্লান্ত মানুষ প্রচুর এঁকেছেন, যারা বিপুল কর্মযজ্ঞ শেষে বিশ্রাম নিচ্ছে। বিশ্রাম একটি বড় বিষয় রফিকুন নবীর ছবির। শ্রমজীবী মানুষের বিশ্রাম তিনি পৌনঃপুনিকভাবে এঁকেছেন। বিশ্রামের মধ্যে বা একসঙ্গে মানুষ বসে আড্ডা দিয়ে নানা ধরনের রঙ্গরসিকতা করছে। সেই মানুষের মিতালি, সেই রঙ্গরসিকতাময় আবহ রফিকুন নবীর বড় মাপের ক্যানভাসে আমরা দেখতে পাই। ষাট বা সত্তরের দশকে এমনকি আশির দশকে তাকে এ ধরনের ছবি আঁকতে দেখিনি। ৩০ বছর ধরে তিনি এ ছবি আঁকছেন। ক্রমে তিনি জলরঙের তারল্য, তারল্যগুণ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তেলরঙ বা অ্যাক্রিলিকে এসে দাঁড়িয়েছেন। জলরঙ থেকে অ্যাক্রিলিকÑ এ পালাবদলে আমরা দেখতে পাই রফিকুন নবী অ্যানাটমি বা মানুষের দেহ বা প্রাণিকুলের দেহ, তার আয়তনিক ভারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। অর্থাৎ আয়তনিক ভারগুলোকে একটা মোটিভ হিসেবে নিয়েছেন। এর আগেও আমরা দেখেছি রফিকুন নবীর ছবিতে স্টাইলাইজেশন আসছে, নকশামণ্ডিত ব্যাপার আসছে, নানানরকম ডিজাইনের ব্যাপার আসছে। যেগুলো তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। লোকশিল্পের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক, এমনও বলা যাবে না। রফিকুন নবীর এই যে স্টাইলাইজেশন, জলরঙের তারল্যস্বভাবকে প্রয়োগ করা এবং গত ৩০ বছরে অ্যাক্রিলিকের, যার মধ্যে আমরা দেখি বর্ণঘনত্ব পাওয়া যায়, এর টোন-ফর্ম প্রাণীর দেহে এবং মানুষের দেহে রয়েছে, সেগুলো তিনি আঁকছেন। এতে আমরা বুঝতে পারি, মানুষের যাপিত জীবনের মধ্যে একটা সদত্ত বিষয় আছে, তাতে ভীষণভাবে তিনি আস্থা বোধ করছেন। এটা একটা বড় ব্যাপার, একজন শিল্পী আগে যতটা জীবনের অনিত্য অনুভবকে আঁকতেন অর্থাৎ এ জীবন একসময় ফুরিয়ে যাবে এবং এ অনাদিকাল বা ধাবমান কাল, তার মধ্যে আমরা সামান্য মানুষ। এই যে কান্না বা বেদনাবোধ, এ বেদনাবোধ তিনি আঁকলেও এখন ক্রমেই তিনি এই ৮০ বছর বয়সে আরও বেশি জীবনবাদী হয়ে ওঠেন। আর তার বড় একটা বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। রাজনৈতিক ভাবাদর্শের দিক দিয়ে আমরা দেখেছি, রফিকুন নবীর সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের প্রতি বিশেষ বিশ্বাস আছে। তার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের জীবনের যে বঞ্চনা, তা থেকে তার মুক্তি ঘটবে, এটা তিনি চান। তার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে চীনাপন্থি এবং মস্কোপন্থি উভয়ের সঙ্গে তিনি খুব ভালোভাবে মেলামেশা করেছেন। আমার মনে হয়, এই সমাজতান্ত্রিক মানসিক মানুষের সঙ্গে মেলামেশা রফিকুন নবীর বোধকে বলীয়ান করেছে। যার জন্য তিনি যে টোকাই ছবি আঁকছেন, সেই টোকাই সমাজ ও রাজনীতি সচেতন। তিনি এ চরিত্রের মধ্য দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, যা দিয়ে তিনি দুঃশাসন, অপশাসন, দুষ্টমানুষ, নষ্টমানুষÑ এসব মানুষের সমালোচনা করছেন। টোকাই কার্টুনের প্রণেতা বা পিতা রফিকুন নবী আমাদের শিল্পের ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায়। যার বিশ্লেষণ ছাড়া আমরা বুঝতেই পারব না, আমাদের ক্যারিক্যাচার শিল্পে কী উন্নতি ঘটেছে। ক্যারিক্যাচার শিল্পের ভুবনে তার অবস্থান সম্রাটের মতো বলা যায়। এককভাবে তিনি সেখানে বিরাজ করছেন তার টোকাই চরিত্র নিয়ে। টোকাই চরিত্রটি এখন অভিধানে চলে আসছে এবং দেশের বাইরে অনেক জায়গায়, অভিধানে এ শব্দটি পাওয়া যায়। এ টোকাইয়ের স্রষ্টা রফিকুন নবী ষাটের দশকে প্রথম সমালোচনা শুরু করেন আইয়ুব খানকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি প্রায় সব শাসককে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছেন রফিকুন নবী। কারণ হচ্ছে, শিল্পীমন এমনি একটা জীবন প্রার্থনা করে, যেখানে সাধারণ মানুষ ভালোভাবে থাকবে। সেটা না পেলে দুর্দশা কী হয়, তা অতিসংবেদি এক শিল্পীমন প্রতিনিয়ত অনুভব করে চলেছেন। যার জন্য অনেকটা স্বপনচারীও হয়ে যান। ফলে কোনো শাসকই একজন শিল্পীমনকে তুষ্ট করতে পারে না। এ শিল্পকে তুষ্ট করতে পারে না বলেই রফিকুন নবী বারবার সব কালখণ্ডে, সব শাসককে বিদ্রূপবাণে ঘায়েল করেছেন। এটা যদি আমরা দেখি, তাহলে তার পূর্বসূরি কামরুল হাসান। কামরুল হাসান রফিকুন নবীর প্রেরণা, আমরা তা জানি। শিল্পীদের দীক্ষাকে তিনি অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেন। তার সবচেয়ে বড় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায় শিল্পীগুরু জয়নুল আবেদিনের প্রতি, কামরুল হাসানের প্রতি, কাইয়ূম চৌধুরীর প্রতি। এবং এই যে গুরুশিল্পীরা তাদের নিজস্ব ভাষা তৈরি করেছেন, তার ভাষার ভেতর থেকে নতুন একটা শিল্পভাষা নিজের মতো করে তৈরি করে নেওয়া, রফিকুন নবীর শৈল্পিক পারমিতার বিশেষ শিল্পমান পাওয়া যাচ্ছে।

রফিকুন নবী বা একজন শিল্পী যখন ছবি আঁকতে থাকেন, তখন তার মধ্যে আমরা যে জিনিসগুলো দেখি, তা হলো, যা দিয়ে ছবি আঁকা হয় অর্থাৎ রঙ, রেখা ফর্ম; এগুলো এমনভাবে শিল্পী চৈতন্যে অভিধা টানে যে, এগুলোই স্বয়ম্ভু হয়ে ওঠে। যা দিয়ে ছবি আঁকা হয়, ছবির অনুষঙ্গ বা উপাদান, স্বয়ম্ভু হয়ে বিশেষ চালে চলতে থাকে। যার ফলে একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা রফিকুন নবীর এমনও ছবি দেখেছি, যেখানে রঙিন রেখার পোঁচ, হালকা পর্দার পাশে বর্ণঘনত্বের মতো গাঢ় জমিÑ এ সবকিছু মিলেমিশে মনে হয় যেন শিল্পী চৈতন্যের স্বরূপ প্রকাশ করছেন, বর্ণবোধ প্রকাশ করছেন, রেখার বোধ তিনি প্রকাশ করছেন। যা দিয়ে মানুষ, প্রকৃতি, প্রাণিকুল সব প্রকাশ করছেন। অর্থাৎ স্বয়ম্ভু উত্থানচিত্র নির্মাণের এসব উপাদান ব্যবহার করছেন। এটাই হচ্ছে রফিকুন নবীর চিত্রভাষার শেষ ঠিকানা।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা